দারসুল হাদীস- ক্বিয়ামত দিবসের মূল্যবান পাঁচটি প্রশ্নঃ-
***********************************************
যে পাঁচটি প্রশ্নের জবাব না দেয়া পর্যন্ত কেউই এক কদম নড়তে পারবে না।
ﺑِﺴْﻢِ ﺍﻟﻠَّﻪِ ﺍﻟﺮَّﺣْﻤَٰﻦِ ﺍﻟﺮَّﺣِﻴﻢِ--
عَنِ ابْنِ مَسْعُودٍ، عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ " لاَ تَزُولُ قَدَمَا ابْنِ آدَمَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ مِنْ عِنْدِ رَبِّهِ حَتَّى يُسْأَلَ عَنْ خَمْسٍ عَنْ عُمْرِهِ فِيمَا أَفْنَاهُ وَعَنْ شَبَابِهِ فِيمَا أَبْلاَهُ وَمَالِهِ مِنْ أَيْنَ اكْتَسَبَهُ وَفِيمَ أَنْفَقَهُ وَمَاذَا عَمِلَ فِيمَا عَلِمَ "
অনুবাদঃ-
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) নবীয়ে কারীম (সা) থেকে বর্ণনা করেন, নবীজী (সা) বলেন পাঁচটি বিষয়ে জবাব না দেয়া পর্যন্ত কোন মানব সন্তানের পা উঠাতে দেয়া হবে না।
ক. জীবন কীভাবে শেষ করেছ?
খ. যৌবন কিভাবে বিদায় করেছ?
গ. ধনসম্পদ কিভাবে উপার্জন করেছ?
ঘ. কোন পথে উহা ব্যয় করেছ? এবং
ঙ. অর্জিত জ্ঞানের কতটুকু আমল করেছ?
*সহীহ তিরমিযি।
রাবির পরিচয়ঃ-
ইসলাম প্রচারের প্রাথমিক অবস্থায় যে কয়জন মুসলমান হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করেছিলেন হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসুদ (রা:) ছিলেন তাদের একজন। তিনি আবিসিনিয়ায় হিজরত করেছিলেন এবং নবীকরিম (সা:) এর মদিনায় হিজরতের পর মদিনায় চলে আসেন। তিনি সর্বদা রাসূল (সা:) এর খেদমতে নিয়োজিত থাকতেন, এবং ছায়ার মত তাকে অনুসরণ করতেন। হযরত আবু মুসা আশরারী বলেন, “আমরা ইয়েমেন থেকে এসে বহুদিন পর্যন্ত ইবনে মাসুদ (রা:) কে নবী পরিবারের লোক বলে মনে করতাম।”
হযরত আব্দুল্লাহর ইবনে মাসুদ (রা:) একজন বিজ্ঞ আলেম ছিলেন। তিনি কোরআন, হাদিস, ইত্যাদি সব বিষয়েই সমান পারদর্শী ছিলেন। মদিনার যে কয়জন সাহাবী ফতোয়া দিতেন তিনি ছিলেন তাদের অন্যতম, কোরআন শিক্ষায় তিনি বিশেষ পারদর্শী। নবী করিম (সা:) বলেন: “কুরআন শরীফ যে ভাবে নাজিল হয়েছে হুবহু সে ভাবে যদি কেহ পড়তে চায় সে যেন আব্দুল্লাহ ইবনে মাসুদের কাছে যায়।” তিনি আল কুরআনের বিষেশজ্ঞ সাহাবী ছিলেন।
ইবনে মাসউদ বলতেন, সে আল্লাহর কসম যিনি ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই। কুরআন মাজিদের এমন কোন আয়াত নাযিল হয়নি। যে আয়াত সম্পর্কে আমি জানি না তা কোথায় নাযিল হয়েছে আর কি বিষয়ে নাযিল হয়েছে।
তিনি প্রথমে আবিসিনিয়ায় ও পরে মদীনা শরিফে হিযরত করেন। তিনি রাসূল (সা) সাথে বহু যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন। তিনি দীর্ঘদিন কুফায় কাজীর পদে অধিষ্ঠিত থাকেন। তিনি ৮৪৮টি হাদিস বর্ণনা করেন। বুখারীতে ২১৫টি হাদিস সংকলিত হয়েছে। হযরত উসমান (রা) খিলাফতের সময় তিনি মৃত্যুর শয্যায় শায়িত হলে খলিফা তাকে দেখতে যান। খলিফা জিজ্ঞাসা করেন, আপনাকে অস্থির মনে হচ্ছে কেন? ইবনে মাসউদ বলেন, “আমি গুনাহর জন্যে আল্লাহ তায়ালা কে ভয় করছি”। খলিফা আবার বলেন, “আপনি কিসের আকাংখা করছেন? তিনি বলেন, “আমি শুধু আল্লাহর রহমতের আকাংখা করছি”। খলিফা আবার জিজ্ঞাসা করেন, “বায়তুলমাল হতে নাগরিক ভাতা নিচ্ছেন না অনেক দিন, তা কি আপনার মেয়েদের জন্য চালু করব?” না আমি আমার মেয়েদের অভাবগ্রস্ত হওয়ার আশংকা করি না। আমি তাদেরকে প্রতি রাতে সূরা ওয়াকিয়াহ পাঠ করার নির্দেশ দিয়েছি আমি আমার প্রিয় রাসূলকে বলতে শুনেছি-
وَأِنِّىْ سَمِعْتُ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُوْلُ: مَنْ قَرَألْوَاقِعَةَ كُلُّ لَيْلَةٍ لَمْ تُصِبْهُ فَاقَةً اَبَدًا ط
“যে প্রতি রাত সূরা ওয়াকিয়াহ পাঠ করবে অভাব তাকে স্পর্শ করবে না”।
ঐ রাতে কুরআন আল কারিম তিলাওয়াত করা অবস্থায় ৩৩ হিজরি ৯ রমযান ৬০বছর বয়সে ইবনে মাসউদ ইন্তেকাল করেন। হযরত উসমান (রা) তার জানাযার ইমামত করেন এবং তাকে বাকির কবরস্থানে দাফন করা হয়।
এই জ্ঞানের বিশাল মহিরুহ হিজরী ৩২ সালে মদিনায় ইন্তেকাল করেন। তার বর্ণিত হাদিসের সংখ্যা ৮৪৮ টি। ইমাম বুখারী ও মুসলিমের ঐক্যমতের হাদিস ৬৪টি, তাছাড়া বুখারী ২৬৪টি এবং মুসলিম ৩৫টি হাদিস বর্ণনা করেছেন।
হাদিসের গুরুত্বঃ-
আলোচ্য হাদিসে মানুষের নৈতিক চরিত্র সংশোধন কল্পে আখিরাতের জবাব দিহির অনুভূতি জাগ্রত করার প্রয়াস পেয়েছে। যতক্ষণ পর্যন্ত মানুষের মধ্যে খোদাভীতি ও পরকালের জবাবদিহি অনুভূতি জাগ্রত না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত নৈতিক চরিত্র সংশোধনের আশা করা বৃথা। কারণ আমাদের এ জীবনের পর অনন্ত কালের এক জীবন আছে এবং সে জীবনের সাফল্য এবং ব্যর্থতা সম্পুর্ণরুপে নির্ভর করে এ জীবনের কর্ম ফলের উপর; আর প্রতিটি কর্মেরই সুক্ষভাবে বিচার বিশ্লেষণ করা হবে একমাত্র এই অনুভূতিই মানুষকে মহৎ হতে বাধ্য করে।
কিয়ামাহ একটি ভয়াল দিনের নাম ইহা কখন কিভাবে শুরু হবে আল্লাহ ছাড়া কারে জানা নেই। কুরআন বলছে-
﴿ يَسۡـَٔلُوۡنَكَ عَنِ السَّاعَةِ اَيَّانَ مُرۡسٰٮهَاؕ﴾
﴿ فِيۡمَ اَنۡتَ مِنۡ ذِكۡرٰٮهَاؕ﴾
﴿ اِلٰى رَبِّكَ مُنۡتَهٰٮهَاؕ﴾
“উহারা তোমাকে জিজ্ঞাসা করে কিয়ামাহ সম্পর্কে, উহা কখন ঘটবে? এর সাথে তোমার সম্পর্ক কি? এ বিষয়ের চূড়ান্ত জ্ঞান তোমার রবের নিকট রয়েছে।” (সূরা নাযিয়াহ : ৪২-৪৪)।
অপর আয়াতে বর্ণীত-
﴿ يَوۡمَ لَا يَنۡفَعُ مَالٌ وَّلَا بَنُوۡنَۙ﴾
﴿ اِلَّا مَنۡ اَتَى اللّٰهَ بِقَلۡبٍ سَلِيۡمٍؕ﴾
“যেদিন ধনসম্পদ সন্তান-সন্ততি কোনো কাজে আসবে না। যারা বিশুদ্ধ অন্তঃকরণ নিয়ে আসবে তারাই মুক্তি পাবে।”
অন্যত্র বর্ণীত-
﴿اَلۡيَوۡمَ نَخۡتِمُ عَلٰٓى اَفۡوَاهِهِمۡ وَتُكَلِّمُنَاۤ اَيۡدِيۡهِمۡ وَتَشۡهَدُ اَرۡجُلُهُمۡ بِمَا كَانُوۡا يَكۡسِبُوۡنَ﴾
“আজ আমরা ইহাদের মুখে মোহর করে দেব আজ তাদের হাত কথা বলবে তাদের পা সমূহ তাদের কৃত কর্মের সাক্ষ্য দেবে।” (সূরা ইয়াসিন : ৬৫)।
তাছাড়া পার্থিব জীবনের আচার আচরণ সম্বন্ধেও ইংগিত প্রদান করা হয়েছে এ হাদিসের মধ্যে। তাই প্রতিটি মুসলমানের জীবনে এ হাদিসটির গুরুত্ব অনস্বীকার্য।
হাদিসের তাফসীরঃ
যে পাচঁটি বিষয় কঠিন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে সকলকেঃ
ক. প্রথম প্রশ্ন : হায়াত কিভাবে শেষ হয়েছে।
ﻋَﻦْ ﻋُﻤْﺮِﻩ ﻓِﻴْﻤَﺎ ﺍَﻓْﻨَﺎﻩُ,,,
হায়াত মূলত কতগুলো মুহূর্তের সমষ্টি। বিন্দু বিন্দু জল কনা যেমন সাগর সৃষ্টি করে তেমনি এক এক মুহূর্ত সময়ের কনিকা আশি বছরের জীবন তৈরি করে। এ জীবন ও মৃত্যু আল্লাহর একক নিয়ন্ত্রণে। তিনি জীবন ও মৃত্যুর একক স্রষ্টা তার মাধ্যমে মানুষকে পরীক্ষা করেন কে সৎ কাজ করে আরকে অসৎ পথে জীবন ব্যয় করে। পরীক্ষার জন্যে যে জীবন নির্দিষ্ট তাকে যেনতেনভাবে ব্যয় করার কোনো সুযোগ নেই। কুরআন বলছে-
﴿الَّذِىۡ خَلَقَ الۡمَوۡتَ وَالۡحَيٰوةَ لِيَبۡلُوَكُمۡ اَيُّكُمۡ اَحۡسَنُ عَمَلاًؕ وَهُوَ الۡعَزِيۡزُ الۡغَفُوۡرُۙ﴾..
“তিনি আল্লাহ, যিনি হায়াত ও মৃত্যুকে তোমাদের পরীক্ষার জন্যে সৃষ্টি করেছেন কে তোমাদের মধ্যে আমলের দৃষ্টিতে উত্তম আর কে অধম। তিনি মহা পরাক্রমশালী ও ক্ষমাশীল।”
(সূরা মুলক : ২)
মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে শুধুমাত্র আল্লাহর ইবাদতের জন্য, যেমন কুরআনে বলা হয়েছে
অর্থ: “আমি মানুষ ও জ্বীনকে সৃষ্টি করেছি শুধুমাত্র আমার ইবাদত করার জন্য।”
ইবাদত করতে প্রতিটি মানুষ অথবা জ্বীনকে জন্ম হতে মৃত্যু পর্যন্ত আল্লাহর দাসত্ব বা গোলামী করার কথা বলা হয়েছে। কারণ ইয়াবুদুন শব্দটি আবদুন শব্দ হতে নির্গত আর আব্দুন শব্দের অর্থ হলো গোলাম বা দাস। কাজেই দাসত্ব বা গোলামী জীবনের কোন একটি সময় বা মুহুর্ত পর্যন্ত সীমিত নয় বরং সমস্ত জীবন ব্যাপী এ দায়িত্ব।
অন্যত্র বলা হয়েছে
অর্থ: “তোমরা কি মনে করেছ আমরা তোমরাদেরকে অকারনেই সৃষ্টি করেছি। আর তোমাদেরকে কখনই আমার নিকট ফিরে আসতে হবে না। (মুমিনুন-১১৫)
তাই দেখা যায় পৃথিবীর প্রতিটি চাকচিক্য ময় বস্তু মানুষের পরীক্ষার জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে। আর এ পরীক্ষার সফলতা বা ব্যর্থতার কেন্দ্র করেই শুরু হবে পরকালের জীবন। সত্যি কথা বলতে কি ছোট্র একটি প্রশ্নের উত্তর সমস্ত জীবন ব্যাপী বিস্তুৃত।
আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্যের পরিধি অনেক বিস্তৃত ও সীমাহীন যদিও আমাদের জীবনের কাল সীমিত ও সংক্ষিপ্ত। এক মুহূর্ত জীবন অলসতার বা অবহেলা এবং অপরিকল্পিত ব্যয় করার কোনো সুযোগ নেই। আবার উদ্দেশ্যহীন লক্ষ্যহীন জীবনকে ব্যয় করার কোনো অনুমতি ও আল্লাহ তায়ালা দেননি।
খ. দ্বিতীয় প্রশ্নঃ- যৌবনের শক্তি ও যোগ্যতা কোথায় ব্যয় করেছে?
ﻭَعَنْ شَبَابِهِ فِيمَا أَبْلاَهُ,,,
কিয়ামতের দিন পাঁচটি প্রশ্নের মধ্যে দুইটি জীবন সংক্রান্ত। একটি সম্পূর্ণ হায়াতের বিষয়ে অপরটি জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ যৌবন সম্মন্ধে বলা যায়, যৌবন হচ্ছে জীবনের বসন্ত কাল। এ সময়টি জীবনের সবচেয়ে বেশি দামী। মানুষ বার্ধক্যে অনেক কিছু করার ইচ্ছা থাকলেও শারিরিক অযোগ্যতার কারণে তা করা সম্ভব হয়ে উঠে না। তাই জীবনের বর্ণাঢ্য বিকাশ ও প্রকাশে যৌবন কালের কোন বিকল্প নেই। প্রকৃতিতে বসন্ত বার বার আসে। কিন্তু জীবনের বসন্ত যৌবন একবার চলে যাওয়ার পর আর ফিরে আসেনি ও আসবেনা। যে কেউ এ যৌবনের শক্তি ও যোগ্যতা কাজে লাগিয়ে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক এবং মানবতার কল্যাণে অনেক কিছু করার সুযোগ রয়েছে। আবার এই শক্তিকে জুলুম অত্যাচার, অনাচার সৃষ্টিতে লাগাতে পারে।
অনেকে ধারণা করে জীবন ও যৌবনের অনাচার কদাচার করলেও বুড়ো বয়সে নেক কাজে আত্ম নিয়োগ করবে।
প্রতিটি বস্তুরই একটি উৎকৃষ্ট অংশ থাকে আর জীবনের উৎকৃষ্ট অংশ হচ্ছে যৌবন কাল। নিম্নে চারটি গুণের পরিপূর্ণ সমাবেশ ঘটে এই যৌবনে।
১. চিন্তা শক্তি,
২. ইচ্ছা শক্তি,
৩. মনন শক্তি,
৪. কর্ম শক্তি।
অতএব দেখা যাচ্ছে ভাল অথবা মন্দ যে কাজই করা হোকনা কেন যৌবন ই তার প্রধান উদ্যোক্তা। কারন মানুষ চুরি, ডাকাতি, জুলুম, নির্যাতন, অহংকার ইত্যাদি সব কিছুই করে যৌবন কালে দেখা যায়। যৌবনের দুধর্ষ এক লোক বার্ধক্যের কষাঘাতে নেহায়েত গোবেচারায় রুপান্তরিত হয়। কারন বার্ধক্য মানুষকে নিরীহ করে দেয়। তাই বার্ধক্য যেমন অন্যায় অত্যাচারের পথ রুদ্ধ করে দেয় তদ্রুপ যতো সৎ নিয়ত এবং প্রচেষ্টাই থাকে না কেন বার্ধক্য আসার পর কোন একটি ভাল কাজ ও সুচারু রুপে সম্পন্ন করা সম্ভব নয়, এখানে বার্ধক্য তার প্রধান অন্তরায়। এজন্য যৌবন এত গুরুত্বপূর্ণ।
হাদিসে বর্ণিত হয়েছে
আফসোস তারা জানে না যে এই রকম আশা পোষণকারি অনেকে সেদিন আমার আগে আল্লাহর সাথে দেখা হয়ে গেছে। কারণ আগামী কাল বেচে থাকার কোন গ্যারান্টি কারো নেই। আবার যৌবন কাল বিষয়ে যেহেতু প্রশ্ন হবে তাই উহা চলে যাওয়ার পূর্বে সবাইকে সর্তক হয়ে যেথে হবে। রাসূল (সা) তাই বলেছেন,
“তোমরা পাঁচটি বিষয়কে অপর পাঁচটি বিয়ষের পূর্বে গুরুত্ব প্রদান করোঃ
عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لِرَجُلٍ وَهُوَ يَعِظُهُ: " اغْتَنِمْ خَمْسًا قَبْلَ خَمْسٍ , شَبَابَكَ قَبْلَ هَرَمِكَ , وَصِحَّتَكَ قَبْلَ سَقَمِكَ , وَغِنَاكَ قَبْلَ فَقْرِكَ , وَفَرَاغَكَ قَبْلَ شُغُلُكَ , وَحَيَاتَكَ قَبْلَ مَوْتِكَ -
অনুবাদ: হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল (সা.) এক ব্যক্তিকে নসিহত করতে গিয়ে বলেছেন, তুমি ৫টি বিষয়ের পূর্বে ৫টি বিষয়কে গুরুত্ব দাও।
১. বার্ধক্য আসার পূর্বেই যৌবনকে,
২. অসুস্থতা আসার পূর্বেই সুস্থতাকে,
৩. দারিদ্রতা আসার পূর্বেই স্বচ্ছলতাকে,
৪. ব্যস্ততা আসার পূর্বেই অবসরকে এবং
৫. মৃত্যু আসার পূবেই জীবনকে। (বাইহাকী শুআবুল ঈমান)
★গ. তৃতীয় প্রশ্নঃ-
ﻭَﻋَﻦْ ﻣَﺎﻟِﻪ ﻣِﻦْ ﺍَﻳْﻦَ ﺍَﻟْﺘَﺴَﺒَﻪ ﻭَﻓِﻴْﻤَﺎ ﺍَﻧْﻔَﻘَﻪ ০
মালসম্পদ কোথায় হতে উপার্জন করেছ?
দুনিয়ার মোহ যেন মানুষের স্বভাব জাত। কুরআন বলেছেন,
﴿ وَاِنَّهٗ لِحُبِّ الۡخَيۡرِ لَشَدِيۡدٌؕ﴾...
“অব্যশই মানব হৃদয়ে সম্পদের মোহ অতি প্রবল।” (সূরা আদিয়াত : ৮)
পৃথিবীতে যত বিপর্যয় সংগঠিত হচ্ছে তার অধিকাংশ সম্পদের কারণে হচ্ছে। কি ব্যক্তি জীবনে বা জাতীয় জীবনে সর্বস্থরে চলছে সম্পদ ও প্রাচুয্য প্রতিযোগিতা। সম্পদ মানুষের জীবন যাপনের অপরিহার্য এক বিষয়। উহা ছাড়া জীবনের একটি দিন অতিবাহিত করা যাবে। কিন্তু উহারতো একটি সীমা আছে। আল্লাহ তায়ালা মানুষের জীবনের এ অপরিহার্য জিনিষ ধনসম্পদ উপার্জন ও ব্যয়ের ক্ষেত্রে কিছু বিধি (হালাল হারামের সীমা) বর্ণনা করে দিয়েছেন। যেমন ব্যবসাকে হালাল করেছেন আবার সুদকে হারাম করেছেন। রাসুল (সা)-কে সর্বোৎকৃষ্ট আয় সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, যাহা হাত দিযে অর্থাৎ পরিশ্রম করে অর্জন করা হয়। আর উত্তম ব্যবসা আবার উত্তম খরচ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে নবী করীম (সা) বলেন,
১) পরিবার পরিজন প্রতিপালনের জন্য যে মাল ব্যয় হয়েছে।
২) যা দিয়ে যিহাদের হাতিয়ার ক্রয় করা হয়েছে।
৩) যে মাল মুজাহিদদের জন্য ব্যয় হয়েছে।
মানুষ পৃথিবীতে ভোগের জন্য সর্বদা পাগল পারা। তার একটা লক্ষ্য ধন সম্পদের স্তুপে সুখের সন্ধান করা। এ জন্য চুরি, ডাকাতি, অপরের সম্পদ হরণ অথবা ধোকাবাজী যা কিছু হোকনা কেন তাতে পরওয়া নেই। আর এভাবে যদি কোন সমাজ চলে তবে সে সমাজের ধ্বংস অনিবার্য। তাই বিশ্ব প্রভু সমাজের ভারসাম্য বজায় রেখে একটি সুখী সমৃদ্ধশীল সমাজ কায়েমের লক্ষে ধন-সম্পদ আয় এবং তার ব্যয়ের মধ্যেও শর্তারোপ করেছেন। যাতে সমাজের কারো কোন অধিকার ভোগ করতে পারে। নিম্নে সম্পদ অর্জনের মৌলিক বিধি নিষেধ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।
১. কারও অধিকার নষ্ট করে সম্পদ অর্জন করা যাবে না। যেমন মিরাসের অংশ না দিয়ে অথবা মহরের প্রাপ্ত টাকা না দিয়ে ভোগ করা এতিমের মাল ভোগ করা ইত্যাদি।
২. ব্যভিচার বা কোন প্রকার দেহ ব্যবসার মাধ্যমে ও সম্পদ অর্জন করা যাবে না।
৩. চুরি, ডাকাতি, হত্যা, লুন্ঠন, ইত্যাদির মাধ্যমেও জীবিকা বা সম্পদ অর্জন করা যাবে না।
৪. কাউকে ধোকা দিয়ে বা ঠকিয়ে ধন সম্পদ অর্জন করা যাবে না।
৫. গান, বাজনা, অভিনয় ইত্যাদিকেও জীবনের পেশা হিসাবে গ্রহণ করা যাবে না।
৬. হারাম মালের দ্বারা ব্যবসার মাধ্যমে
৭. মুনাফা বৃদ্ধির লক্ষ্যে দ্রব্য সামগ্রী ৪০ দিনের অধিক জমা রেখে ঐ মুনাফা লব্ধ টাকার মাধ্যমে।
৮. সুদ অথবা ঘুষের মাধ্যমে সম্পদ আহরন বা বর্ধিত করা যাবে না।
৯. জুয়া, হাউজি, ভাগ্যগণনা, লটারী ইত্যাদির মাধ্যমেও সম্পদ অর্জন করা যাবে না।
১০. ওজনে কম দেওয়া।
উপরের বিধি গুলি সামনে রেখে উপার্জন করতে হবে। ব্যয়ের মৌলিক খাত সমূহ নিম্নে দেওয়া হলো।
১. ব্যক্তিগত ও পারিবারিক প্রয়োজনে ব্যয় করার অবাধ স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে কিন্তু শর্তারোপ করা হয়েছে অপচয় না করার।
২. নেছাবের মালিক হলে যাকাত দিতে হবে।
৩. ছাদকা
৪. নিকট আত্মীয়ের হক?
৫. ইয়াতিমের হক
৬. মিসকীনের হক, ভিক্ষুকের হক
৭. জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ
৮. বিভিন্ন ধরনের কাফ্ফারা আদায়
৯. পথিক বা পর্যটকের হক।
বস্তুত প্রত্যেকটি বনী আদমকেই প্রশ্ন করা হবে যে উপরোক্ত শর্তাবলীই পালন করেই সে সম্পদ আয় ও ব্যয় করেছে কি না?
★ঘ. চতুর্থ প্রশ্নঃ- অর্জিত সম্পদ কোন পথে ব্যয় করেছ?
আজ সমাজের দিকে থাকালে দেখা যায়, অনেকের উপার্জন হারাম উপায়ে আবার ব্যয়ও করেছে অবৈধ পন্থায়, আবার কারো আয় হালাল পন্থায় কিন্তু ব্যয় করেছে হারাম পন্থায়, আবার এমন ও বিকল্প দৃষ্টান্ত আছে। যাদের আয় রোজগার হারাম পন্থায় ব্যয় করে সৎ পথে আর খুব কমই এমন দৃষ্টান্ত যাদের সম্পূর্ণ আয় রোজগার বৈধ পন্থায় আর ব্যয়ও করে শরিয়তের মানদন্ডে।
একটি শ্রেণী ব্যতীত কারো রেহাই হবে না কিয়ামতের কঠিন দিনে। তাদেরও নয় যাদের আয়-উপর্জন করেও যারা ব্যয়ের ক্ষেত্রে বৈধ পন্থায় অপচয় করে বা প্রয়োজনীয় খরচ করে না। তারাও জবাবদিহি হতে রেহাই পাবে না।
আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের ব্যয় সম্পর্কে কুরআন বলেছে-
وَالَّذِينَ إِذَا أَنفَقُوا لَمْ يُسْرِفُوا وَلَمْ يَقْتُرُوا وَكَانَ بَيْنَ ذَلِكَ قَوَامًا...
“যখন তারা ব্যয় করে তখন অপব্যয় করে না। কার্পণ্যও করে না। বরং তারা মধ্যম পন্থায় করে।” (সুরা ফুরকান- ৬৭)
ঙ. পঞ্চম প্রশ্নঃ- “যে জ্ঞান সে অর্জন করেছে তার কতটুকু আমল।
وَمَاذَا عَمِلَ فِيمَا عَلِمَ "
পৃথিবীতে মানব জাতীর শ্রেষ্ঠত্বের মূল কারণ- জ্ঞান।
আল্লাহ তায়ালা আদমকে জ্ঞান দিয়ে সম্মানিত করেছিলেন। আর আল্লাহ তায়ালা সকল জ্ঞানের মূল উৎস। যারা জানে আর যারা জানে না তারা সমান হতে পারে না।
তবে জ্ঞান নিজেই কোন উদ্দেশ্যে নহে। আমলের জন্য ইলম জরুরী। নবীয়ে কারীম (সা) বলেছেন,
“যে আলেমের নিকট আমল নেই সে তো ঐ গাছের মত যার ফল নেই।”
যে জ্ঞানী তার অর্জিত জ্ঞানের উপর আমর করে না সে জ্ঞানকে অসাম্মানিত করে। একটি সময় আসবে যেদিন আমল বিহীন এ জ্ঞানই তার অসম্মানের কারণ হবে।
“হযরত আনাস হতে বর্ণিত, নবী কারিম (সা) বলেছেন,
عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ، قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ ـ صلى الله عليه وسلم ـ " طَلَبُ الْعِلْمِ فَرِيضَةٌ عَلَى كُلِّ مُسْلِمٍ,,,
“ইলম অর্জন করা প্রত্যেক মুসলিমের উপর ফরজ। আর অনুপযুক্ত ব্যক্তিকে যে ইলম দান করে সে যেন শুকরের গলায় হিরা মনিমুক্তার মালা ঝুলায়।” (ইবনে মাজাহ)
হাদীসের উক্তি তাহলো জানাটা হবে মানার জন্যে। নিছক জানাটাই মুক্তি নয় বরং মানাটাই হচ্ছে মুক্তি। কিয়ামতেও প্রশ্ন হবে জানার কতটুকৃ মানা হয়েছে বা আমল করা হয়েছে। আমলকে মিজানের পাল্লায় তোলা হবে উহার উপর জান্নাত-জান্নামের ফায়সালা হবে।
হাদিসের শিক্ষাঃ-
১. “কিয়ামাত” একটি কঠিন ও ভয়াবহ দিন, সমগ্র সৃষ্টি যে দিন আল্লাহ তায়ালার নিকট হাজির হবে। ন্যায় ও অন্যায়ের বিষয়ে তুলা দন্ডে বিচার হবে আর জান্নাতী ও জাহান্নামী কারা তার ঘোষণা হবে।
২. যে প্রশ্ন হাশরের মাঠে হবে উহার প্রস্তুতি দুনিয়ার জীবন থেকে মৃত্যুর আগেই শেষ করতে হবে। নতুবা শুধু আফসুস করে হাতের আঙ্গুল কামড়িয়ে খেয়ে ফেলবে কিন্তু কোন ফল হবে না।
৩. জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত মূল্যবান ও আল্লাহর দান। একে অপচয় করা যাবে না। আর জীবনকে ন্যায়ের পথে ব্যয় করতে হবে।
৪. যৌবনকে হায়াতের সবচেয়ে মূল্যবান অংশ হিসাবে গ্রহণ করতে হবে। যাবতীয় সীমা লঙ্ঘন ও পাপাচার থেকে দূরে থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে ‘যে ব্যক্তি যৌবনকে আল্লাহর বন্দেগীতে বার্ধাক্যে পৌঁছে দিয়েছে সে কিয়ামতের কঠিন দিনে আল্লাহর আরশের নিচে অবস্থান কারীদের অন্তভুক্ত হবে।’
৫. জীবন পরিচালনায় হালাল রুজি অšে¦ষণ করা গুরুত্বপূর্ণ ফরজ। হারামের রাজপথ ছেড়ে দিয়ে হালালের কণ্টকাকীর্ণ গলিপথে চলিতে হবে। এর জন্যে বিলাসিতার জীবন নয় বরং সাধাসিধা জীবন যাপনে অভ্যস্থ হতে হবে।
৬. কোন অবস্থায় হারামের পথে মাল সম্পদের এক কণা ব্যয় করা যাবে না। সব সম্পদের মূল মালিক আল্লাহ তায়ালা। তার অসন্তোষের পথে চলার পরিণতি ভয়াবহ হবে একদিন।
৭. জ্ঞান শুধু অর্জন করাই সার্থকতা নয় বরং অর্জিত জ্ঞানকে আমলে রূপান্তর করাই সফলতা। সমস্ত কামিয়াবীর ফায়সালা হবে আমলের উপর।
Comments
Post a Comment