তাওবাহ ও এর তাৎপর্য কি? এ সম্পর্কে জানুন এবং আমল করুন:-
"""""""""""""""""""""""""""""" """""""""""""""""""""""""""""" """""
তাওবা অর্থ:-
তাওবা শব্দের অর্থ হল ফিরে আসা, প্রত্যাবর্তন করা । অর্থাৎ গোনাহ থেকে ফিরে আসা এবং ভবিষ্যতে তার ধারে কাছে না যাওয়ার দৃঢ সংকল্প করা ।
মহান আল্লাহ সমস্ত মুমিনদেরকে তাওবা করার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন:-
وَتُوۡبُوۡۤا اِلَى اللّٰهِ جَمِيۡعًا اَيُّهَ الۡمُؤۡمِنُوۡنَ لَعَلَّكُمۡ تُفۡلِحُوۡنَ﴾
"হে মুমিনগণ! তোমরা সকলে আল্লাহর পানে তাওবা (প্রত্যাবর্তন) কর, নিশ্চয় তোমরা সফলকাম হবে।" (আননূর: ৩১)
তিনি তাঁর বান্দাদেরকে তাওবাকারী ও অত্যাচারী হিসেবে দুইভাগে ভাগ করেছেন। এখানে তৃতীয় কোন ভাগ নেই। মহান আল্লাহ বলেন:-
وَمَنۡ لَّمۡ يَتُبۡ فَاُولٰٓٮِٕكَ هُمُ الظّٰلِمُوۡنَ﴾
"যারা তাওবা করবে না,তারাই অত্যাচারী।
" (আলহুজুরাত: ১১)
আর এখন এমন এক সময় এসেছে যাতে মানুষ আল্লাহর দ্বীন থেকে দূরে সরে গেছে এবং পাপাচার ব্যাপকতা লাভ করছে ও বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে। অবস্থা এমন হয়েছে যে, এ থেকে আল্লাহর বিশেষ রহমত ছাড়া কেউই বাঁচতে পারছে না।
বান্দা যত গুনাহই করুক না কেন আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইলে তিনি ক্ষমা ও মাফ করেন, কেবল মাত্র শিরক-এর গুনাহ ছাড়া। বান্দার গুনাহ যত বড় তাঁর রহমত তাঁর চাইতেও বড়। তাই নিরাশ হওয়ার কোন কারণ নেই। আল্লাহ পবিত্র কুরআন মজীদে,ঘোষণা করেছেন,
﴿ قُلۡ يٰعِبَادِىَ الَّذِيۡنَ اَسۡرَفُوۡا عَلٰٓى اَنۡفُسِهِمۡ لَا تَقۡنَطُوۡا مِنۡ رَّحۡمَةِ اللّٰهِؕ اِنَّ اللّٰهَ يَغۡفِرُ الذُّنُوۡبَ جَمِيۡعًاؕ اِنَّهٗ هُوَ الۡغَفُوۡرُ الرَّحِيۡمُ﴾
‘হে আমার বান্দারা! তোমরা যারা নিজের আত্মার উপর জুলুম করেছ, আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হইও না। নিশ্চয়ই, আল্লাহ সকল গুনাহ মাফ করেন। নি:সন্দেহে তিনি অধিক ক্ষমাশীল ও মেহেরবান। (সূরা যুমার-৫৩)
এ আয়াত অনুযায়ী আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হওয়া নিষিদ্ধ বা কুফরী। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, ‘আল্লাহ দিনে গুনাহকারীদের গুনাহ মাফ করার জন্য রাত্রে নিজ ক্ষমার হাত সম্প্রসারিত করেন এবং রাত্রে গুনাহকারীদের গুনাহ মাফ করার জন্য দিনে নিজ ক্ষমার হাত সম্প্রসারিত করেন।’ কেয়ামতের আগে পশ্চিমে সূর্যোদয় পর্যন্ত এভাবেই চলতে থাকবে।’ আল্লাহ বান্দার গুনাহ মাফের জন্য রীতিমত অপেক্ষা করেন। বান্দা মাফ চাইলেই মাফ পেতে পারে।
রাসূলুল্লাহ (সা) আরো বলেছেন: ‘সেই ব্যক্তির নাক ধূলামলিন হোক, যে রমযান পেয়েছে কিন্তু তার গুনাহ মাফ হয়নি।’ (তিরমিযী)
হাদীসে কুদসীতে বর্ণিত আছে: ‘আল্লাহ বলেন, হে বনি আদম! তুমি আমার কাছে যা ইচ্ছা আশা করো এবং চাও, আমি তোমাকে মাফ করে দিলাম এবং এ জন্য আমি কোন পরোয়া করি না।, (তিরমিযী)
হাদীসে কুদসীতে আরো এসেছে, আল্লাহ বলেন, হে আমার বান্দা! তোমরা দিনে রাতে গুনাহ করে থাকো, আর আমি সকল গুনাহ মাফ করি। তোমরা আমার কাছে ক্ষমা চাও, আমি তোমাদের গুনাহ মাফ করে দেব।’ (মুসলিম)
গুনাহ মাফের জন্য এর চাইতে বড় প্রতিশ্রতি আর কি হতে পারে ? আল্লাহ আরও বলেন:
﴿ وَهُوَ الَّذِىۡ يَقۡبَلُ التَّوۡبَةَ عَنۡ عِبَادِهٖ وَيَعۡفُوۡا عَنِ السَّيِّاٰتِ وَيَعۡلَمُ مَا تَفۡعَلُوۡنَۙ﴾
‘তিনি সেই সত্তা যিনি বান্দার তাওবা কবুল করেন, তাদের গুনাহ মাফ করেন এবং তোমরা যা করো সবকিছু তিনি জানেন।’ (সূরা শুরা-২৫)
তিনি বান্দার তাওবা কবুল করেন। কিন্তু শর্ত হলো এখলাসের সাথে তাওবা করতে হবে এবং এরপর ইচ্ছাকৃতভাবে আর সেই গুনাহর পুনরাবৃত্তি করা যাবে না।
﴿وَأَنِ اسْتَغْفِرُواْ رَبَّكُمْ ثُمَّ تُوبُواْ إِلَيْهِ
“তোমাদের রবের নিকট ক্ষমাভিক্ষা করো এবং তার কাছে তাওবা করো ।”–হূদঃ ৩।
﴿ يٰۤاَيُّهَا الَّذِيۡنَ اٰمَنُوۡا تُوۡبُوۡۤا اِلَى اللّٰهِ تَوۡبَةً نَّصُوۡحًاؕ
“হে ঈমানদারেরা, আল্লাহর কাছে একটি খাঁটি তাওবা করো ।” –আত-তাহরীমঃ ৮
বিখ্যাত রিয়াদুস-সালেহীন গ্রন্থে চারটি শর্তের কথা উল্লেখ করেছেন । তবে শায়খ সালেহ ইবন আল-‘উসায়মীন বইটির ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আরও একটি শর্ত উল্লেখ করেছেন । আসুন তবে দেখে নেয়া যাক শর্তগুলো ।
১. ইখলাস
ইখলাস বলতে উদ্দেশ্য বা নিয়তের শুদ্ধতা বোঝায় । ইসলামি পরিভাষায় কোনো সৎ কাজকে কেবল মাত্র আল্লাহ্র সন্তুষ্টি কামনার উদ্দেশ্যে করাকে ইখলাস বলা হয় । ইখলাস ব্যতীত কোনো কাজই আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য নয় । তাওবার কাজটি গ্রহণযোগ্য হতে হলে সেটিও করতে হবে পূর্ণ ইখলাস সহকারে । মানুষকে দেখানোর জন্য বা তাদের নৈকট্য লাভের আশায় তাওবার কাজটি হয়ে থাকলে সেটিকে খাঁটি তাওবা বলা যাবে না । অথবা কোনো বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বা কোনোরূপ কর্তৃপক্ষের হাত থেকে বাঁচার জন্য যে তওবা সেটিও খাঁটি তওবা হিসেবে গৃহীত হবে না । অতএব তাওবার উদ্দেশ্য হতে হবে কেবল আল্লাহর নৈকট্য লাভ ও আখিরাতের সাফল্য অর্জন । যাতে আল্লাহ্ তাওবাকারীর কৃত অপরাধ ক্ষমা করে দেন ।
২. অনুশোচনা বোধ করা
কৃত অপরাধ বা পাপটির জন্য অন্তরে অনুশোচনা বোধ করতে হবে । তার মধ্যে মরমে মরে যাওয়ার একটি বোধ কাজ করতে হবে এবং তাকে অনুভব করতে হবে আল্লাহর কাছে ক্ষমাভিক্ষা করা ব্যতীত তার কাছে আর কোনো পথ খোলা নেই । অনুশোচনা বোধ করা এই জন্যই শর্ত যে এ থেকেই বোঝা যায় যে ব্যক্তিটি আল্লাহর কাছে সত্যি সত্যিই খাঁটি তাওবা করতে প্রস্তুত ।
৩. পাপকাজটি থেকে এখনই বিরত হওয়া
এটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শর্ত । তাওবাকে তখনই খাঁটি হিসেবে ধরা হবে যদি তাওবাকারী পাপ কাজটি ইতিমধ্যেই বন্ধ করে থাকে । নতুবা এটি একটি তামাশা বই তো কিছু নয় ! আর যে ব্যক্তি পাপকাজটি অব্যাহত রেখেই আল্লাহর কাছে তাওবা করছে সে সত্যিকার অর্থে অনুশোচনা বোধ করছে না, করলে সে কাজটি অন্তত বন্ধ করত । পাপকাজ থেকে বিরত হওয়া দুই অর্থে –
প্রথমত, সে একটি অন্যায় বা হারাম কাজ করছিল (যেমন মদ খাওয়া)– সেক্ষেত্রে তাকে সেটি থামিয়ে দিতে হবে ।
দ্বিতীয়ত, সে কোনো অবশ্য পালনীয় কাজ ফরজ বা ওয়াজিব কাজ বন্ধ রেখেছিলো (যেমন নামাজ না পড়া) – এক্ষেত্রে পাপকাজ বন্ধ করার অর্থ হলো এই ওয়াজিব কাজটি নিয়মিত শুরু করে দেয়া ।
পাপকাজটির মাধ্যমে যদি কেবল আল্লাহর কোনো অধিকার বা হক নষ্ট করা হয়ে থাকে (যেমন নামাজ না পড়া বা রামাদান মাসে রোজা না রাখা) সেক্ষেত্রে কেবল আল্লাহ্র কাছে তওবা করাই যথেষ্ট । এব্যাপারে অন্য কাউকে কিছু বলার নেই, ব্যাপারটি বান্দা এবং আল্লাহ্র মাঝে সীমাবদ্ধ । বরঞ্চ এক্ষেত্রে মানুষকে গুনাহ্র ব্যাপারে জানানোটা নিষেধ । নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি হাদীসে বলেছেন:-
“আমার উম্মতের প্রত্যেকেই ক্ষমাযোগ্য একমাত্র মুজাহিররা ব্যতীত ।” [১] মুজাহিরের ব্যাখায় হাদীসটিতে বলা হয়েছে: “একটি গুনাহ করে সেটি মানুষকে বলে বেড়ানো যে আমি এটা এটা করেছি ।”
অপরদিকে পাপকাজটি যদি হয়ে থাকে এমন যাতে অপর কোনো বান্দার হক নষ্ট হয়েছে; সেক্ষেত্রে কেবল তাওবা করাই যথেষ্ট নয় বরঞ্চ ওই বান্দার যে হকটি নষ্ট করা হয়েছে সেটি ফিরিয়ে দিতে হবে । এরকম কাজের মধ্যে রয়েছে– টাকা আত্মসাৎ করা, গীবত করা অথবা মারধোর করা বা গালি দেয়া প্রভৃতি । নষ্ট হকটি কী প্রকারে ফিরিয়ে দিতে হবে সে ব্যাপারে কথা বেশ লম্বা । আমরা পরবর্তী কোনো লেখায় সেই আলোচনাতে যাব ।
৪. পরবর্তীতে সেই কাজে ফিরে না যাবার সংকল্প
তাওবা খাঁটি হতে হলে পাপী ব্যক্তির মাঝে দৃঢ় সংকল্প থাকতে হবে যে সে এই কাজ আর করবে না বা এই অপরাধে আর প্রত্যাবর্তন করবে না । ধরুন কোনো ব্যক্তি একসময় ধনী ছিল । সে তার ধনদৌলত দিয়ে মদ খেত, জুয়া খেলত বা এমনকী ব্যভিচার করত (আল্লাহ্র কাছে পরিত্রাণ চাইছি এসব থেকে) । অতঃপর সহসা সে নিঃস্ব হয়ে গেল । সে তার পূর্বেকার পাপাচারে ফিরে যেতে পারছে না পয়সার অভাবে । এই অবস্থার সুযোগ নিয়ে সে আল্লাহ্র কাছে তাওবা করলো কিন্তু সম্পদ না হারালে সে ঠিকই সেসব পাপাচার অব্যাহত রাখত । এই তাওবা তার কখনোই কবুল করা হবে না । তাওবা গ্রহণযোগ্য তখনই হবে যখন সে মনে মনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করবে সেই কাজটি ভবিষ্যতে না করার, কাজটি করার সুযোগ তার থাকুক আর নাই থাকুক ।
৫. সময়মতো তাওবা করা
তাওবা করার নির্দিষ্ট সময় রয়েছে । এই সময় পার হয়ে গেলে তাওবা আর কবুল হবে না । এই নির্দিষ্ট সময়কে আবার দুই ভাগে ভাগ করা যায় ।
ক) ব্যক্তিগত সময় ও
খ) সার্বজনীন সময় ।
ক) ব্যক্তিগত সময়:- ব্যক্তিগত সময় প্রতিটি ব্যক্তির জন্য আলাদা করে প্রযোজ্য । আর এসময়টি হলো যখন মৃত্যু অবধারিত ভাবে উপস্থিত হয় । আল্লাহ বলেন:
“তাওবা তাদের জন্য নয় যারা মন্দ কাজ অব্যাহত রাখে সেই পর্যন্ত যখন মৃত্যু এসে হাজির হয় আর তারা তখন বলে আমি এখন তাওবা করলাম।”[২] অতএব মৃত্যু যখন নিশ্চিতরূপে উপস্থিত তখনকার তওবা উপায়ান্তর না দেখে করা তাওবা, এটি আল্লাহ্র কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।
খ) সার্বজনীন সময়: এই সময় যখন এসে উপনীত হবে তখন আর কারও তাওবাই গ্রহণীয় হবে না । সময়টি আমরা পাই নবীজী (ﷺ ) এর একটি হাদীসে: “হিজরত ততদিন পর্যন্ত বন্ধ হবে না যতদিন তাওবা বন্ধ না হয়, আর তাওবা ততদিন পর্যন্ত বন্ধ হবে না যতদিন না সূর্য পশ্চিম দিক থেকে উদীত হচ্ছে ।” [৩] শেষ সময়ের যে বড় চিহ্নগুলো উল্লেখ করা হয়েছে কুরআন বা হাদীসে তার একটি সূর্য পশ্চিম দিক থেকে ওঠা । ওপরের হাদীসটি থেকে আমরা জানতে পারি যে এই ঘটনা যখন ঘটে যাবে তখন ছেলে-বুড়ো, নারী-পুরুষ কারও তাওবাই আর গৃহীত হবার নয় । কুরআনেও এই ঘটনার ইশারা পাওয়া যায়: “যেদিন তোমার রবের কিছু চিহ্ন এসে উপনীত হবে (তখন) কোনো সত্তাই তার ঈমান দিয়ে আর উপকৃত হবে না যদি সে আগেই ঈমান না এনে থাকে।
Comments
Post a Comment