এসো হাদীস শিখিঃ- ৭টি অভ্যাস ভয়ংকর, ত্যাগ কর অতি সত্তর।

দরসুল হাদীস- ৭টি অভ্যাস ভয়ংকর, ত্যাগ কর অতি সত্তর
****************************************************
নবিজীর হাদীস,
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ ، عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ : إِيَّاكُمْ وَالظَّنَّ فَإِنَّ الظَّنَّ أَكْذَبُ الْحَدِيثِ ، وَلاَ تَحَسَّسُوا ، وَلاَ تَجَسَّسُوا ،وَلاَ تَنَاجَشُوْا، وَلاَ تَحَاسَدُوا ، وَلاَ تَبَاغَضُوا، وَلاَ تَدَابَرُوا ، وَكُونُوا عِبَادَ اللهِ إِخْوَانًا.,,,
অনুবাদ:-
হযরত আবু হুরায়রাহ (রা.) রাসূল (সা.) থেকে বর্ণনা করেন, রাসূল (সা.) বলেছেন, সাবধান! কুধারণা করো না, কারণ কুধারণা হচ্ছে সবচেয়ে বড় মিথ্যাচার। গোয়েন্দাগিরি করো না, দোষ খুজে বেড়িও না, দর-দালালী করো না, হিংসা-বিদ্বেষ রেখো না, গীবত কভূ করো না, পিছনে লেগে থেকো না, প্রত্যেকে আল্লাহর বান্দা ও পরস্পর ভাই ভাই হয়ে যাও। (সহীহ আল-বুখারী ও মুসলিম)।

রাবী পরিচিতিঃ-
নাম ও পরিচিতি: প্রসিদ্ধ মতে ইসলাম গ্রহণের পূর্বে হযরত আবু হুরায়রা (রা.) এর নাম ছিল আবদুশ্ শামস বা আবদে উমর। ইসলাম গ্রহণের পর তাঁর নাম রাখা হয় আবদুর রহমান। তিনি দক্ষিণ আরবের আযদ গোত্রের সুলায়ম ইবন ফাহাম বংশোদ্ভূত ছিলেন। তাঁর পিতার নাম সাখর এবং মাতার নাম উম্মিয়া বিনতে সফীহ মতান্তরে মায়মুনা। তিনি হিজরতের পূর্বে জন্মগ্রহণ করেন। বিড়াল ছানার প্রতি তাঁর আসক্ততার কারণে রাসূল (সা.) তাকে “আবূ হুরায়রা” (أبو هريرة‎) তথা বিড়াল ছানার মালিক বা পিতা উপনামে ডাকতেন। এ উপনামেই তিনি অধিক পরিচিত।

ইসলাম গ্রহণঃ-
তিনি ৬২৯ খ্রিস্টাব্দ মোতাবেক ৭ম হিজরীতে মুর্হরম মাসে খায়বর যুদ্ধের প্রাক্কালে মদীনায় ইসলাম গ্রহণ করেন। তখন তাঁর বয়স হয়েছিল ত্রিশ বছর।

যুদ্ধে অংশগ্রহণঃ- ইসলাম গ্রহণের পর হতে তিনি রাসূল (সা.) এ সাথে ইসলামের সকল যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন।

হাদীস শাস্ত্রে অবদানঃ-
সাহাবীদের মাঝে তিনিই সর্বাধিক হাদীস বর্ণনাকারী। তাঁর বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা মোট ৫৩৭৪টি। ইমাম বুখারীর মতে, আট শতাধিক রাবী তাঁর থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন। এ কারনে তাঁকে রাবীদের নেতা বলা হয়। তিনি ‘আসহাবে সুফ্ফা’র অন্তর্ভূক্ত ছিলেন।
ইন্তেকাল: ৫৭ মতান্তরে ৫৮/৫৯ হিজরীতে তিনি ইন্তেকাল করেন। তাকে জান্নাতুল বাকী’তে দাফন করা হয়।

হাদীসের ব্যাখ্যাঃ-
অত্র হাদীসে রাসূল (সা.) ৭টি ঈমান ধ্বংসকারী কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী আমল পরিত্যাগ করতে বলেছেন, যে আমলগুলো পরিত্যাগ করা একজন মুমিন-মুসলমানের জন্য অপরিহার্য। যার বর্ণনা নিম্নে প্রদত্ত হলোঃ
১নং অভ্যাস:
إِيَّاكُمْ وَالظَّنَّ فَإِنَّ الظَّنَّ أَكْذَبُ الْحَدِيثِ “
সাবধান! কুধারণা করো না, কারণ কুধারণা হচ্ছে সবচেয়ে বড় মিথ্যাচার।”
আল-কুরআনে উপরোক্ত গুনটির সাথে সাথে আরো ২টি খারাপ অভ্যাস থেকে বিরত থাকতে মুমিনদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে-
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اجْتَنِبُوا كَثِيرًا مِنَ الظَّنِّ إِنَّ بَعْضَ الظَّنِّ إِثْمٌ وَلَا تَجَسَّسُوا وَلَا يَغْتَبْ بَعْضُكُمْ بَعْضًا أَيُحِبُّ أَحَدُكُمْ أَنْ يَأْكُلَ لَحْمَ أَخِيهِ مَيْتًا فَكَرِهْتُمُوهُ وَاتَّقُوا اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ تَوَّابٌ رَحِيمٌ,,,
অর্থঃ-
হে মু’মিনগণ, তোমরা অধিক অনুমান থেকে দূরে থাক। নিশ্চয় কোন কোন অনুমান তো পাপ। আর তোমরা গোপন বিষয় অনুসন্ধান করো না এবং একে অপরের গীবত করো না। তোমাদের মধ্যে কি কেউ তার মৃত ভাইয়ের গোশ্ত খেতে পছন্দ করবে? তোমরা তো তা অপছন্দই করে থাক। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ অধিক তাওবা কবুলকারী, অসীম দয়ালু। (সূরা হুজুরাত-১২)।

তবে বাদী-বিবাদীর বক্তব্য অনুযায়ী ধারণার বশবর্তী হয়ে মামলা-মুকাদ্দামার রায় প্রদান করলে বিচারক দায়ি হবে না। যেমন হাদীসে উল্লেখিত আছে-
أَنَّ أُمَّ سَلَمَةَ زَوْجَ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم أَخْبَرَتْهَا عَنْ رَسُولِ اللهِ صلى الله عليه وسلم أَنَّهُ سَمِعَ خُصُومَةً بِبَابِ حُجْرَتِهِ فَخَرَجَ إِلَيْهِمْ فَقَالَ إِنَّمَا أَنَا بَشَرٌ وَإِنَّهُ يَأْتِينِي الْخَصْمُ فَلَعَلَّ بَعْضَكُمْ أَنْ يَكُونَ أَبْلَغَ مِنْ بَعْضٍ فَأَحْسِبُ أَنَّهُ صَادِقٌ فَأَقْضِي لَهُ بِذَلِكَ فَمَنْ قَضَيْتُ لَهُ بِحَقِّ مُسْلِمٍ فَإِنَّمَا هِيَ قِطْعَةٌ مِنَ النَّارِ فَلْيَأْخُذْهَا ، أَوْ لِيَتْرُكْهَا,,,
অর্থঃ-
 নবী (সা.) এর স্ত্রী উম্মে সালামা (রা.) রাসূল (সা.) থেকে বর্ণনা করেন, একদিন তিনি তার কামরার দরজার নিকট ঝগড়া শুনতে পেয়ে তাদের নিকট চলে আসেন (তার নিকট মামলা পেশ করেন) তিনি (রাসূল (সা.)) বলেন, আমি একজন মানুষ, আমার কাছে বিবাদকারীরা আসে তাদের মধ্যে হয়ত কেউ অন্যের চেয়ে বাকপটু তখন আমি মনে করি সে সত্য বলেছে, তদনুযায়ী আমি তার পক্ষ্যে রায় দেই। সুতরাং বিচারে যদি আমি অপরের হক তাকে দিয়ে দেই, তবে তা দোযখের একটা টুকরো। এখন ইচ্ছা হলে সে এটা গ্রহন করুক বা ত্যাগ করুক। (সহীহ আল-বুখারী)

২নং অভ্যাস:
وَلاَ تَحَسَّسُوا “
গোয়েন্দাগিরি করো না।”
গোপনে কারো দোষ অনুসন্ধানে লিপ্ত হওয়াকে গোয়েন্দাগিরি বলে। এমনকি গোপনে কারো চিঠি পড়া, কারো ঘরে উকি দেওয়া, ইচ্ছাকৃতভাবে আল্লাহ কর্তৃক নিষেধকৃত বস্তু বা বিষয়ের দিকে দৃষ্টি দেওয়াও গোয়েন্দাগিরির মধ্যে পড়ে। এটি একটি মারাত্বক নৈতিকতা বিরোধী অপরাধ এবং এটি যুলুমের পর্যায় পড়ে। (তবে রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গোয়েন্দাগিরির বিষয়টা ভিন্ন)
রাসূল (সা.) অন্যের উপরে যুলুম করা থেকে বিরত থাকতে নির্দেশ দিয়ে বলেছেন-
: الْمُسْلِمُ أَخُو الْمُسْلِمِ لاَ يَظْلِمُهُ ، وَلاَ يُسْلِمُهُ ، وَمَنْ كَانَ فِي حَاجَةِ أَخِيهِ كَانَ اللَّهُ فِي حَاجَتِهِ ، وَمَنْ فَرَّجَ عَنْ مُسْلِمٍ كُرْبَةً فَرَّجَ اللَّهُ عَنْهُ كُرْبَةً مِنْ كُرُبَاتِ يَوْمِ الْقِيَامَةِ ، وَمَنْ سَتَرَ مُسْلِمًا سَتَرَهُ اللَّهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ.,,
অর্থঃ-
এক মুসলমান অন্য মুসলমানের ভাই। সে তার উপরে যুলুম-অত্যাচার করতে পারে না, তার নিরাপত্তা বিঘ্নিত বা ক্ষতি করতে পারে না, যে তার মুসলিম ভাইয়ের প্রয়োজন পুরণে সচেষ্ট হয়, আল্লাহ তার প্রয়োজন পুরণ করে দেন। যে ব্যক্তি কোন মুসলমানের দুঃখ-কষ্ট দূরীকরণে সহায়তা করে, আল্লাহ কিয়ামতের দিন তার দুঃখ কষ্ট দূর করে দেবেন। যে ব্যক্তি কোন মুসলমানের দোষ-ত্রুটি গোপন রাখে কিয়ামতের দিন আল্লাহ তার দোষ-ত্রুটি গোপন রাখবেন। (সহীহ আল-বুখারী)।

৩নং অভ্যাস:
وَلاَ تَجَسَّسُوا “
দোষ খুজে বেড়িও না।”
একজন মুমিন অন্য মুমিনের দোষ অন্নেষণ করবে না। এটা মস্ত বড় অপরাধ। মুমিনের দায়িত্বই হচ্ছে অন্য কোন মুমিন বা মুসলিমের দোষ প্রকাশ হলে অথবা তার দৃষ্টিগোচর হলে তাকে সংশোধন করে দেওয়া। রাসূল (সা.) যেমন বলেছেন-
“এক মুসলমান আরেক মুসলামনের আয়নাস্বরূপ।”
অতএব, গোপনে সমালোচনা নয়, বরং সংগোপনে সংশোধন করে দেওয়াই মুসলমানদের পারস্পারিক দায়িত্ব এবং কর্তব্য।”
অপরের মুসলমানদের দোষ-ত্রুটি গোপন রাখার ব্যাপারে রাসূল (সা.) আরো তাকিদ দিয়েছেন,
عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ ، عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى الله عَليْهِ وسَلَّمَ قَالَ : مَنْ سَتَرَ عَوْرَةَ أَخِيهِ الْمُسْلِمِ ، سَتَرَ اللَّهُ عَوْرَتَهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ ، وَمَنْ كَشَفَ عَوْرَةَ أَخِيهِ الْمُسْلِمِ ، كَشَفَ اللَّهُ عَوْرَتَهُ ،,,
অর্থঃ-
 হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) নবী (সা.) হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, যে ব্যক্তি তার কোন মুসলিম ভাইয়ের দোষ গোপন রাখবেন আল্লাহ কিয়ামতের দিন তার দোষ গোপন রাখবেন। আর ব্যক্তি তার কোন মুসলিম ভাইয়ের দোষ প্রকাশ করবেন আল্লাহ কিয়ামতের দিন তার দোষ প্রকাশ করবেন। (সূনান ইবনে মাজা)
অন্য হাদীসে বর্ণিত হয়েছে-
"مَنْ عَلِمَ مِنْ أَخِيهِ سَيِّئَةً فَسَتَرَهَا عَلَيْهِ سَتَرَ اللَّهُ عَلَيْهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ".
অর্থঃ- যে ব্যক্তি কোন ভাইয়ের দোষ-ত্রুটি জানার পরেও তা গোপন রাখে আল্লাহ কিয়ামতের দিন তার দোষ-ত্রুটি গোপন রাখবেন। (সূনান আল-কুবরা লিত-তাবরানী)

৪নং অভ্যাস:
وَلاَ تَنَاجَشُوْا “
দর-দালালী করো না।”
এখানে দর-দালালী বলতে ব্যবসায় প্রতারণা বোঝানো হয়েছে। ব্যবসায় প্রতারণা করে বেশী লাভ করা যেমন হারাম ঠিক তেমনি পন্যের দোষ লুকিয়ে বিক্রি করাও ইসলামে হারাম করা হয়েছে। রাসূল (সা.) এর একটি হাদীসের মাধ্যমে এটা পরিস্কার হয়ে ওঠে।
عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- مَرَّ عَلَى صُبْرَةٍ مِنْ طَعَامٍ فَأَدْخَلَ يَدَهُ فِيهَا فَنَالَتْ أَصَابِعُهُ بَلَلاً فَقَالَ ্র يَا صَاحِبَ الطَّعَامِ مَا هَذَا গ্ধ. قَالَ أَصَابَتْهُ السَّمَاءُ يَا رَسُولَ اللَّهِ. قَالَ أَفَلاَ جَعَلْتَهُ فَوْقَ الطَّعَامِ حَتَّى يَرَاهُ النَّاسُ গ্ধ. ثُمَّ قَالَ مَنْ غَشَّ فَلَيْسَ مِنَّا গ্ধ.
অর্থ: একদা রাসূল (সা.) এক পশলা বৃষ্টির পরে বাজারে (মদীনার বাজারে) খুরতে বের হলেন, সেখানে এক খাদ্য বিক্রেতাকে দেখলেন তার খাদ্যের উপরে বৃষ্টির কোন নমূনা ছিলোনা না, তখন রাসূল (সা.) তার মধ্যে হাত ঢুকালেন এবং বৃষ্টি ভেজা খাদ্য বের করে আনলেন এরপর বিক্রেতাকে বললেন এটা কি? তিনি বললেন, এটা বৃষ্টির ছাট লাগা। রাসূল (সা.) বললেন, তুমি এটা উপরে রাখলে না কেন তাহলে মানুষ এটা দেখতে পেত? অতঃপর রাসূল (সা.) বললেন, যে প্রতারনা করে সে আমার উম্মত নাই। (মুসলিম ও তিরমিযি)
অন্য হাদীসে ধোকা-প্রতারণা থেকে বিরত থাকার ব্যাপারে রাসূল (সা.) বলেছেন-
قال أنس بن مالك : قال لي رسول الله صلى الله عليه و سلم يا بني إن قدرت أن تصبح وتمسي وليس في قلبك غش لأحد فافعل ثم قال لي يا بني وذلك من سنتي ومن أحيا سنتي فقد أحبني ومن أحبني كان معي في الجنة
অর্থঃ-
হযরত আনাস ইবনে মালিক (রা.) বলেন, রাসূল (সা.) আমাকে বললেন, বেটা যদি সম্ভব হয় এভাবে জীবন-যাপন করবে যে, সকাল-সন্ধ্যায় কখনো তোমার অন্তরে কারো প্রতি কোন ধোকা-প্রতারণা বা অমঙ্গল কামনা থাকবে না। অতঃপর তিনি বললেন, বেটা, এটা আমার অন্যতম সুন্নত। আর যে আমার সুন্নতকে পুনরুজ্জিবিত করবে সে আমাকেই ভালবাসবে। আর যে আমাকে ভালবাসবে সে আমার সাথে জান্নাতে যাবে। (সূনান আত-তিরমিযি)

৫নং অভ্যাস:
وَلاَ تَحَاسَدُوا “
হিংসা-বিদ্বেষ রেখো না।”
আমাদের সমাজে একজন আরেকজনের বৈসয়িক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, মর্জাদাগত ইত্যাদি বিষয়ে উন্নতি, প্রগতি দেখলে হিংসায় জ্বলে মরে, অথচ ইসলাম নির্দেশ দেয় অন্যের উন্নতি এবং কল্যাণ কামনা। যেমন- রাসূল (সা.) বলেছেন-
الدِّينُ النَّصِيحَةُ لِلَّهِ وَلِرَسُولِهِ وَلأَئِمَّةِ الْمُسْلِمِينَ وَعَامَّتِهِمْ.
“দ্বীন হচ্ছে কল্যাণ কামনা। আল্লাহর জন্য, তাঁর রাসূল (সা.) এর জন্য, মুসলিম শাসক এবং সকল মুসলমানের জন্য।” (সহীহ আল-বুখারী)
হিংসা-বিদ্বেষ নেক আমলকে ধ্বংস করে। যেমন রাসূল (সা.) বলেছেন-
عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ أَنَّ النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم قَالَ إِيَّاكُمْ وَالْحَسَدَ فَإِنَّ الْحَسَدَ يَأْكُلُ الْحَسَنَاتِ كَمَا تَأْكُلُ النَّارُ الْحَطَبَ,,,
অর্থঃ-
সাবধান! তোমরা হিংসা থেকে বেঁচে থাক! কারণ হিংসা নেক আমলকে তেমন করে খেয় ফেলে যেমন করে আগুন কাঠকে খেয়ে ফেলে। (সূনান আবু দাউদ)

৬নং অভ্যাস:
وَلاَ تَبَاغَضُوا “
গীবত কভূ করো না।”
গিবতের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে আল্লাহর রাসূল (সা.) বলেছেন-
عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ أَنَ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ ্র أَتَدْرُونَ مَا الْغِيبَةُ গ্ধ. قَالُوا اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَعْلَمُ. قَالَ ্র ذِكْرُكَ أَخَاكَ بِمَا يَكْرَهُ গ্ধ. قِيلَ أَفَرَأَيْتَ إِنْ كَانَ فِى أَخِى مَا أَقُولُ قَالَ ্র إِنْ كَانَ فِيهِ مَا تَقُولُ فَقَدِ اغْتَبْتَهُ وَإِنْ لَمْ يَكُنْ فِيهِ فَقَدْ بَهَتَّهُ
অর্থঃ-
 রাসূল (সা.) বলেছেন, তোমরা কি জান গিবত কী? সাবাহীগণ বললেন, আল্লাহ এবং তার রাসূল এ সম্পর্কে ভালো জানেন। রাসূল (সা.) বললেন, তোমার ভাই (মুসলিম) সম্পর্কে তাই বলা যা সে অপছন্দ করে। তিনি জিজ্ঞাসিত হলেন, আমি যদি দেখি আমার ভাইয়ের মধ্যে সেই দোষ আছে তাহলেও কি আমি বলতে পারব না? রাসূল (সা.) বললেন, যদি তার মধ্যে সেই দোষ থাকে যা তুমি বলছো তাই গিবত। আর তার মধ্যে যদি তা না থাকে তাহলে সেটা হবে অপবাদ। (সহীহ মুসলিম)।

তবে আমাদের মনে রাখতে হবে ক্ষেত্র বিশেষে অনেক সময় গিতব অপরিহার্য হয়ে পড়ে। যেমন-
১. একজন মুসলমান নবী (সা.) এর পিছনে নামাযে শামিল হলো, নামায শেষ হওয়া মাত্রই সে এই বলে প্রস্থান করলো, হে আল্লাহ আমার এবং মুহাম্মদ (সা.) এর উপর রহম কর। আমাদের দু’জন ছাড়া আর কাউকে এ রহমতের মধ্যে শামিল করো না। রাসূল (সা.) সাহাবীদের বললেন, তোমরা কি বল? এই লোকটাই বেশী বেকুফ না এর উট? তোমরা কি শোননি সে কি বললো। (সূনান আবু দাউদ)
সালাম ফিরানো মাত্রই লোকটি চলে গিয়েছিলো এবং রাসূল (সা.) তার অনুপস্থিতিতেই কথাটি বলেছিলেন। ব্যক্তি একটি ভুল কথা বলে ফেলেছিল তাই এ ব্যাপারে তাঁর চুপ থাকা কাউকে বিভ্রান্তিতে ফেলতে পারে যে, এরূপ কথা যায়েয। তাই একথার তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ করা জরুরী ছিল।
২. ফাতিমা বিনতে কায়েস রাসূল (সা.) এর কাছে পরামর্শ চাইলেন, মুয়াবিয়া (রা.) ও আবু জাহম (রা.) তাকে বিবাহ করার প্রস্তাব দিয়েছে। রাসূল (সা.) বললেন, মুয়াবিয়া কৃপন আর আবু জাহম লাঠিয়াল (স্ত্রীদের পেটায়) (বুখারী ও মুসলিম)
এখানে একজন নারীর দাম্পত্য জীবনের প্রশ্ন ছিলো তাই নবী (সা.) উভয়ের দূর্বলতা ও দোষ-ত্রুটি জানিয়ে দেয়া জরুরী মনে করেন।
৩. একদিন নবী (সা.) হযরত আয়েশা (রা.) এর ঘরে ছিলেন। একব্যক্তি সাক্ষাতের অনুমতি প্রার্থনা করলে তিনি বলেন, এই ব্যক্তি তার গোত্রের মধ্যে অত্যন্ত নিকৃষ্ট। এরপর তিনি বাইরে গেলেন এবং তার সাথে সৌজন্য মুলক কথাবার্তা বললেন। তিনি ঘরে ফিরলে আয়েশা (রা.) বললেন, আপনি তো তার সাথে সদয় আচরণ করলেন অথচ যাওয়ার সময় বিরূপ মন্তব্য করেছিলেন। জবাবে রাসূল (সা.) বললেন, যে ব্যক্তির কটু বাক্য ও আচরণের কারনে লোকজন তার সাথে উঠা-বসা পরিত্যাগ করে, কিয়ামতের দিন সে আল্লাহর কাছে জঘন্যতম ব্যক্তি হবে। (বুখারী ও মুসলিম)
ঐ ব্যক্তির সম্পর্কে খারাপ ধারণা স্বত্ত্বেও নবী (সা.) তার সাথে সুন্দর আচরণ করেছেন এটা হচ্ছে উত্তম স্বভাবের দাবী।
আয়েশা (রা.) কে এ কথা বলার কারণ: হয়ত তার পরিবারের লোকেরা রাসূল (সা.) কে সদাচরণ করতে দেখে বন্ধু বলে মনে করতে পারেন। আর পরবর্তীতে কোন সুযোগে অবৈধ কোন সুবিধা অর্জন তার জন্য সহজ হতে পারে। তাই তিনি আয়েশা (রা.) কে সতর্ক করে দেন।
৪. একবার আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দা বিনতে উৎবা নবী (সা.) এর কাছে অভিযোগ করলো, আবু সুফিয়ান কৃপন সে আমার ও সন্তানদের প্রয়োজন পূরণে যথেষ্ঠ হতে পারে এমন অর্থ-কড়ি দেন না। (বুখারী ও মুসলিম)
স্বামীর অনুপস্থিতিতে স্ত্রীর এরূপ অভিযোগ গীবতের পর্যায়ে পড়ে, কিন্তু নবী (সা.) তা বৈধ করে দিয়েছেন। কারণ যুলুমের প্রতিকার করতে পারে এমন ব্যক্তির কাছে অভিযোগ নিয়ে যাওয়ার অধিকার মজলুমের আছে।

শরীয়তের দৃষ্টিতে সংগত গীবতঃ-
১. জুলুমের প্রতিকার করতে পারে এমন ব্যক্তির কাছে জালিমের বিরুদ্ধে মজলুমের ফরিয়াদ।
২. নেক নিয়্যতে সংশোধনের উদ্দেশ্যে।
৩. ফতোয়া চাওয়ার উদ্দেশ্যে জ্ঞানী আলেমের কাছে প্রকৃত ঘটনা বর্ণনার সময়।
৪. মানুষকে কোন ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের অপকর্মের ক্ষতি থেকে রক্ষা করার জন্য সাবধান করে দেওয়া।

গিবতের পরিণতিঃ-
গিবতের পরিণতি সম্পর্কে আল-হাদীসে বর্ণিত হয়েছে-
عن أبي أمامة قال : قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : ্র إن العبد ليعطى كتابه يوم القيامة منشورا ، فيريه فيه حسنات لم يعملها فيقول : رب ، لم أعمل هذه الحسنات فيقول : إنها كتبت باغتياب الناس إياك . وإن العبد ليعطى كتابه يوم القيامة منشورا ، فيقول : رب ، أعمل حسنة يوم كذا وكذا ؟ فيقال له : محيت عنك باغتيابك الناس গ্ধ
অর্থঃ-
 হযরত আবি উমামাতা (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (সা.) বলেছেন, বান্দার আমলনামা কিয়ামতের দিন তার সামনে খুলে ধরা হবে। সে দেখতে পাবে এমন সব নেক আমল যা সে করে নাই। তখন সে বলবে, হে আমার রব! “আমি তো এসব নেক আমল করি নাই” তখন আল্লাহ বলবেন, মানুষ তোমার গিবত করত তাই আমি লিখে দিয়েছি। (গিবতকারীদের নেক আমলগুলো তাদের আমলনামা থেকে তোমরা আমলনামায় লিখে দিয়েছি)
অনুরূপভাবে অন্য বান্দার আমলনামাও কিয়ামতের দিন তার সামনে খুলে ধরা হবে। তখন সে বলবে, হে আমার রব! আমি কি অমুক অমুক দিন অমুক অমুক নেক আমল করি নাই। (কই সে নেক আমলগুলো তো দেখতে পাচ্ছি না) তখন আল্লাহ তাকে বলবেন, তুমি যে মানুষকে গিবত করতে এজন্য তোমার আমলনামা থেকে সে আমলগুলো দিয়েছি। (জা’মিউল আহাদীসুল কুদসিয়া)।

৭নং অভ্যাস:
وَلاَ تَدَابَرُوا “
পিছনে লেগে থেকো না।”
পিছনে লেগে থাকার অর্থই হচ্ছে, কাউকে হেয় করা বা ছোট করা, করো মর্যাদাহানী করা, কারো ইজ্জত বা সম্মান নষ্ট করা ইত্যাদি। রাসূল (সা.) এ বিষয়ে সতর্ক দিয়ে করে বলেছেন,
الْمُسْلِمُ أَخُو الْمُسْلِمِ لاَ يَخُونُهُ وَلاَ يَكْذِبُهُ وَلاَ يَخْذُلُهُ كُلُّ الْمُسْلِمِ عَلَى الْمُسْلِمِ حَرَامٌ عِرْضُهُ وَمَالُهُ وَدَمُهُ التَّقْوَى هَا هُنَا,,,
অর্থঃ-
এক মুসলমান অন্য মুসলমানের ভাই। সে তাকে খিয়ানত করতে পারে না, তাকে মিথ্যুক বলতে পারে না, তাকে অপমান করতে পারে না, সকল মুসলমানের জন্য অন্য মুসলমানের উজ্জত-সম্মান, মাল-সম্পদ ও রক্ত হারাম। আর তাকওয়া এখানে। (রাসূল (সা.) বুকের দিকে ইশারা করলেন) (সূনান আত-তিরমিযি)
কারো পিছনে লেগে থাকা, কারো ছিদ্রান্নেষণ করা ইসলামে সম্পূর্ণ নিষেধ করা হয়েছে। কারণ কারো পিছনে লেগে থাকলে, কারো ছিদ্রান্নেষণ করতে থাকলে মানুষের সাথে মানুষের পারস্পারিক সম্পর্ক নষ্ট হয়, ঝগড়া-বিবাদ, সামাজিক বিপর্জয় এবং ভ্রাতৃত্ব বন্ধন ছিন্ন হয়, বিধায় রাসূল (সা.) ঝগড়া-বিবাদকে সবচেয়ে ঘৃণিত কাজ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। আল-হাদীসে বর্ণিত হয়েছে-
عَنْ عَائِشَةَ ، رَضِيَ اللَّهُ عَنْهَا ، عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ : إِنَّ أَبْغَضَ الرِّجَالِ إِلَى اللهِ الأَلَدُّ الْخَصِمُ.
অর্থঃ-
আল্লাহর নিকট সেই সর্বাধিক ঘৃণিত যে অত্যন্ত ঝগড়াটে। (সহীহ আল বুখারী)

করণীয়:
হাদীসের উপসংহারে নির্দেশিত হয়েছে وَكُونُوا عِبَادَ اللهِ إِخْوَانًا. “প্রত্যেকে আল্লাহর বান্দা ও পরস্পর ভাই ভাই হয়ে যাও।”
এ ব্যাপারে আল-কুরআনে বর্ণিত হয়েছে-
إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ إِخْوَةٌ فَأَصْلِحُوا بَيْنَ أَخَوَيْكُمْ
অর্থ: নিশ্চয় মুমিনরা পরস্পর ভাই ভাই। কাজেই তোমরা তোমাদের ভাইদের মধ্যে আপোষ-মীমাংসা করে দাও। (সূরা হুজুরাত-১০)
আল-কুরআনে অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে-
وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللَّهِ جَمِيعًا وَلَا تَفَرَّقُوا وَاذْكُرُوا نِعْمَتَ اللَّهِ عَلَيْكُمْ إِذْ كُنْتُمْ أَعْدَاءً فَأَلَّفَ بَيْنَ قُلُوبِكُمْ فَأَصْبَحْتُمْ بِنِعْمَتِهِ إِخْوَانًا وَكُنْتُمْ عَلَى شَفَا حُفْرَةٍ مِنَ النَّارِ فَأَنْقَذَكُمْ مِنْهَا كَذَلِكَ يُبَيِّنُ اللَّهُ لَكُمْ آيَاتِهِ لَعَلَّكُمْ تَهْتَدُونَ,,,
অর্থ: আর তোমরা সকলে আল্ল¬াহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে ধারণ কর এবং বিভক্ত হয়ো না। আর তোমরা তোমাদের উপর আল্লাহর নিয়ামতকে স্মরণ কর, যখন তোমরা পরস্পরে শত্রু ছিলে। তারপর আল্লাহ তোমাদের অন্তরে ভালবাসার সঞ্চার করেছেন। অতঃপর তাঁর অনুগ্রহে তোমরা ভাই-ভাই হয়ে গেল। আর তোমরা ছিলে আগুনের গর্তের কিনারায়, অতঃপর তিনি তোমাদেরকে তা থেকে রক্ষা করেছেন। এভাবেই আল্লাহ তোমাদের জন্য তাঁর আয়াতসমূহ বয়ান করেন, যাতে তোমরা হিদায়াতপ্রাপ্ত হও। (সূরা আলে-ইমরান- ১০৩)
আল-হাদীস ও আল-কুরআনের আয়াতদ্বয়ের শিক্ষাই হচ্ছে মুসলমানগণ সব সময় ভাই-ভাই হয়ে জীবন-যাপন করবে। একজনের বিপদ-আপদে আরেকজন এগিয়ে আসবে, সবাই মিলে মিশে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে জীবন পরিচালনা করবে।

পরিশেষে বলা যায়, উপরোক্ত ৭টি অভ্যাস ইসলামী নৈতিকতা পরিপন্থি যা মুসলমানদের ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজ জীবনের আদর্শিক সম্পর্ক ও বন্ধন নষ্ট করে তাই প্রত্যেক মুসলমানের এগুলো পরিত্যাগ করতে হবে এবং এর বিপরিতে নৈতিকতাপূর্ণ মানব কল্যান মূলক কাজের অভ্যাস গড়ে তোলার মাধ্যমে সমাজের মানুষের কাছে ইসলামের সুমহান আদর্শের সৌন্দর্য পৌঁছে দিতে হবে।

Comments