দুরসুল হাদীস- “জান্নাত লাভের ৬টি আমলঃ-
*********************************
নবিজী এরশাদ করেছেন,
عَنْ عُبَادَةَ بْنِ الصَّامِتِ أَنَّ النَّبِيَّ -صلى الله عليه وسلم- قَالَ اضْمَنُوا لِي سِتًّا مِنْ أَنْفُسِكُمْ أَضْمَنْ لَكُمُ الْجَنَّةَ اصْدُقُوا إِذَا حَدَّثْتُمْ ، وَأَوْفُوا إِذَا وَعَدْتُمْ وَأَدُّوا إِذَا ائْتُمِنْتُمْ وَاحْفَظُوا فُرُوجَكُمْ ، وَغُضُّوا أَبْصَارَكُمْ ، وَكُفُّوا أَيْدِيَكُمْ,,,
অনুবাদঃ-
হযরত উবাদাতা ইবনে সামিত (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেছেন, তোমরা যদি তোমাদের পক্ষ থেকে ৬টি বিষয়ে জামিনদার হও তাহলে আমিও তোমাদের জন্য জান্নাতের জামিনদার হব। তাহলোঃ
১. যখন তোমরা কথা বলবে সত্য বলবে,
২. ওয়াদা করে তা পূর্ণ করবে,
৩. আমানত রাখা হলে তা যথাযথভাবে ফেরত দিবে,
৪. নিজেদের লজ্জাস্থান সমূহের হেফাজত করবে,
৫. তোমাদের দৃষ্টিকে অবনমীত রাখবে এবং
৬. নিজেদের হাত দু’টিকে নিয়ন্ত্রনে রাখবে।
(মুসনাদে আহমদ)
রাবী পরিচিতিঃ-
উবাদাতা ইবনে সামিত (রা.) এর ডাকনাম ছিলো আবুল ওয়ালিদ। পিতার নাম সামেত ইবনে কায়েস, মাতার নাম র্কুরাতুল আইন। মদীনার খাজরাজ বংশের সালেম গোত্রের মানুষ। তিনি আনসার সাহাবী ছিলেন।
বৈশিষ্ট্য সমূহঃ-
তিনি সাহাবীদের মধ্যে ২টি বিষয়ে সৌভাগ্যের অধিকারী।
১. আকাবার ১ম শপথে অংশগ্রহনকারী,
২. বদরে অংশগ্রহনকারী ও বায়াতে রেদওয়ানের সময় রাসূল (সা.) হাতে বাইয়াত গ্রহনকারী। তিনি ছিলেন আল-কুরআনের হাফেজ, বিশুদ্ধ তিলাওয়াতকারী এবং আসহাবে সুফ্ফার সুপারেনটেনডেন্ট ও শিক্ষক।
বর্ণিত হাদীসঃ-
তাঁর বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা ১৮১টি, তারমধ্যে ৬টি হাদীস বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে।
ইন্তেকালঃ-
হিজরী ৩৪ সনে ৭২বছর বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেন।
হাদীসের ব্যাখ্যাঃ-
اضْمَنُوا لِى سِتًّا مِنْ أَنْفُسِكُمْ أَضْمَنُ لَكُمُ الْجَنَّةَ,,,
এ হাদীসের শুরুতে রাসূল (সা.) সাহাবীদের বললেন, তোমরা যদি তোমাদের পক্ষ থেকে ৬টি বিষয়ে জামিনদার হও তাহলে আমিও তোমাদের জন্য জান্নাতের জামিনদার হব। অর্থাৎ কোন ব্যক্তি যদি উক্ত হাদীসে উল্লেখিত ৬টি আমল সঠিকভাবে করতে পারে তাহলে রাসূল (সা.) তাদের জন্য জান্নাত পাওয়ার ব্যাপারে আল্লাহর কাছে জামিনদার হবেন। এর অর্থই হচ্ছে এ বৈশিষ্ট্যের অধিকারীর জন্য জান্নাত অবধারিত হবে। সে ৬টি আমল হচ্ছে-
১. اصْدُقُوا إِذَا حَدَّثْتُمْ “যখন কথা বলবে সত্য বলবে।”
হক কথা বলা, হকের পথে থাকা একটি গুরুত্বপূর্ণ নেক আমল। কারণ হক কাজ, হক কথা মানুষের মনে প্রশান্তি এনে দেয়। এ সম্পর্কে রাসূল (সা.) বলেন-
فَإِنَّ الصَّدَقَ طُمَأْنِينَةٌ ، وَإِنَّ الْكَذِبَ رِيبَةٌ,,,,
“সত্য দেয় মনের শান্তি আর মিথ্যা দেয় সংশয়।” (সুনান আত-তিরমিযি)।
অন্য হাদীসে বর্ণিত হয়েছে-
إِنَّ الصِّدْقَ يَهْدِي إِلَى الْبِرِّ وَإِنَّ الْبِرَّ يَهْدِي إِلَى الْجَنَّةِ,,,
“নিশ্চয় সত্য ভালো বা নৈতিকতার দিকে নিয়ে যায় আর নৈতিকতা জান্নাতের দিকে নিয়ে যায়।” (সহীহ আল-বুখারী)।
মানুষ কথা বলে জিহব্বার মাধ্যমে, জিহব্বা আকার-আয়াতনে অনেক ছোট হলেও এর ক্ষমতা অত্যন্ত বেশী। এটি মানুষকে অধঃপতনের অতল গহব্বরে নিক্ষেপ করতে পারে আবার সাফল্যের উচ্চ শিখরেও সমাসীন করতে পারে। এ জন্য রাসূল (সা.) বলেছেন-
وَإِنَّهُ لَيَزِلُّ عَنْ لِسَانِهِ أَشَدَّ مِمَّا يَزِلُّ مِنْ قَدَمِهِ,,,
“নিঃসন্দেহে বান্দার পা পিছলানোর চেয়ে মুখ পিছলানো অধিকতর ক্ষতিকর।” (বায়হাকী, শুয়াবুল ঈমান)
আল-হাদীসে আরো বর্ণিত হয়েছে-
عَنْ عُقْبَةَ بْنِ عَامِرٍ، قَالَ: قُلْتُ: يَا نَبِيَّ اللهِ مَا النَّجَاةُ ؟، قَالَ: " أَمْلِكْ عَلَيْكَ لِسَانَكَ، وَلْيَسَعْكَ بَيْتُكَ، وَلْتَبْكِ عَلَى خَطِيئَتِكَ"
“হযরত উকবা ইবনে আমের (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি রাসূল (সা.) কে জিজ্ঞেস করলাম হে আল্লাহর নবী মুক্তির উপায় কি? রাসূল (সা.) বললেন,
১. তুমি জিহবাকে আয়াত্তে রাখো,
২. নিজের ঘরে পড়ে থাকো এবং
৩. পাপের জন্য কাদো।” (তিরমিযি ও মুসনাদে আহমদ)।
অন্য আল-হাদীসে বর্ণিত হয়েছে-
عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ، أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: " مَنْ خَزَنَ لِسَانَهُ سَتَرَ اللهُ عَوْرَتَهُ “
হযরত আনাস ইবনে মালিক থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি স্বীয় জিহবাকে সংযত রাখবে কিয়ামতের দিন আল্লাহ তার দোষ-ত্রুটির উপরে আবরণ ফেলে দিবেন।” (বায়হাকী, শুয়াবুল ঈমান)
জিহবা সংযত রাখার অর্থই হচ্ছে ঝগড়া-বিবাদ, অশ্লীলতা, তিরস্কার, তোষামদ, মোনাফেকী, গীবত, পরনিন্দা, পরচর্চা সর্বপরি মিথ্যা পরিহার পূর্বক সত্য বলা। সত্য বলা মানেই হচ্ছে হক কথা বলা। হযরত আবু যার (রা.) এর প্রশ্নের জবাবে রাসূল (সা.) বললেন-
قُلِ الْحَقَّ، وَإِنْ كَانَ مُرًّا ,,,
“তুমি সত্য কথা বল যদি সেটা তিক্তও হয়।” (বায়হাকী, শুয়াবুল ঈমান)।
রাসূল (সা.) আরো বলেছেন,
أَفْضَلَ الْجِهَادِ مَنْ قَالَ كَلِمَةَ الْحَقِّ عِنْدَ سُلْطَانٍ جَائِرٍ,,,
“সর্বোত্তম জিহাদ হচ্ছে কোন প্রতিষ্ঠিত সুলতানের সামনেও সত্য কথা বলা।” (বায়হাকী, শুয়াবুল ঈমান)
হাত, মুখ ও লজ্জাস্থান এই ৩টি অঙ্গের চেয়ে স্পর্শকাতর এবং বিপদজনক বস্তু আর নেই। কারণ যত প্রকার পাপের কাজ আছে তার সবগুলোই সংঘটিত হয় এই তিনটির দ্বারা। একটি সুখি ও সমৃদ্ধশালী সমাজকে শয়তানের রাজ্যে পরিণত করতে এগুলোর ভুমিকা অপরিসীম। এজন্যই রাসূল (সা.) এই অঙ্গগুলোর সংযতকারীকে জান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছেন।
২. وَأَوْفُوا إِذَا وَعَدْتُمْ “ওয়াদা করলে তা পূর্ণ করবে।”
ওয়াদা এর আভিধানিক অর্থ অঙ্গীকার, চুক্তি, প্রতিশ্রুতি, প্রতিজ্ঞা ইত্যাদি। ইসলামী পরিভাষায় কারো সাথে কেউ কোনো অঙ্গীকার করলে, কাউকে কোনো কথা দিলে বা লিখিত চুক্তি করলে তা পালন করার নাম ওয়াদা। এই ওয়াদা পালন করা মুমিনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ও ঈমানের অঙ্গ।
ওয়াদা রক্ষা করার সামর্থ্য থাকলে এবং তা পালন করতে ইসলামী শরিয়াতে কোনো বাধা না থাকলে যেকোনো মূল্যে তা রক্ষা করা ওয়াজিব। বিশেষ কোনো যৌক্তিক কারণে ওয়াদা রক্ষা করা অসম্ভব হয়ে পড়লে, যাকে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে তাকে বিনয়ের সাথে নিজের অপারগতা জানিয়ে ক্ষমা চেয়ে নিতে হবে।
আমরা পৃথিবীতে আসার আগে আমাদের সৃষ্টিকর্তার কাছে তাঁর আদেশ-নিষেধ পালনের যে অঙ্গীকার করে এসেছি। রুহের জগতে আল্লাহ তাআলা মানুষকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, আমি কি তোমাদের প্রভু নয়? সেদিন মানুষ বলেছিলো হ্যাঁ অবশ্যই আপনি আমাদের প্রভু। আল-হাদীসে বর্ণিত হয়েছে-
أَلَسْتُ بِرَبِّكُمْ قَالُوا بَلَى
“আল্লাহ বললেন, আমি কি তোমাদের প্রভু নাই সবাই জবাব দিলো অবশ্যই আপনি আমাদের প্রভু।” (সুনানে তিরমিযি ও আবু দাউদ)
এখন আমরা তা ভুলে গেছি। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন-
وَالَّذِينَ يَنْقُضُونَ عَهْدَ اللَّهِ مِنْ بَعْدِ مِيثَاقِهِ وَيَقْطَعُونَ مَا أَمَرَ اللَّهُ بِهِ أَنْ يُوصَلَ وَيُفْسِدُونَ فِي الْأَرْضِ أُولَئِكَ لَهُمُ اللَّعْنَةُ وَلَهُمْ سُوءُ الدَّارِ
“যারা আল্লাহর সাথে দৃঢ় অঙ্গীকারে আবদ্ধ হওয়ার পর তা ভঙ্গ করে, যে সম্পর্ক অক্ষুন্ন রাখতে আল্লাহ আদেশ করেছেন তা ছিন্ন করে এবং পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করে বেড়ায়, তারা অভিশাপ পাওয়ার যোগ্য এবং তাদের জন্য রয়েছে আখিরাতে নিকৃষ্ট বাসস্থান।” (সূরা রাদ -২৫)।
আল্লাহ তাআলা আরো বলেন-
وَأَوْفُوا بِالْعَهْدِ إِنَّ الْعَهْدَ كَانَ مَسْئُولًا
“আর অঙ্গীকার পূর্ণ কর, নিশ্চয় অঙ্গীকার সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।” (সূরা বনিইসরাইল-৩৪)।
আল-কুরআনের আরো বক্তব্য হলো-
وَأَوْفُوا بِعَهْدِ اللَّهِ إِذَا عَاهَدْتُمْ وَلَا تَنْقُضُوا الْأَيْمَانَ بَعْدَ تَوْكِيدِهَا
“আর তোমরা যখন অঙ্গীকার কর তখন আল্লাহর অঙ্গীকার পূর্ণ কর। তোমরা পাকাপোক্ত অঙ্গীকার করার পর তা ভঙ্গ করো না।” (সূরা আন-নাহল-৯১)।
আল-হাদীসে বর্ণিত হয়েছে-
وَلَا دِينَ لِمَنْ لَا عَهْدَ لَهُ ,,,
“যে ব্যক্তি ওয়াদা রক্ষা করে না তার মধ্যে দ্বীন নেই।” (মুসনাদে আহমদ)।
আল-হাদীসে ওয়াদা ভঙ্গকারীকে মুনাফিক বলা হয়েছে। আর মুনাফিকের শাস্তি হিসেবে আল্লাহ জাহান্নামের সর্বনিম্নস্তরে স্থান দিবেন। আল-কুরআনে বর্ণিত হয়েছে-
إِنَّ الْمُنَافِقِينَ فِي الدَّرْكِ الْأَسْفَلِ مِنَ النَّارِ وَلَنْ تَجِدَ لَهُمْ نَصِيرًا,,,,
“নিশ্চয় মুনাফিকরা জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে থাকবে। আর তুমি কখনও তাদের জন্য কোন সাহায্যকারী পাবে না।” (সূরা আন-নিসা-১৪৫)
৩. وَأَدُّوا إِذَا اؤْتُمِنْتُمْ “আমানত রাখা হলে তা যথাযথভাবে আদায় করবে/ফেরত দিবে।”
কারও কাছে কোনো অর্থসম্পদ গচ্ছিত রাখার নাম আমানত। যিনি গচ্ছিত সম্পদ যথাযথভাবে সংরক্ষণ করেন এবং এর প্রকৃত মালিক চাওয়া মাত্র তা অক্ষত অবস্থায় ফিরিয়ে দেন, তিনি আমানতদার। আর গচ্ছিত সম্পদ যথাযথভাবে মালিকের কাছে ফেরত না দিয়ে আত্মসাৎ করা আমানতের খেয়ানত।
আমাদের শরীরের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আল্লাহর পক্ষ থেকে আমানত। আমাদের বিবেক-বুদ্ধি হচ্ছে আমানত। মানুষের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রের সঙ্গে আমানত অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। তাই সমাজের প্রত্যেকেই একেকজন আমানতদার। রাষ্ট্র পরিচালনা, ভোট প্রদান, সাংবাদিকতা, অফিসিয়াল কাজকর্ম, শিক্ষকতা, ব্যবসা-বাণিজ্য, শ্রম-মজুরি সবই আমানত। এগুলো যথাযথভাবে পালন না করা খেয়ানতের শামিল। তাছাড়া ইসলামী জীবন পদ্ধতির সব করণীয়-বর্জনীয় বিষয়ের সঙ্গে আমানতদারির সম্পর্ক রয়েছে। এমনকি প্রতিটি মানুষের শরীর-প্রাণ আল্লাহর পক্ষ থেকে মানুষের কাছে আমানত। আল্লাহ বলেন-
إِنَّ اللَّهَ يَأْمُرُكُمْ أَنْ تُؤَدُّوا الْأَمَانَاتِ إِلَى أَهْلِهَا وَإِذَا حَكَمْتُمْ بَيْنَ النَّاسِ أَنْ تَحْكُمُوا بِالْعَدْلِ,,,
“নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদেরকে আদেশ দিচ্ছেন আমানত সমূহ তার হকদারদের কাছে পৌঁছে দিতে। আর যখন মানুষের মধ্যে ফয়সালা করবে তখন ন্যায়ভিত্তিক ফয়সালা করবে।” (সূরা নিসা-৫৮)।
আমানতের খেয়ানত প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন-
لَا إيمَانَ لِمَنْ لَا أَمَانَةَ لَهُ ,,,
“যে ব্যক্তি আমানত রক্ষা করে না তার মধ্যে ঈমান নেই।” (মুসনাদে আহমদ)।
সূরা মুমিনুনে সফলতা লাভকারী মুমিনের গুনাবলীর মধ্যেও আমানতের হেফাযতকারীর কথা বলা হয়েছে। এদের পুরস্কার ঘোষণা করে আল্লাহ তায়ালা বলেন-
وَالَّذِينَ هُمْ لِأَمَانَاتِهِمْ وَعَهْدِهِمْ رَاعُونَ وَالَّذِينَ هُمْ عَلَى صَلَوَاتِهِمْ يُحَافِظُونَ أُولَئِكَ هُمُ الْوَارِثُونَ الَّذِينَ يَرِثُونَ الْفِرْدَوْسَ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ
“যারা আমানত ও ওয়াদা রক্ষা করে তারা উত্তারাধিকার হিসেবে ফেরদাউস নামক জান্নাতের অধিকারী হবে, সেখানে তারা চিরকাল অবস্থান করবে।” (সূরা মুমিনুন- ৮-১১)
পক্ষান্তরে প্রচুর পরিমাণ নেক আমল করার পরও আমানতের খেয়ানতকারীকে আল্লাহ ক্ষমা করবেন না। আল-হাদীসে বর্ণিত হয়েছে-
أَتَدْرُونَ مَنِ الْمُفْلِسُ ؟ قَالُوا : الْمُفْلِسُ فِينَا يَا رَسُولَ اللهِ مَنْ لاَ دِرْهَمَ لَهُ ، وَلاَ مَتَاعَ لَهُ ، فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم : الْمُفْلِسُ مِنْ أُمَّتِي مَنْ يَأْتِي يَوْمَ الْقِيَامَةِ بِصَلاَتِهِ وَصِيَامِهِ وَزَكَاتِهِ ، وَقَدْ شَتَمَ هَذَا ، وَأَكَلَ مَالَ هَذَا ، وَسَفَكَ دَمَ هَذَا ، وَضَرَبَ هَذَا ، فَيَقْعُدُ فَيُعْطَى هَذَا مِنْ حَسَنَاتِهِ ، وَهَذَا مِنْ حَسَنَاتِهِ ، فَإِنْ فَنِيَتْ حَسَنَاتُهُ قَبْلَ أَنْ يُعْطِيَ مَا عَلَيْهِ أَخَذَ مِنْ خَطَايَاهُمْ فَطُرِحَتْ عَلَيْهِ ، ثُمَّ طُرِحَ فِي النَّارِ,,
“আল্লাহর রাসূল (সা.) বললেন, তোমরা কি জান প্রকৃত হতদরিদ্র কে? সাহাবীরা বললেন, যার ধন-সম্পদ, অর্থ-কড়ি নেই সেই প্রকৃত দরিদ্র। রাসূল (সা.) বললেন, আমার উম্মতের মধ্যে সেই সবচেয়ে দরিদ্র যে কিয়ামতের দিন নামায, রোজা, হজ্জ, যাকাতসহ উপস্থিত হবে। সেই সাথে কাউকে অভিশাপ করে থাকবে, কারো মাল অন্যায়ভাবে আত্মসাত করে থাকবে, কাউকে রক্তপাত করে থাকবে, কাউকে প্রহার করে থাকবে। কিয়ামতের দিন যাদের হক নষ্ট করেছে নেক আমল থেকে তাদের পাওনা পরিশোধ করার জন্য আল্লাহ নির্দেশ দিবেন। পাওনাদারের পাওনা পরিশোধের পূর্বেই তাদের নেক আমল সব শেষ হয়ে যাবে। তখন তাদেরকে ধরা হবে এবং জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। (সূনান আত-তিরমিযি)
আমানত রক্ষা করার ক্ষেত্রে আমরা সবাই দায়িত্বশীল আর এ দায়িত্বের ব্যাপারে আল্লাহর কাছে হিসাব দিতে হবে। রাসূল (সা.) বলেন-
كُلُّكُمْ رَاعٍ وَكُلُّكُمْ مَسْؤُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ,,,
“তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং এই দায়িত্ব সম্পর্কে তোমাদের জিজ্ঞাসা করা হবে।” (সহীহ আল-বুখারী)
উপরে উল্লেখিত ৩টি স্বভাব যার মধ্যে থাকবে অর্থাৎ এই ৩টি বিষয় সম্বলিত সভাব-বিশিষ্ট্যের অধিকারীকে আল্লাহর রাসূল (সা.) পাক্কা মুনাফিক হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। আল-হাদীসে বর্ণিত হয়েছে-
عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عَمْرٍو أَنَّ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم قَالَ : أَرْبَعٌ مَنْ كُنَّ فِيهِ كَانَ مُنَافِقًا خَالِصًا ، إِذَا اؤْتُمِنَ خَانَ ، وَإِذَا حَدَّثَ كَذَبَ ، وَإِذَا عَاهَدَ غَدَرَ ، وَإِذَا خَاصَمَ فَجَرَ.
“আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) হতে বর্ণিত রাসূল (সা.) বলেছেন, যার মধ্যে চারটি বৈশিষ্ট্য থাকবে সে ব্যক্তি খাঁটি মুনাফিক।
১. যখন তার কাছে আমানত রাখা হয় তখন তার খেয়ানত করে, ২. যখন কথা বলে মিথ্যা কথা বলে,
৩. যখন ওয়াদা করে তা ভঙ্গ করে, এবং
৪. কথা বলার সময় অশ্লীল বাক্য বিনিময় করে। (সহীহ আল-বুখারী ও মুসলিম)
৪. وَاحْفَظُوا فُرُوجَكُمْ “নিজেদের লজ্জাস্থান সমূহের হেফাজত করবে।”
৫. وَغُضُّوا أَبْصَارَكُمْ “
তোমাদের দৃষ্টিকে অবনমীত রাখবে।”
লজ্জাস্থানের হেফাজত এবং দৃষ্টিকে অবনমিত রাখার ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা তাগিদ দিয়ে বলেন-
قُلْ لِلْمُؤْمِنِينَ يَغُضُّوا مِنْ أَبْصَارِهِمْ وَيَحْفَظُوا فُرُوجَهُمْ ذَلِكَ أَزْكَى لَهُمْ إِنَّ اللَّهَ خَبِيرٌ بِمَا يَصْنَعُونَ,,
“মু’মিন পুরুষদেরকে বল, তারা তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখবে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হিফাযত করবে। এটাই তাদের জন্য অধিক পবিত্র। নিশ্চয় তারা যা করে সে সম্পর্কে আল্লাহ সম্যক অবহিত।” (সূরা আন-নূর-৩০)
এর পরবর্তী আয়াতে নারীদেরকেউ দৃষ্টি অবনমিত রাখার ব্যাপারে আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন-
وَقُلْ لِلْمُؤْمِنَاتِ يَغْضُضْنَ مِنْ أَبْصَارِهِنَّ وَيَحْفَظْنَ فُرُوجَهُنَّ
“আর মু’মিন নারীদেরকে বল, তারা তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখবে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হিফাযত করবে।” (সূরা আন-নূর-৩১)
এ আয়াতে ‘দৃষ্টি’ কে আগে আনা হয়েছে কেননা, জ্বেনা ব্যাভিচারের সূত্রপাতই হয় দৃষ্টি থেকে।
আল্লাহর রসুল (সা.) দৃষ্টিকে ইবলিসের তীরের সাথে তুলনা করেছেন,। আর এ দৃষ্টি যদি যৌবনের উত্তাল তরঙ্গমালার সন্ধিক্ষণের ‘দৃষ্টি’ হয় তাহলে তা হয়ে উঠে আরও ভয়াবহ। যৌবনের প্রতিটা মুহুর্তই নারীর সান্নিধ্য পেতে বড়ই ব্যাকুল হয়ে থাকে। মনের মুকুরে ভেসে বেড়ায় অসংখ্য নারীর মুখ। মনের মুকুরে প্রবেশ করার পূর্বেই যদি প্রবেশ পথ দৃষ্টিকে নিয়ন্ত্রিত করা যায় তাহলে কল্পনার ফিল্মে কোন নারীর অবয়ব, অঙ্গ সৌন্দর্য্য ভেঁসে উঠতে পারে না।
উদাহরণ : ক্যামেরার লেন্সের মুখের ঢাকনা বন্ধ থাকলে অভ্যন্তরে সংযুক্ত ফিল্মে যেমন ছবি ধরা পড়ে না তদ্রুপ ‘দৃষ্টি’ নিম্নমুখী তথা নিয়ন্ত্রিত থাকলে অর্থাৎ নারীর সৌন্দর্য্যরে প্রতি দৃষ্টি না পড়লে অন্তর জগতে যৌন বাসনা সৃষ্টি হতে পারে না, সুতরাং নারীর দেহ-সৌন্দর্য্যরে প্রতি দৃষ্টিপাত জ্বেনা-ব্যভিচারের ক্ষেত্র তৈরি করে বিধায় আল্লাহ তা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন। তবে খারাপ নিয়তে দৃষ্টিপাত করা হারাম, খারাপ নয় এমন নিয়তে দেখা মাকরূহ, জরুরী প্রয়োজনে দৃষ্টপাত জায়েজ।
লজ্জাস্থান বা যৌনাঙ্গ সংযত-হেফাজত করার অর্থ কুপ্রবৃত্তি চরিতার্থ করার যত পথ,পন্থা,পদ্ধতি আছে তা থেকে নিজেকে নিবৃত্ত রাখা। এর প্রারম্ভিক কারণ ‘দৃষ্টিপাত’ সর্বশেষ ‘ব্যাভিচার’।
জ্বেনা সম্পর্কে আল্লাহতা‘য়ালা বলেন,
وَلَا تَقْرَبُوْا الزِّنَى إِنَّهُ كَانَ فَاحِشَةً وَسَاءَ سَبِيْلًا
“তোমরা জ্বেনার নিকট বর্তীত্ত হয়োনা, কারণ এটা খুবই খারাপ কাজ এবং অতীব বিকৃষ্ট পথ।” (সূরা বনী ইসরাঈল-৩২)
জ্বেনা ও ব্যাভিচারের মাধ্যমে দাম্পত্য জীবন ও পারিবারিক শান্তি বিঘ্নিত হয়, সামাজ অসভ্য হয়ে পড়ে, সমাজ-পরিবারে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়, কাজেই এ ধরণের পাপের কাজ থেকে ঈমানদারদের বেঁচে থাকতে হবে।
জ্বেনা থেকে বেঁচে থাকার প্রতিফল : হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) রেওয়াতকৃত একটি হাদীসে রাসুল (সা.) যুবকদের উদ্দেশ্যে বলেন,
يَا شَبَابَ قُرَيِشٍ اِحْفَظُوْا فُرُوْجَكُمْ وَلَا تَزْنُوْا الآ مَنْ حَفَظَ فَرْجًهُ فَلَهُ الْجَنَّةَ,,
‘‘হে কুরাইশ যুবকেরা তোমরা লজ্জাস্থান সমূহ হেফাজত কর ব্যভিচার করো না, যারা বিষ্কলুষ ও পবিত্রতার সাথে জীবন যাপন করবে তারা জান্নাতের হকদার হবে। (বায়হাকী, শুয়াবুল ঈমান)
অন্য হাদীসে তাদেরকে আরশের ছায়াতলে স্থান লাভকারীর সৌভাগ্যবান বলে সুসংবাদ দেওয়া হয়েছে-
رَجُلٌ دَعَتُهُ اِمْرَأَةٌ ذَاتَ حَسَبِ وَّ جَمَلٍ فَقَالَ اِنِّ اَخَافُ اللّهَ
“এমন যুবক যাকে পদমর্যাদা সম্পন্না সুন্দরী নারী ব্যভিচারের জন্য আহবান করে আর সেই যুবক বলে আমি আল্লাহকে ভয় করি।” (এমন যুবক আরশের ছায়াতলে আশ্রয় পাবে) (সহীহ আল-বুখারী)।
উপরের ২টি বিষয় আমল করার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে জ্বেনা-ব্যাভিচার থেকে সমাজকে রক্ষা করা।
৬. وَكُفُّوا أَيْدِيَكُمْ
“নিজেদের হাত দু’টিকে নিয়ন্ত্রনে রাখবে।”
হাত নিয়ন্ত্রনে রাখা বা বিরত রাখার অর্থ হচ্ছে যাবতীয় অন্যায় থেকে বিরত রাখা, অন্যায়কে প্রতিহত করা এবং ন্যায়ের প্রতিষ্ঠার জন্য হাতশক্তি ব্যবহার করা।
আল-হাদীসে বর্ণিত হয়েছে-
فَمَنْ جَاهَدَهُمْ بِيَدِهِ فَهُوَ مُؤْمِنٌ وَمَنْ جَاهَدَهُمْ بِلِسَانِهِ فَهُوَ مُؤْمِنٌ وَمَنْ جَاهَدَهُمْ بِقَلْبِهِ فَهُوَ مُؤْمِنٌ وَلَيْسَ وَرَاءَ ذَلِكَ مِنَ الإِيمَانِ حَبَّةُ خَرْدَلٍ,,,
“যে ব্যক্তি হাত দ্বারা জিহাদ করলো সে মুমিন, যে মুখ দ্বারা জিহাদ করলো সে মুমিন এবং যে অন্তর দ্বারা জিহাদ করলো সে মুমিন। আর যে ব্যক্তি এর কোনটিই করলো না তার অন্তরে ষশ্যদানা পরিমান ঈমান নেই।” (সহীহ মুসলিম)
হাত সংযত রাখার আর একটি অর্থ হতে পারে, তাহলোঃ হাত দ্বারা অপর মানুষের কষ্ট না দেয়া। এটাকে অন্যায় কাজে ব্যবহার না করা। এ সম্পর্কে রাসূল (সা.) বলেছেন-
عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عَمْرٍو ، رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ ، عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ : الْمُسْلِمُ مَنْ سَلِمَ الْمُسْلِمُونَ مِنْ لِسَانِهِ وَيَدِهِ,,,
“হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) হতে বর্ণিত রাসূল (সা.) বলেছেন, মুসলমান সেই ব্যক্তি যার হাত ও যবান থেকে অন্য মুসলামান নিরাপদ থাকে।” (সহীহ আল-বুখারী ও মুসলিম)।
আলোচ্য দারসের শিক্ষা হচ্ছে, একজন মু’মিন তার জীবনের প্রতিটা মুহুর্তে উক্ত ৬টি নির্দেশ মেনে চলবে এবং সমাজের মানুষদেরকেও এগুলো মেনে চলার জন্য উদ্বুদ্ধ করবে। এ আদেশগুলো মেনে চললে যেমন রাসূল (সা.) জান্নাতের জন্য বান্দার জন্য সুপারিশ করবেন। ঠিক তেমনি সমাজের সকল মানুষের মধ্যে ভ্রাতৃত্বপূর্ণ ভালবাসা তৈরী হবে এবং সমাজ হবে শান্তির আবাস।
*********************************
নবিজী এরশাদ করেছেন,
عَنْ عُبَادَةَ بْنِ الصَّامِتِ أَنَّ النَّبِيَّ -صلى الله عليه وسلم- قَالَ اضْمَنُوا لِي سِتًّا مِنْ أَنْفُسِكُمْ أَضْمَنْ لَكُمُ الْجَنَّةَ اصْدُقُوا إِذَا حَدَّثْتُمْ ، وَأَوْفُوا إِذَا وَعَدْتُمْ وَأَدُّوا إِذَا ائْتُمِنْتُمْ وَاحْفَظُوا فُرُوجَكُمْ ، وَغُضُّوا أَبْصَارَكُمْ ، وَكُفُّوا أَيْدِيَكُمْ,,,
অনুবাদঃ-
হযরত উবাদাতা ইবনে সামিত (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেছেন, তোমরা যদি তোমাদের পক্ষ থেকে ৬টি বিষয়ে জামিনদার হও তাহলে আমিও তোমাদের জন্য জান্নাতের জামিনদার হব। তাহলোঃ
১. যখন তোমরা কথা বলবে সত্য বলবে,
২. ওয়াদা করে তা পূর্ণ করবে,
৩. আমানত রাখা হলে তা যথাযথভাবে ফেরত দিবে,
৪. নিজেদের লজ্জাস্থান সমূহের হেফাজত করবে,
৫. তোমাদের দৃষ্টিকে অবনমীত রাখবে এবং
৬. নিজেদের হাত দু’টিকে নিয়ন্ত্রনে রাখবে।
(মুসনাদে আহমদ)
রাবী পরিচিতিঃ-
উবাদাতা ইবনে সামিত (রা.) এর ডাকনাম ছিলো আবুল ওয়ালিদ। পিতার নাম সামেত ইবনে কায়েস, মাতার নাম র্কুরাতুল আইন। মদীনার খাজরাজ বংশের সালেম গোত্রের মানুষ। তিনি আনসার সাহাবী ছিলেন।
বৈশিষ্ট্য সমূহঃ-
তিনি সাহাবীদের মধ্যে ২টি বিষয়ে সৌভাগ্যের অধিকারী।
১. আকাবার ১ম শপথে অংশগ্রহনকারী,
২. বদরে অংশগ্রহনকারী ও বায়াতে রেদওয়ানের সময় রাসূল (সা.) হাতে বাইয়াত গ্রহনকারী। তিনি ছিলেন আল-কুরআনের হাফেজ, বিশুদ্ধ তিলাওয়াতকারী এবং আসহাবে সুফ্ফার সুপারেনটেনডেন্ট ও শিক্ষক।
বর্ণিত হাদীসঃ-
তাঁর বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা ১৮১টি, তারমধ্যে ৬টি হাদীস বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে।
ইন্তেকালঃ-
হিজরী ৩৪ সনে ৭২বছর বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেন।
হাদীসের ব্যাখ্যাঃ-
اضْمَنُوا لِى سِتًّا مِنْ أَنْفُسِكُمْ أَضْمَنُ لَكُمُ الْجَنَّةَ,,,
এ হাদীসের শুরুতে রাসূল (সা.) সাহাবীদের বললেন, তোমরা যদি তোমাদের পক্ষ থেকে ৬টি বিষয়ে জামিনদার হও তাহলে আমিও তোমাদের জন্য জান্নাতের জামিনদার হব। অর্থাৎ কোন ব্যক্তি যদি উক্ত হাদীসে উল্লেখিত ৬টি আমল সঠিকভাবে করতে পারে তাহলে রাসূল (সা.) তাদের জন্য জান্নাত পাওয়ার ব্যাপারে আল্লাহর কাছে জামিনদার হবেন। এর অর্থই হচ্ছে এ বৈশিষ্ট্যের অধিকারীর জন্য জান্নাত অবধারিত হবে। সে ৬টি আমল হচ্ছে-
১. اصْدُقُوا إِذَا حَدَّثْتُمْ “যখন কথা বলবে সত্য বলবে।”
হক কথা বলা, হকের পথে থাকা একটি গুরুত্বপূর্ণ নেক আমল। কারণ হক কাজ, হক কথা মানুষের মনে প্রশান্তি এনে দেয়। এ সম্পর্কে রাসূল (সা.) বলেন-
فَإِنَّ الصَّدَقَ طُمَأْنِينَةٌ ، وَإِنَّ الْكَذِبَ رِيبَةٌ,,,,
“সত্য দেয় মনের শান্তি আর মিথ্যা দেয় সংশয়।” (সুনান আত-তিরমিযি)।
অন্য হাদীসে বর্ণিত হয়েছে-
إِنَّ الصِّدْقَ يَهْدِي إِلَى الْبِرِّ وَإِنَّ الْبِرَّ يَهْدِي إِلَى الْجَنَّةِ,,,
“নিশ্চয় সত্য ভালো বা নৈতিকতার দিকে নিয়ে যায় আর নৈতিকতা জান্নাতের দিকে নিয়ে যায়।” (সহীহ আল-বুখারী)।
মানুষ কথা বলে জিহব্বার মাধ্যমে, জিহব্বা আকার-আয়াতনে অনেক ছোট হলেও এর ক্ষমতা অত্যন্ত বেশী। এটি মানুষকে অধঃপতনের অতল গহব্বরে নিক্ষেপ করতে পারে আবার সাফল্যের উচ্চ শিখরেও সমাসীন করতে পারে। এ জন্য রাসূল (সা.) বলেছেন-
وَإِنَّهُ لَيَزِلُّ عَنْ لِسَانِهِ أَشَدَّ مِمَّا يَزِلُّ مِنْ قَدَمِهِ,,,
“নিঃসন্দেহে বান্দার পা পিছলানোর চেয়ে মুখ পিছলানো অধিকতর ক্ষতিকর।” (বায়হাকী, শুয়াবুল ঈমান)
আল-হাদীসে আরো বর্ণিত হয়েছে-
عَنْ عُقْبَةَ بْنِ عَامِرٍ، قَالَ: قُلْتُ: يَا نَبِيَّ اللهِ مَا النَّجَاةُ ؟، قَالَ: " أَمْلِكْ عَلَيْكَ لِسَانَكَ، وَلْيَسَعْكَ بَيْتُكَ، وَلْتَبْكِ عَلَى خَطِيئَتِكَ"
“হযরত উকবা ইবনে আমের (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি রাসূল (সা.) কে জিজ্ঞেস করলাম হে আল্লাহর নবী মুক্তির উপায় কি? রাসূল (সা.) বললেন,
১. তুমি জিহবাকে আয়াত্তে রাখো,
২. নিজের ঘরে পড়ে থাকো এবং
৩. পাপের জন্য কাদো।” (তিরমিযি ও মুসনাদে আহমদ)।
অন্য আল-হাদীসে বর্ণিত হয়েছে-
عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ، أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: " مَنْ خَزَنَ لِسَانَهُ سَتَرَ اللهُ عَوْرَتَهُ “
হযরত আনাস ইবনে মালিক থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি স্বীয় জিহবাকে সংযত রাখবে কিয়ামতের দিন আল্লাহ তার দোষ-ত্রুটির উপরে আবরণ ফেলে দিবেন।” (বায়হাকী, শুয়াবুল ঈমান)
জিহবা সংযত রাখার অর্থই হচ্ছে ঝগড়া-বিবাদ, অশ্লীলতা, তিরস্কার, তোষামদ, মোনাফেকী, গীবত, পরনিন্দা, পরচর্চা সর্বপরি মিথ্যা পরিহার পূর্বক সত্য বলা। সত্য বলা মানেই হচ্ছে হক কথা বলা। হযরত আবু যার (রা.) এর প্রশ্নের জবাবে রাসূল (সা.) বললেন-
قُلِ الْحَقَّ، وَإِنْ كَانَ مُرًّا ,,,
“তুমি সত্য কথা বল যদি সেটা তিক্তও হয়।” (বায়হাকী, শুয়াবুল ঈমান)।
রাসূল (সা.) আরো বলেছেন,
أَفْضَلَ الْجِهَادِ مَنْ قَالَ كَلِمَةَ الْحَقِّ عِنْدَ سُلْطَانٍ جَائِرٍ,,,
“সর্বোত্তম জিহাদ হচ্ছে কোন প্রতিষ্ঠিত সুলতানের সামনেও সত্য কথা বলা।” (বায়হাকী, শুয়াবুল ঈমান)
হাত, মুখ ও লজ্জাস্থান এই ৩টি অঙ্গের চেয়ে স্পর্শকাতর এবং বিপদজনক বস্তু আর নেই। কারণ যত প্রকার পাপের কাজ আছে তার সবগুলোই সংঘটিত হয় এই তিনটির দ্বারা। একটি সুখি ও সমৃদ্ধশালী সমাজকে শয়তানের রাজ্যে পরিণত করতে এগুলোর ভুমিকা অপরিসীম। এজন্যই রাসূল (সা.) এই অঙ্গগুলোর সংযতকারীকে জান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছেন।
২. وَأَوْفُوا إِذَا وَعَدْتُمْ “ওয়াদা করলে তা পূর্ণ করবে।”
ওয়াদা এর আভিধানিক অর্থ অঙ্গীকার, চুক্তি, প্রতিশ্রুতি, প্রতিজ্ঞা ইত্যাদি। ইসলামী পরিভাষায় কারো সাথে কেউ কোনো অঙ্গীকার করলে, কাউকে কোনো কথা দিলে বা লিখিত চুক্তি করলে তা পালন করার নাম ওয়াদা। এই ওয়াদা পালন করা মুমিনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ও ঈমানের অঙ্গ।
ওয়াদা রক্ষা করার সামর্থ্য থাকলে এবং তা পালন করতে ইসলামী শরিয়াতে কোনো বাধা না থাকলে যেকোনো মূল্যে তা রক্ষা করা ওয়াজিব। বিশেষ কোনো যৌক্তিক কারণে ওয়াদা রক্ষা করা অসম্ভব হয়ে পড়লে, যাকে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে তাকে বিনয়ের সাথে নিজের অপারগতা জানিয়ে ক্ষমা চেয়ে নিতে হবে।
আমরা পৃথিবীতে আসার আগে আমাদের সৃষ্টিকর্তার কাছে তাঁর আদেশ-নিষেধ পালনের যে অঙ্গীকার করে এসেছি। রুহের জগতে আল্লাহ তাআলা মানুষকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, আমি কি তোমাদের প্রভু নয়? সেদিন মানুষ বলেছিলো হ্যাঁ অবশ্যই আপনি আমাদের প্রভু। আল-হাদীসে বর্ণিত হয়েছে-
أَلَسْتُ بِرَبِّكُمْ قَالُوا بَلَى
“আল্লাহ বললেন, আমি কি তোমাদের প্রভু নাই সবাই জবাব দিলো অবশ্যই আপনি আমাদের প্রভু।” (সুনানে তিরমিযি ও আবু দাউদ)
এখন আমরা তা ভুলে গেছি। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন-
وَالَّذِينَ يَنْقُضُونَ عَهْدَ اللَّهِ مِنْ بَعْدِ مِيثَاقِهِ وَيَقْطَعُونَ مَا أَمَرَ اللَّهُ بِهِ أَنْ يُوصَلَ وَيُفْسِدُونَ فِي الْأَرْضِ أُولَئِكَ لَهُمُ اللَّعْنَةُ وَلَهُمْ سُوءُ الدَّارِ
“যারা আল্লাহর সাথে দৃঢ় অঙ্গীকারে আবদ্ধ হওয়ার পর তা ভঙ্গ করে, যে সম্পর্ক অক্ষুন্ন রাখতে আল্লাহ আদেশ করেছেন তা ছিন্ন করে এবং পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করে বেড়ায়, তারা অভিশাপ পাওয়ার যোগ্য এবং তাদের জন্য রয়েছে আখিরাতে নিকৃষ্ট বাসস্থান।” (সূরা রাদ -২৫)।
আল্লাহ তাআলা আরো বলেন-
وَأَوْفُوا بِالْعَهْدِ إِنَّ الْعَهْدَ كَانَ مَسْئُولًا
“আর অঙ্গীকার পূর্ণ কর, নিশ্চয় অঙ্গীকার সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।” (সূরা বনিইসরাইল-৩৪)।
আল-কুরআনের আরো বক্তব্য হলো-
وَأَوْفُوا بِعَهْدِ اللَّهِ إِذَا عَاهَدْتُمْ وَلَا تَنْقُضُوا الْأَيْمَانَ بَعْدَ تَوْكِيدِهَا
“আর তোমরা যখন অঙ্গীকার কর তখন আল্লাহর অঙ্গীকার পূর্ণ কর। তোমরা পাকাপোক্ত অঙ্গীকার করার পর তা ভঙ্গ করো না।” (সূরা আন-নাহল-৯১)।
আল-হাদীসে বর্ণিত হয়েছে-
وَلَا دِينَ لِمَنْ لَا عَهْدَ لَهُ ,,,
“যে ব্যক্তি ওয়াদা রক্ষা করে না তার মধ্যে দ্বীন নেই।” (মুসনাদে আহমদ)।
আল-হাদীসে ওয়াদা ভঙ্গকারীকে মুনাফিক বলা হয়েছে। আর মুনাফিকের শাস্তি হিসেবে আল্লাহ জাহান্নামের সর্বনিম্নস্তরে স্থান দিবেন। আল-কুরআনে বর্ণিত হয়েছে-
إِنَّ الْمُنَافِقِينَ فِي الدَّرْكِ الْأَسْفَلِ مِنَ النَّارِ وَلَنْ تَجِدَ لَهُمْ نَصِيرًا,,,,
“নিশ্চয় মুনাফিকরা জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে থাকবে। আর তুমি কখনও তাদের জন্য কোন সাহায্যকারী পাবে না।” (সূরা আন-নিসা-১৪৫)
৩. وَأَدُّوا إِذَا اؤْتُمِنْتُمْ “আমানত রাখা হলে তা যথাযথভাবে আদায় করবে/ফেরত দিবে।”
কারও কাছে কোনো অর্থসম্পদ গচ্ছিত রাখার নাম আমানত। যিনি গচ্ছিত সম্পদ যথাযথভাবে সংরক্ষণ করেন এবং এর প্রকৃত মালিক চাওয়া মাত্র তা অক্ষত অবস্থায় ফিরিয়ে দেন, তিনি আমানতদার। আর গচ্ছিত সম্পদ যথাযথভাবে মালিকের কাছে ফেরত না দিয়ে আত্মসাৎ করা আমানতের খেয়ানত।
আমাদের শরীরের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আল্লাহর পক্ষ থেকে আমানত। আমাদের বিবেক-বুদ্ধি হচ্ছে আমানত। মানুষের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রের সঙ্গে আমানত অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। তাই সমাজের প্রত্যেকেই একেকজন আমানতদার। রাষ্ট্র পরিচালনা, ভোট প্রদান, সাংবাদিকতা, অফিসিয়াল কাজকর্ম, শিক্ষকতা, ব্যবসা-বাণিজ্য, শ্রম-মজুরি সবই আমানত। এগুলো যথাযথভাবে পালন না করা খেয়ানতের শামিল। তাছাড়া ইসলামী জীবন পদ্ধতির সব করণীয়-বর্জনীয় বিষয়ের সঙ্গে আমানতদারির সম্পর্ক রয়েছে। এমনকি প্রতিটি মানুষের শরীর-প্রাণ আল্লাহর পক্ষ থেকে মানুষের কাছে আমানত। আল্লাহ বলেন-
إِنَّ اللَّهَ يَأْمُرُكُمْ أَنْ تُؤَدُّوا الْأَمَانَاتِ إِلَى أَهْلِهَا وَإِذَا حَكَمْتُمْ بَيْنَ النَّاسِ أَنْ تَحْكُمُوا بِالْعَدْلِ,,,
“নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদেরকে আদেশ দিচ্ছেন আমানত সমূহ তার হকদারদের কাছে পৌঁছে দিতে। আর যখন মানুষের মধ্যে ফয়সালা করবে তখন ন্যায়ভিত্তিক ফয়সালা করবে।” (সূরা নিসা-৫৮)।
আমানতের খেয়ানত প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন-
لَا إيمَانَ لِمَنْ لَا أَمَانَةَ لَهُ ,,,
“যে ব্যক্তি আমানত রক্ষা করে না তার মধ্যে ঈমান নেই।” (মুসনাদে আহমদ)।
সূরা মুমিনুনে সফলতা লাভকারী মুমিনের গুনাবলীর মধ্যেও আমানতের হেফাযতকারীর কথা বলা হয়েছে। এদের পুরস্কার ঘোষণা করে আল্লাহ তায়ালা বলেন-
وَالَّذِينَ هُمْ لِأَمَانَاتِهِمْ وَعَهْدِهِمْ رَاعُونَ وَالَّذِينَ هُمْ عَلَى صَلَوَاتِهِمْ يُحَافِظُونَ أُولَئِكَ هُمُ الْوَارِثُونَ الَّذِينَ يَرِثُونَ الْفِرْدَوْسَ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ
“যারা আমানত ও ওয়াদা রক্ষা করে তারা উত্তারাধিকার হিসেবে ফেরদাউস নামক জান্নাতের অধিকারী হবে, সেখানে তারা চিরকাল অবস্থান করবে।” (সূরা মুমিনুন- ৮-১১)
পক্ষান্তরে প্রচুর পরিমাণ নেক আমল করার পরও আমানতের খেয়ানতকারীকে আল্লাহ ক্ষমা করবেন না। আল-হাদীসে বর্ণিত হয়েছে-
أَتَدْرُونَ مَنِ الْمُفْلِسُ ؟ قَالُوا : الْمُفْلِسُ فِينَا يَا رَسُولَ اللهِ مَنْ لاَ دِرْهَمَ لَهُ ، وَلاَ مَتَاعَ لَهُ ، فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم : الْمُفْلِسُ مِنْ أُمَّتِي مَنْ يَأْتِي يَوْمَ الْقِيَامَةِ بِصَلاَتِهِ وَصِيَامِهِ وَزَكَاتِهِ ، وَقَدْ شَتَمَ هَذَا ، وَأَكَلَ مَالَ هَذَا ، وَسَفَكَ دَمَ هَذَا ، وَضَرَبَ هَذَا ، فَيَقْعُدُ فَيُعْطَى هَذَا مِنْ حَسَنَاتِهِ ، وَهَذَا مِنْ حَسَنَاتِهِ ، فَإِنْ فَنِيَتْ حَسَنَاتُهُ قَبْلَ أَنْ يُعْطِيَ مَا عَلَيْهِ أَخَذَ مِنْ خَطَايَاهُمْ فَطُرِحَتْ عَلَيْهِ ، ثُمَّ طُرِحَ فِي النَّارِ,,
“আল্লাহর রাসূল (সা.) বললেন, তোমরা কি জান প্রকৃত হতদরিদ্র কে? সাহাবীরা বললেন, যার ধন-সম্পদ, অর্থ-কড়ি নেই সেই প্রকৃত দরিদ্র। রাসূল (সা.) বললেন, আমার উম্মতের মধ্যে সেই সবচেয়ে দরিদ্র যে কিয়ামতের দিন নামায, রোজা, হজ্জ, যাকাতসহ উপস্থিত হবে। সেই সাথে কাউকে অভিশাপ করে থাকবে, কারো মাল অন্যায়ভাবে আত্মসাত করে থাকবে, কাউকে রক্তপাত করে থাকবে, কাউকে প্রহার করে থাকবে। কিয়ামতের দিন যাদের হক নষ্ট করেছে নেক আমল থেকে তাদের পাওনা পরিশোধ করার জন্য আল্লাহ নির্দেশ দিবেন। পাওনাদারের পাওনা পরিশোধের পূর্বেই তাদের নেক আমল সব শেষ হয়ে যাবে। তখন তাদেরকে ধরা হবে এবং জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। (সূনান আত-তিরমিযি)
আমানত রক্ষা করার ক্ষেত্রে আমরা সবাই দায়িত্বশীল আর এ দায়িত্বের ব্যাপারে আল্লাহর কাছে হিসাব দিতে হবে। রাসূল (সা.) বলেন-
كُلُّكُمْ رَاعٍ وَكُلُّكُمْ مَسْؤُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ,,,
“তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং এই দায়িত্ব সম্পর্কে তোমাদের জিজ্ঞাসা করা হবে।” (সহীহ আল-বুখারী)
উপরে উল্লেখিত ৩টি স্বভাব যার মধ্যে থাকবে অর্থাৎ এই ৩টি বিষয় সম্বলিত সভাব-বিশিষ্ট্যের অধিকারীকে আল্লাহর রাসূল (সা.) পাক্কা মুনাফিক হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। আল-হাদীসে বর্ণিত হয়েছে-
عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عَمْرٍو أَنَّ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم قَالَ : أَرْبَعٌ مَنْ كُنَّ فِيهِ كَانَ مُنَافِقًا خَالِصًا ، إِذَا اؤْتُمِنَ خَانَ ، وَإِذَا حَدَّثَ كَذَبَ ، وَإِذَا عَاهَدَ غَدَرَ ، وَإِذَا خَاصَمَ فَجَرَ.
“আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) হতে বর্ণিত রাসূল (সা.) বলেছেন, যার মধ্যে চারটি বৈশিষ্ট্য থাকবে সে ব্যক্তি খাঁটি মুনাফিক।
১. যখন তার কাছে আমানত রাখা হয় তখন তার খেয়ানত করে, ২. যখন কথা বলে মিথ্যা কথা বলে,
৩. যখন ওয়াদা করে তা ভঙ্গ করে, এবং
৪. কথা বলার সময় অশ্লীল বাক্য বিনিময় করে। (সহীহ আল-বুখারী ও মুসলিম)
৪. وَاحْفَظُوا فُرُوجَكُمْ “নিজেদের লজ্জাস্থান সমূহের হেফাজত করবে।”
৫. وَغُضُّوا أَبْصَارَكُمْ “
তোমাদের দৃষ্টিকে অবনমীত রাখবে।”
লজ্জাস্থানের হেফাজত এবং দৃষ্টিকে অবনমিত রাখার ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা তাগিদ দিয়ে বলেন-
قُلْ لِلْمُؤْمِنِينَ يَغُضُّوا مِنْ أَبْصَارِهِمْ وَيَحْفَظُوا فُرُوجَهُمْ ذَلِكَ أَزْكَى لَهُمْ إِنَّ اللَّهَ خَبِيرٌ بِمَا يَصْنَعُونَ,,
“মু’মিন পুরুষদেরকে বল, তারা তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখবে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হিফাযত করবে। এটাই তাদের জন্য অধিক পবিত্র। নিশ্চয় তারা যা করে সে সম্পর্কে আল্লাহ সম্যক অবহিত।” (সূরা আন-নূর-৩০)
এর পরবর্তী আয়াতে নারীদেরকেউ দৃষ্টি অবনমিত রাখার ব্যাপারে আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন-
وَقُلْ لِلْمُؤْمِنَاتِ يَغْضُضْنَ مِنْ أَبْصَارِهِنَّ وَيَحْفَظْنَ فُرُوجَهُنَّ
“আর মু’মিন নারীদেরকে বল, তারা তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখবে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হিফাযত করবে।” (সূরা আন-নূর-৩১)
এ আয়াতে ‘দৃষ্টি’ কে আগে আনা হয়েছে কেননা, জ্বেনা ব্যাভিচারের সূত্রপাতই হয় দৃষ্টি থেকে।
আল্লাহর রসুল (সা.) দৃষ্টিকে ইবলিসের তীরের সাথে তুলনা করেছেন,। আর এ দৃষ্টি যদি যৌবনের উত্তাল তরঙ্গমালার সন্ধিক্ষণের ‘দৃষ্টি’ হয় তাহলে তা হয়ে উঠে আরও ভয়াবহ। যৌবনের প্রতিটা মুহুর্তই নারীর সান্নিধ্য পেতে বড়ই ব্যাকুল হয়ে থাকে। মনের মুকুরে ভেসে বেড়ায় অসংখ্য নারীর মুখ। মনের মুকুরে প্রবেশ করার পূর্বেই যদি প্রবেশ পথ দৃষ্টিকে নিয়ন্ত্রিত করা যায় তাহলে কল্পনার ফিল্মে কোন নারীর অবয়ব, অঙ্গ সৌন্দর্য্য ভেঁসে উঠতে পারে না।
উদাহরণ : ক্যামেরার লেন্সের মুখের ঢাকনা বন্ধ থাকলে অভ্যন্তরে সংযুক্ত ফিল্মে যেমন ছবি ধরা পড়ে না তদ্রুপ ‘দৃষ্টি’ নিম্নমুখী তথা নিয়ন্ত্রিত থাকলে অর্থাৎ নারীর সৌন্দর্য্যরে প্রতি দৃষ্টি না পড়লে অন্তর জগতে যৌন বাসনা সৃষ্টি হতে পারে না, সুতরাং নারীর দেহ-সৌন্দর্য্যরে প্রতি দৃষ্টিপাত জ্বেনা-ব্যভিচারের ক্ষেত্র তৈরি করে বিধায় আল্লাহ তা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন। তবে খারাপ নিয়তে দৃষ্টিপাত করা হারাম, খারাপ নয় এমন নিয়তে দেখা মাকরূহ, জরুরী প্রয়োজনে দৃষ্টপাত জায়েজ।
লজ্জাস্থান বা যৌনাঙ্গ সংযত-হেফাজত করার অর্থ কুপ্রবৃত্তি চরিতার্থ করার যত পথ,পন্থা,পদ্ধতি আছে তা থেকে নিজেকে নিবৃত্ত রাখা। এর প্রারম্ভিক কারণ ‘দৃষ্টিপাত’ সর্বশেষ ‘ব্যাভিচার’।
জ্বেনা সম্পর্কে আল্লাহতা‘য়ালা বলেন,
وَلَا تَقْرَبُوْا الزِّنَى إِنَّهُ كَانَ فَاحِشَةً وَسَاءَ سَبِيْلًا
“তোমরা জ্বেনার নিকট বর্তীত্ত হয়োনা, কারণ এটা খুবই খারাপ কাজ এবং অতীব বিকৃষ্ট পথ।” (সূরা বনী ইসরাঈল-৩২)
জ্বেনা ও ব্যাভিচারের মাধ্যমে দাম্পত্য জীবন ও পারিবারিক শান্তি বিঘ্নিত হয়, সামাজ অসভ্য হয়ে পড়ে, সমাজ-পরিবারে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়, কাজেই এ ধরণের পাপের কাজ থেকে ঈমানদারদের বেঁচে থাকতে হবে।
জ্বেনা থেকে বেঁচে থাকার প্রতিফল : হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) রেওয়াতকৃত একটি হাদীসে রাসুল (সা.) যুবকদের উদ্দেশ্যে বলেন,
يَا شَبَابَ قُرَيِشٍ اِحْفَظُوْا فُرُوْجَكُمْ وَلَا تَزْنُوْا الآ مَنْ حَفَظَ فَرْجًهُ فَلَهُ الْجَنَّةَ,,
‘‘হে কুরাইশ যুবকেরা তোমরা লজ্জাস্থান সমূহ হেফাজত কর ব্যভিচার করো না, যারা বিষ্কলুষ ও পবিত্রতার সাথে জীবন যাপন করবে তারা জান্নাতের হকদার হবে। (বায়হাকী, শুয়াবুল ঈমান)
অন্য হাদীসে তাদেরকে আরশের ছায়াতলে স্থান লাভকারীর সৌভাগ্যবান বলে সুসংবাদ দেওয়া হয়েছে-
رَجُلٌ دَعَتُهُ اِمْرَأَةٌ ذَاتَ حَسَبِ وَّ جَمَلٍ فَقَالَ اِنِّ اَخَافُ اللّهَ
“এমন যুবক যাকে পদমর্যাদা সম্পন্না সুন্দরী নারী ব্যভিচারের জন্য আহবান করে আর সেই যুবক বলে আমি আল্লাহকে ভয় করি।” (এমন যুবক আরশের ছায়াতলে আশ্রয় পাবে) (সহীহ আল-বুখারী)।
উপরের ২টি বিষয় আমল করার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে জ্বেনা-ব্যাভিচার থেকে সমাজকে রক্ষা করা।
৬. وَكُفُّوا أَيْدِيَكُمْ
“নিজেদের হাত দু’টিকে নিয়ন্ত্রনে রাখবে।”
হাত নিয়ন্ত্রনে রাখা বা বিরত রাখার অর্থ হচ্ছে যাবতীয় অন্যায় থেকে বিরত রাখা, অন্যায়কে প্রতিহত করা এবং ন্যায়ের প্রতিষ্ঠার জন্য হাতশক্তি ব্যবহার করা।
আল-হাদীসে বর্ণিত হয়েছে-
فَمَنْ جَاهَدَهُمْ بِيَدِهِ فَهُوَ مُؤْمِنٌ وَمَنْ جَاهَدَهُمْ بِلِسَانِهِ فَهُوَ مُؤْمِنٌ وَمَنْ جَاهَدَهُمْ بِقَلْبِهِ فَهُوَ مُؤْمِنٌ وَلَيْسَ وَرَاءَ ذَلِكَ مِنَ الإِيمَانِ حَبَّةُ خَرْدَلٍ,,,
“যে ব্যক্তি হাত দ্বারা জিহাদ করলো সে মুমিন, যে মুখ দ্বারা জিহাদ করলো সে মুমিন এবং যে অন্তর দ্বারা জিহাদ করলো সে মুমিন। আর যে ব্যক্তি এর কোনটিই করলো না তার অন্তরে ষশ্যদানা পরিমান ঈমান নেই।” (সহীহ মুসলিম)
হাত সংযত রাখার আর একটি অর্থ হতে পারে, তাহলোঃ হাত দ্বারা অপর মানুষের কষ্ট না দেয়া। এটাকে অন্যায় কাজে ব্যবহার না করা। এ সম্পর্কে রাসূল (সা.) বলেছেন-
عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عَمْرٍو ، رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ ، عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ : الْمُسْلِمُ مَنْ سَلِمَ الْمُسْلِمُونَ مِنْ لِسَانِهِ وَيَدِهِ,,,
“হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) হতে বর্ণিত রাসূল (সা.) বলেছেন, মুসলমান সেই ব্যক্তি যার হাত ও যবান থেকে অন্য মুসলামান নিরাপদ থাকে।” (সহীহ আল-বুখারী ও মুসলিম)।
আলোচ্য দারসের শিক্ষা হচ্ছে, একজন মু’মিন তার জীবনের প্রতিটা মুহুর্তে উক্ত ৬টি নির্দেশ মেনে চলবে এবং সমাজের মানুষদেরকেও এগুলো মেনে চলার জন্য উদ্বুদ্ধ করবে। এ আদেশগুলো মেনে চললে যেমন রাসূল (সা.) জান্নাতের জন্য বান্দার জন্য সুপারিশ করবেন। ঠিক তেমনি সমাজের সকল মানুষের মধ্যে ভ্রাতৃত্বপূর্ণ ভালবাসা তৈরী হবে এবং সমাজ হবে শান্তির আবাস।
Comments
Post a Comment