দারসুল হাদীস- ৫টি বিষয়ের আগে ৫টি বিষয়কে প্রাধান্য দেওয়াঃ-
**********************************************
عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لِرَجُلٍ وَهُوَ يَعِظُهُ: " اغْتَنِمْ خَمْسًا قَبْلَ خَمْسٍ , شَبَابَكَ قَبْلَ هَرَمِكَ , وَصِحَّتَكَ قَبْلَ سَقَمِكَ , وَغِنَاكَ قَبْلَ فَقْرِكَ , وَفَرَاغَكَ قَبْلَ شُغُلُكَ , وَحَيَاتَكَ قَبْلَ مَوْتِكَ -
অনুবাদ: হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল (সা.) এক ব্যক্তিকে নসিহত করতে গিয়ে বলেছেন, তুমি ৫টি সময়ের পূর্বে ৫টি বিষয়কে গুরুত্ব দাও।
১. বার্ধক্য আসার পূর্বেই যৌবনকে,
২. অসুস্থতা আসার পূর্বেই সুস্থতাকে,
৩. দারিদ্রতা আসার পূর্বেই স্বচ্ছলতাকে,
৪. ব্যস্ততা আসার পূর্বেই অবসরকে এবং
৫. মৃত্যু আসার পূবেই জীবনকে। (বাইহাকী শুআবুল ঈমান)।
রাবী পরিচিতি:
নাম ও পরিচয়: তাঁর নাম আব্দুল্লাহ, পিতার নাম আব্বাস ইবনে আব্দুল মুত্তালিব। আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) ছিলেন রাসূল (সা.) এর চাচাত ভাই এবং একজন বিখ্যাত সাহাবী। মাতার নাম লুবাবা বিনতে হারেস তিনি ছিলেন নবীপত্মী মাইমুনা (রা.) এর বোন। তাই পিতা ও মাতা উভয় দিক থেকেই তিনি ছিলেন রাসূল (সা.) এর আত্মীয়। তিনি ইবনে আব্বাস নামেও পরিচিত।
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) রাসূল (সা.) এর মদিনায় হিজরতের তিন বছর পূর্বে মক্কা নগরীর ‘শিয়াবে আবি তালিবে’ জন্মগ্রহণ করেন। জন্মের পরই তাঁকে রাসূল (সা.) এর নিকট নিয়ে আসা হয় তখন রাসূল (সা.) শিশু আব্দুল্লাহর জন্য দেয়া করেন,
اللًّهُمًّ فَقًّهْهُ فِي الدِّيْنِ وَ عَلَّمْهُ التَّاْوِيْلَ
অর্থ: হে আল্লাহ তুমি তাকে দ্বীনের সঠিক বুঝ দান করো এবং দ্বীনের সঠিক ব্যাখ্যা শক্তি প্রদান করো।
ইসলাম গ্রহণ: তাঁর মাতা লুবাবা বিনতে হারেস হিজরতের পূর্বেই ইসলাম গ্রহণ করেছেন বিধায় হযরত আব্দুল্লাহকে শৈশব থেকেই মুসলিম হিসেবে গণ্য করা হয়। রাসূল (সা.) এর ইন্তেকালের সময় তাঁর বয়স ছিল ১৩/১৪ বছর।
গুণাবলী: তিনি ছিলেন উম্মতের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি এবং একজন বিখ্যাত প-িত, জ্ঞান বিজ্ঞান ও ফিকাহ শাস্ত্রে তিনি অগাধ পা-িত্বের স্বাক্ষর রেখে গেছেন। তাঁর নিকট থেকে খলিফা উমর ও উসমান (রা.) পরামর্শ নিতেন। তাঁর সম্পর্কে হযরত উমর (রা.) বলতেন, ‘তিনি বয়সে নবীন আর জ্ঞানে প্রবীণ।’ তিনি ছিলেন ‘রঈসুল মুফাচ্ছীরীন’ বা মুফাচ্ছীরদের সরদার। বর্ণিত আছে তিনি স্বচক্ষে হযরত জিবরাঈল (আ.) দুই বার দেখেছেন।
রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন: হযরত আলী (রা.) এর শাসনামলে তিনি বসরার গভর্ণর নিযুক্ত হয়েছিলেন। ৩৭ ও ৩৮ হিজরীতে সংঘটিত যথাক্রমে জঙ্গে জামাল ও জঙ্গে সিফ্ফীনে সেনাপতির দায়িত্ব পালন করেন। সিফ্ফীনের যুদ্ধ বন্ধের চুক্তিতে তিনি স্বাক্ষর করেছিলেন।
হাদীসে অবদান: সর্বাধিক হাদীস বর্ণনাকারী ৬জন সাহাবীর অন্যতম হলেন হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.)। তিনি ১৬৬০ টি হাদীস বর্ণনা করেছেন। বুখারী ও মুসলিম যৌথভাবে ৯৫ টি, এককভাবে বুখারীতে ১২০ টি এবং মুসলিমে ৪৯ টি হাদীস উল্লেখ রয়েছে।
ইন্তেকাল: তিনি জীবনের শেষদিকে দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে অন্ধ হয়ে যান এবং ৬৮ হিজরীতে ৭১ বছর বয়সে ইবনে যোবায়েরের শাসনামলে তায়েফে ইন্তেকাল করেন।
হাদীসের ব্যাখ্যা:
অত্র হাদীসে মুমিন জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ৫টি বিষয়কে অগ্রাধিকার দেওয়ার ব্যাপারে রাসূল (সা.) নসিহত করেছেন। নিম্নে এ সম্পর্কে আলোকপাত করা হলোঃ
প্রথম: شَبَابَكَ قَبْلَ هَرَمِكَ “বার্ধক্য আসার আগেই যৌবনকে গুরুত্ব দাও।”
একথা সর্বজন স্বীকৃত যে একজন মানুষের যৌবন হচ্ছে তার সমস্ত কর্ম তৎপরতার উৎস। যৌবন মানুষকে কর্মঠো, দৃঢ়চেতা ও সাহসী করে তোলে। যৌবনের এই সময়ে মানুষ কঠোর পরিশ্রম করতে পারে, দুঃখ কষ্ট সহ্য করতে পারে, ইচ্ছা করলে সকল প্রকার ইবাদত-বন্দেগীও সে করতে পারে। কিন্তু বুড়ো হয়ে গেলে যেমন পরিশ্রম করতে পারে না, তেমনি ভগ্ন স্বাস্থ্য নিয়ে সঠিকভাবে আল্লাহর ইবাদতও করতে পারে না। যৌবন বয়সে মানুষের শরীরে যে শক্তি-সামর্থ থাকে বুড়ো হওয়ার সাথে সাথে সেটা নিঃশেষ হয়ে যায়, তখন অনেক চেষ্টা করেও কোন কাজ করতে পারে না। এজন্য রাসূল (সা.) বলেছেন যৌবনের এ শক্তিকে কাজে লাগাও। বার্ধক্য আসার পূর্বেই যৌবনের শক্তিকে আল্লাহর পথে ব্যয় কর। ইসলামের সুমহান আদর্শের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার জন্য চেষ্টা কর, তাহলেই তুমি নাজাত পাবে।
আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন এই যৌবনকালের শক্তি-সামর্থ কোন পথে ব্যয় হয়েছে সে সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবেন। আল-হাদীসে বর্ণিত হয়েছে-
لاَ تَزُولُ قَدَمَا ابْنِ آدَمَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ مِنْ عِنْدِ رَبِّهِ حَتَّى يُسْأَلَ عَنْ خَمْسٍ عَنْ عُمْرِهِ فِيمَا أَفْنَاهُ وَعَنْ شَبَابِهِ فِيمَا أَبْلاَهُ وَمَالِهِ مِنْ أَيْنَ اكْتَسَبَهُ وَفِيمَ أَنْفَقَهُ وَمَاذَا عَمِلَ فِيمَا عَلِمَ
অর্থ: কিয়ামতের দিন ৫টি প্রশ্নের জবাব না দিয়ে আদম সন্তানকে এক পাও নড়তে দেওয়া হবে না। তাহলোঃ ১. জীবনকাল কোন পথে কীভাবে ব্যয় করেছে, ২. যৌবনের সময়কালকে কীভাবে ব্যয় করেছে, ৩. ধন-সম্পদ কীভাবে উপার্জন করেছে, ৪. উপার্জিত সম্পদ কোন পথে ব্যয় করেছে এবং ৫. দ্বীনের জ্ঞান যতটুকু অর্জন করেছিলো সে অনুযায়ী কতটুকু আমল করেছে। (সূনান আত-তিরমিযি)
আল্লাহর সন্তুষ্টি ও পুরস্কার কঠিন পরিশ্রমের মাধ্যমেই অর্জন করা সম্ভব, আর তা কেবলমাত্র যৌবন বয়সেই করতে পারে। ইসলামে তাই যৌবনের ইবাদতকে সবচেয়ে উত্তম বলা হয়েছে। একটি বর্ণনায় রাসূল (সা.) বলেছেন সাত শ্রেণির লোকের কিয়ামতের দিন আরশের ছায়ায় স্থান দেওয়া হবে এর মধ্যে একটি হলো ঐ যুবকদল যারা আল্লাহর ইবাদতের মধ্য দিয়ে নিজেদের যৌবনকাল অতিবাহিত করেছে। এমনকি রাসূল (সা.) এর ইসলামী বিপ্লবের দাওয়াত সর্ব প্রথম একদল যুবক গ্রহন করে তাঁর হাতকে শক্তিশালি করেছিলেন। তাই আমাদের সকলের উচিৎ এই যৌবনের সময়কে বেশী বেশী আল্লাহর দ্বীনের জন্য ব্যয় করার চেষ্টা করা।
দ্বিতীয়: وَصِحَّتَكَ قَبْلَ سَقَمِكَ “অসুস্থতার পূর্বেই সুস্থতাকে গুরুত্ব দাও।”
অত্র হাদীসে প্রতিটি সুস্থ মূহুর্তকে পরিপূর্ণভাবে সদ্ব্যবহার করার জন্য উৎসাহিত করা হয়েছে। সুস্থতা মানুষের জন্য মহান আল্লাহ তাআলার এক অপার মহিমা। সুস্থ অবস্থায় মানুষ আল্লাহর ইবাদত করার যে সামর্থ রাখে অসুস্থ হলে তার আর সামর্থ থাকেনা। কারণ মানুষের শরীর একটা স্বয়ংক্রীয় যন্ত্র বিশেষ। তাই এ যন্ত্রের একটু ব্যতিক্রম হলেই শরীরে নানা ধরণের বাহ্যিক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়, তার নাম অসুস্থতা। সুস্থতা আল্লাহর একটি বড় নিয়ামত। মানুষ সুস্থ থাকলে সবকিছু করতে পারে কিন্তু অসুস্থ হয়ে গেল আর কোন কাজ করতে পারে না। তাই যখন সে সুস্থ থাকে তখন তাকে নেয়ামত মনে করে ইবাদতে মশগুল হওয়া প্রয়োজন। কেননা সে জানে না যে, বর্তমানে যে অবস্থায় আছে পরবর্তীতে অবস্থা আরো অবনতি হয়ে যেতে পারে। এই অবস্থা সম্পর্কে রাসূল (সা.) অন্য হাদীসে বলেছেন,
عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ ، رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا ، قَالَ : قَالَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم نِعْمَتَانِ مَغْبُونٌ فِيهِمَا كَثِيرٌ مِنَ النَّاسِ الصِّحَّةُ وَالْفَرَاغ.
অর্থ: হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল (সা.) বলেছেন, দুটো নিয়ামত এমন আছে যেগুলোতে অনেক মানুষই ধোকায় পতিত হয়। তার একটি হলো সুস্থতা, আর অপরটি হলো অবসর। (সহীহ আল-বুখারী)
মানুষের সাভাবিক অভ্যাস হচ্ছে সুস্থতা ও অবসরকে হেলায় কাটিয়ে দেয়। সে মনে করে আর একটু সুস্থ হলে এবং আর একটু অবসর হলেই কাজটি ভালোভাবে করে ফেলব এই মনে করে সে আরো কাজ জমিয়ে ফেলে কিন্তু পরক্ষণেই দেখা গেলো সে আরো অসুস্থ হয়ে পড়েছে এবং আরো ব্যস্থ হয়ে পড়েছে। কাজেই সে ঐ কাজটি আর সম্পন্ন করতে পারে না। এজন্যই আল্লাহর রাসূল (সা.) এই নিয়ামতের গুরুত্ব দিয়ে সময়ের কাজ সময়ের মধ্যেই সম্পন্ন করার জন্য তাগিদ দিয়েছেন।
তৃতীয়: وَغِنَاكَ قَبْلَ فَقْرِكَ “দারিদ্রতার পূর্বেই স্বচ্ছলতাকে গুরুত্ব দাও।”
অর্থনীতির পরিভাষায় ‘অভাব অফুরন্ত’। মানুষের অভাব একটি পুরণ হলে আর একটি এসে হাজির হয়। এজন্য সে মনে করে আর একটু স্বচ্ছল হলে অমুক ভালো কাজটি করব। কিন্তু সে জানে না বর্তমানের চেয়ে সে আরো দরিদ্র হয়ে যেতে পারে। মানব দেহে যেমন যে কোন সময় অসুস্থতা আসতে পারে, ঠিক তেমনি যে কোন সময় মানব জীবনে দারিদ্রতাও এসে যেতে পারে। কারণ স্বচ্ছলতা এবং অস্বচ্ছলতা এর কোনটাই মানুষের নিয়ন্ত্রণে নেই। এগুলো নিয়ন্ত্রণ করছেন স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামীন। আল-কুরআনে এ সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে,
إِنَّ رَبَّكَ يَبْسُطُ الرِّزْقَ لِمَنْ يَشَاءُ وَيَقْدِرُ إِنَّهُ كَانَ بِعِبَادِهِ خَبِيرًا بَصِيرًا
“নিশ্চয় তোমার রব যাকে ইচ্ছা করেন তার রিযিক বাড়িয়ে দেন। যাকে ইচ্ছা করেন তার রিযিক সংকীর্ণ করে দেন। তিনি অবশ্যই তাঁর বান্দাদের সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞাত, পূর্ণ দ্রষ্টা।” (সুরা বনী ইসরাইল-৩০)
অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন,
وَاللَّهُ يَرْزُقُ مَنْ يَشَاءُ بِغَيْرِ حِسَابٍ
অর্থ: আর আল্লাহ যাকে চান, বেহিসাব রিয্ক দান করেন। (সূরা আল-বাকারা-২১২)।
আল-কুরআনের ভাষ্যানুযায়ী আল্লাহ তাআলা যাকে ইচ্ছা তাকে সম্মান দান করেন, রিযিক দান করেন, আবার যাকে ইচ্ছা তার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেন।
قُلِ اللَّهُمَّ مَالِكَ الْمُلْكِ تُؤْتِي الْمُلْكَ مَنْ تَشَاءُ وَتَنْزِعُ الْمُلْكَ مِمَّنْ تَشَاءُ وَتُعِزُّ مَنْ تَشَاءُ وَتُذِلُّ مَنْ تَشَاءُ بِيَدِكَ الْخَيْرُ إِنَّكَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ (২৬) تُولِجُ اللَّيْلَ فِي النَّهَارِ وَتُولِجُ النَّهَارَ فِي اللَّيْلِ وَتُخْرِجُ الْحَيَّ مِنَ الْمَيِّتِ وَتُخْرِجُ الْمَيِّتَ مِنَ الْحَيِّ وَتَرْزُقُ مَنْ تَشَاءُ بِغَيْرِ حِسَابٍ
অর্থ: বল, ‘হে আল্লাহ, রাজত্বের মালিক, আপনি যাকে চান রাজত্ব দান করেন, আর যার থেকে চান রাজত্ব কেড়ে নেন এবং আপনি যাকে চান সম্মান দান করেন। আর যাকে চান অপমানিত করেন, আপনার হাতেই কল্যাণ। নিশ্চয় আপনি সব কিছুর উপর ক্ষমতাবান’। আপনি রাতকে দিনের মধ্যে প্রবেশ করান এবং দিনকে রাতের মধ্যে প্রবেশ করান। আর মৃত থেকে জীবিতকে বের করেন এবং জীবিত থেকে মৃতকে বের করেন। আর যাকে চান বিনা হিসাবে রিয্ক দান করেন’। (সূরা আলে-ইমরান-২৬-২৭)
এ কথা মনে রাখতে হবে, কখন আপনার অর্থ সম্পদ আপনার হাত থেকে চলে যাবে, কখন আপনি দরিদ্র হয়ে যাবেন তার কোন নিশ্চয়তা নেই। তাই যে কোন সময় দারিদ্রতা এসে যেতে পারে এই চিন্তা করে অর্থ-সম্পদ আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করে পরকালের পাথেয় সংগ্রহ করার চেষ্টা করতে হবে। কারণ আগামী কাল কি হবে এর কোন তথ্যই মানুষের কাছে নেই। আল্লাহ তাআলা বলেন,
إِنَّ اللَّهَ عِنْدَهُ عِلْمُ السَّاعَةِ وَيُنَزِّلُ الْغَيْثَ وَيَعْلَمُ مَا فِي الْأَرْحَامِ وَمَا تَدْرِي نَفْسٌ مَاذَا تَكْسِبُ غَدًا وَمَا تَدْرِي نَفْسٌ بِأَيِّ أَرْضٍ تَمُوتُ إِنَّ اللَّهَ عَلِيمٌ خَبِيرٌ
অর্থ: নিশ্চয় আল্লাহর নিকট কিয়ামতের জ্ঞান রয়েছে। আর তিনি বৃষ্টি বর্ষণ করেন এবং মাতৃগর্ভে যা আছে তা তিনি জানেন। আর কেউ জানে না আগামীকাল সে কী অর্জন করবে এবং কেউ জানে না কোন্ স্থানে সে মারা যাবে। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সম্যক অবহিত। (সূরা লুকমান-৩৪)
আল-হাদীসে বর্ণিত হয়েছে-
عَنِ ابْنِ عُمَرَ ، عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ : مَفَاتِيحُ الْغَيْبِ خَمْسٌ لاَ يَعْلَمُهَا إِلاَّ اللَّهُ لاَ يَعْلَمُ مَا تَغِيضُ الأَرْحَامُ إِلاَّ اللَّهُ ، وَلاَ يَعْلَمُ مَا فِي غَدٍ إِلاَّ اللَّهُ ، وَلاَ يَعْلَمُ مَتَى يَأْتِي الْمَطَرُ أَحَدٌ إِلاَّ اللَّهُ ، وَلاَ تَدْرِي نَفْسٌ بِأَيِّ أَرْضٍ تَمُوتُ إِلاَّ اللَّهُ ، وَلاَ يَعْلَمُ مَتَى تَقُومُ السَّاعَةُ إِلاَّ اللَّهُ.
অর্থ: ইবনে উমার (রা.) নবী করীম (সা.) হতে বর্ণনা করেন, রাসূল (সা.) বলেছেন, গাইব বা অদৃশ্যের চাবিকাঠি পাঁচটি যথা- ১. আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না যে মায়ের গর্ভে কি তৈরী হচ্ছে। ২. শুধু তিনিই জানেন যে, আগামী কাল কী হবে। ৩. বৃষ্টি কখন হবে তাও কেবল তারই জানা। ৪. কোন প্রাণী জানে না যে, কোথায় তার মৃত্যু হবে এবং ৫. এটাও জানে না যে, কিয়ামত কবে হবে। (সহীহ আল-বুখারী)
আল্লাহ মানুষকে যে অবস্থায় রাখুন না কেন, সে অবস্থাতেই নিজেকে অপেক্ষাকৃত স্বচ্ছল মনে করতে হবে। কেননা আল্লাহ যদি চাইতেন তাহলে এর চেয়ে আরো খারাপ অবস্থার সম্মুখীন করতে পারতেন। তাই স্বচ্ছল ও অস্বচ্ছল উভয় অবস্থায় আল্লাহর পথে দান-সাদকা করা উচিত। বিশেষ করে স্বচ্ছলতার সময় কৃতজ্ঞতা স্বরূপ বিশেষ দান করা উচিত।
চতুর্থ: وَفَرَاغَكَ قَبْلَ شُغُلُكَ “ব্যস্ততা আসার পূর্বেই অবসরকে গুরুত্ব দাও।”
হাদীসের এ অংশে অবসরকে গুরুত্ব দিতে বলা হয়েছে। তবে মনে রাখতে হবে ব্যস্ততা ও অবসর দু’টোই বান্দাহর জন্য নেয়ামত। ব্যস্ততা এজন্য নেয়ামত যে, ব্যস্ততা মানুষের অনেক অন্যায় ও বেহুদা কাজ থেকে বিরত রাখে। আর অবসর এই অর্থে নিয়ামত যে, সে এই অবসরে অনেক ভালো কাজ সম্পন্ন করে নেকী লাভ করতে পারেন। ব্যস্ততা মানব জীবনের সাথে ওৎপ্রোতভাবে জড়িত। কার কখন ব্যস্ততা এসে যাবে এটা কেউ বলতে পারেনা। আর অত্যাধিক ব্যস্ততা মানুষকে অনেক প্রয়োজনীয় কাজ থেকে অপারগ বানিয়ে ফেলে। এটাকে মনে রেখেই মানুষকে কর্ম পরিকল্পনা করতে হবে। মানব জীবনের একটি দূর্বলতা বা প্রবণতা আছে কোন কাজ তার সামনে এলে মনে করে একটু পরে কাজটি করে ফেলব। কিন্তু দেখা যায় একটু পরেই তার সামনে আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ উপস্থিত হয়ে গেল। সেটা শেষ করতে না করতেই আরো একটা উপস্থিত হলো। এভাবে প্রথম যে কাজটি অনায়াসে করা যেতো, সেটা করার কোন সুযোগই পাওয়া যায় না। তাই যখন সুযোগ পাওয়া যায় তখনই কাজটি সম্পন্ন করে ফেলা উচিত।
অনুরূপভাবে আল্লাহর ইবাদতের ব্যাপারেও যদি কেউ মনে করে এখন না, একটু পরে ইবাদতটা করব, তার পরিণতিও অনুরূপ। সে ইবাদতটি করার সুযোগ আর নাও পেতে পারে। এভাবে প্রতিনিয়ত মানুষের যে সময় অতীত হয়ে যাচ্ছে সে সময় আর কখনও ভবিষ্যতে ফিরে আসবে না। তাই বর্তমানে যে সময়টা অবসর আছে এটাকে নেয়ামত মনে করে অপেক্ষাকৃত বেশী গুরুত্বপূর্ণ এবং অধিক লাভজনক কাজ গুলো সম্পন্ন করাই বুদ্ধিমানের কাজ।
পঞ্চম: وَحَيَاتَكَ قَبْلَ مَوْتِكَ “মৃত্যু আসার পূর্বেই জীবনকে গুরুত্ব দাও।”
মায়ের পেট থেকে পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হওয়া মাত্রই মানুষের জীবন শুরু হয় এবং মৃত্যুর মাধ্যমে তার জীবনের অবসান ঘটে। তবে পৃথিবী নামক এই গ্রহে কার অবস্থান কতটুকু সময় তা আমরা কেউ বলতে পারব না। কারণ জীবন-মৃত্যুর মালিক একমাত্র আল্লাহ তাআলা। কে কখন কিভাবে মৃত্যু বরণ করবে এটা আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানে না। আল্লাহ তাআলা আল-কুরআনে এ সম্পর্কে বলেছেন,
قُلْ إِنَّ الْمَوْتَ الَّذِي تَفِرُّونَ مِنْهُ فَإِنَّهُ مُلَاقِيكُمْ
অর্থ: বল যে মৃত্যু হতে তোমরা পলায়ন করছ তা অবশ্যই তোমাদের সাথে সাক্ষাৎ করবে। (সূরা জুমুআ-৮)
অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন,
قُلْ لَوْ كُنْتُمْ فِي بُيُوتِكُمْ لَبَرَزَ الَّذِينَ كُتِبَ عَلَيْهِمُ الْقَتْلُ إِلَى مَضَاجِعِهِمْ
অর্থ: বল, ‘তোমরা যদি তোমাদের ঘরে থাকতে তাহলেও যাদের ব্যাপারে নিহত হওয়া অবধারিত রয়েছে, অবশ্যই তারা তাদের নিহত হওয়ার স্থলের দিকে বের হয়ে যেত। (সূরা আলে-ইমরান-১৫৪)
অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, মানুষের মৃত্যুর সময় আল্লাহ তাআলা নির্ধারিত করে রেখেছেন। এই নির্ধারিত সময়ের আগেও মৃত্যু হবে না এবং এর পরেও হবেনা। আল্লাহর বাণী-
وَلِكُلِّ أُمَّةٍ أَجَلٌ فَإِذَا جَاءَ أَجَلُهُمْ لَا يَسْتَأْخِرُونَ سَاعَةً وَلَا يَسْتَقْدِمُونَ
অর্থ: আর প্রত্যেক জাতির রয়েছে একটি নির্দিষ্ট সময়। অতঃপর যখন তাদের সময় আসবে, তখন তারা এক মুহূর্ত বিলম্ব করতে পারবে না এবং এগিয়েও আনতে পারবে না। (সূরা আরাফ-৩৪)
একজন আরবী কবি বলেছেন,
“মৃত্যু হলো এমন এক পেয়ালা যার স্বাদ সকল মানুষকেই আস্বাদন করতে হবে
আর কবর হলো এমন বাড়ি যে বাড়িতে সকলকেই প্রবেশ করতে হবে।”
উপরোক্ত আয়াত ও কবির বক্তব্য অনুযায়ী মৃত্যু কখন আসবে সেটা একমাত্র আল্লাহ জানেন, তাই আমাদের সব সময় মৃত্যুর কথা স্মরণে রেখে পরকালীন পাথেয় সংগ্রহের জন্য চেষ্টা করে যেতে হবে, কারণ মৃত্যুর ঘন্টা বেজে গেলে আর কোন ভালো কাজ করা সম্ভব হবে না। আল-কুরআনে এ সম্পর্কে বলা হয়েছে,
وَأَنْفِقُوا مِنْ مَا رَزَقْنَاكُمْ مِنْ قَبْلِ أَنْ يَأْتِيَ أَحَدَكُمُ الْمَوْتُ فَيَقُولَ رَبِّ لَوْلَا أَخَّرْتَنِي إِلَى أَجَلٍ قَرِيبٍ فَأَصَّدَّقَ وَأَكُنْ مِنَ الصَّالِحِينَ (১০) وَلَنْ يُؤَخِّرَ اللَّهُ نَفْسًا إِذَا جَاءَ أَجَلُهَا وَاللَّهُ خَبِيرٌ بِمَا تَعْمَلُونَ
অর্থ: আর আমি তোমাদেরকে যে রিযক দিয়েছি তা থেকে ব্যয় কর, তোমাদের কারো মৃত্যু আসার পূর্বে। কেননা তখন সে বলবে, হে আমার রব, যদি আপনি আমাকে আরো কিছু কাল পর্যন্ত অবকাশ দিতেন, তাহলে আমি দানÑসদাকা করতাম। আর সৎ লোকদের অন্তর্ভুক্ত হতাম। আর আল্লাহ কখনো কোন প্রাণকেই অবকাশ দেবেন না, যখন তার নির্ধারিত সময় এসে যাবে। আর তোমরা যা কর সে সম্পর্কে আল্লাহ সম্যক অবহিত। (সূরা মুনাফিকুন-১০-১১)
উপরের বক্তব্য থেকে অনুধাবন করা যায়, মানুষের মৃত্যুর কোন গ্যারান্টি নেই, তাই এখনই মৃত্যু এসে যেতে পারে এই চিন্তা করে জীবনের প্রতিটি মুহুর্তকে কাজে লাগানোই হচ্ছে মুমিন জীবনের প্রধানতম কাজ।
আমাদের মনে রাখা দরকার, উক্ত হাদীসে উল্লেখিত পাঁচটি বিষয়ের প্রত্যেকটিই গুরুত্বপূর্ণ এবং একটি আর একটির পরিপূরক, তবে শেষের বিষয়টা সবচেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ কারণ এর মধ্যে অন্য ৪টি বিষয় বিদ্যমান রয়েছে। মানুষের সুস্থতা-অসুস্থতা, ব্যবস্ততা-অবসর, স্বচ্ছলতা-অস্বচ্ছলতা, যৌবন-বার্ধক্য সবই জীবনেরই একটা মুহুর্তের অংশ। তাই সর্ববস্থায় মৃত্যুকে স্মরণ করে নিজের জীবনের প্রতিটা কাজ করলে বাকী চারটার গুরুত্বও দেওয়া হয়ে যায়।
উপরোক্ত দারসূল হাদীস থেকে আমাদের জন্য শিক্ষা হচ্ছে, যৌবনই হলো পরকালীন সাফল্য অর্জন করার সর্বত্তোম সময়, কাজেই এটাকে ভালো কাজে ব্যয় করে আল্লাহর নৈকট্য লাভের চেষ্টা করা। সুস্থতা ও অবসর সময়কে কুরআন-হাদীসের জ্ঞান চর্চা ও দ্বীনের প্রচার-প্রসারে আত্মনিয়োগ করা। যে কোন সময় অস্বচ্ছল হয়ে যেতে পারি এই চিন্তা করে বেশী বেশী আল্লাহর পথে অর্থ খরচ করার চেষ্টা করা। সর্বপরি মৃত্যুর কথা চিন্তা করে জীবনের প্রতিটা মুহুর্ত ‘আমলে সালেহ’ বা ভালো কাজে ব্যয় করার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া প্রয়োজন। আল্লাহ আমাদের তৌফিক দান করুন। আমীন।
আলহামদুলিল্লাহ
ReplyDeleteআলহামদুলিল্লাহ খুব সুন্দর তথ্যবহুল পোস্ট
ReplyDelete