আল্লাহ কোথায়? শুধু কি আরশে, নাকি সবখানে?
**********************************
মানব সৃষ্টির সূচনা থেকে বর্তমানকাল পর্যন্ত খুব অল্প সংখ্যক মানুষই আল্লাহর অস্তিত্ব অস্বীকার করেছে। ফেরাউন, নমরুদ এবং এদের মতো আরো যারা ছিল, তারা কেউ আল্লাহর অস্তিত্বে অবিশ্বাসী ছিলনা। তারা কখনো এ কথা বলেনি যে, এই গোটা বিশ্ব আমি সৃষ্টি করেছি। বরং তারা বলেছে, কোরআনের ভাষায়- আমিই তোমাদের শ্রেষ্ঠ রব। আমার চেয়ে শক্তিশালী আর কেউ নেই।
অর্থৎ তারা দাবী করেছে,‘ এই বিশাল ভূখন্ডের শাসক হিসাবে দেশের জনগণের ওপরে আইন ও বিধান চলবে আমার। এখানে অন্য কারো আইন কানুন চলবে না। জনগণ অন্য কারো আইন অনুসরণ করতে পারে না। আইন চলবে একমাত্র আমার এবং আমাকেই ইলাহ হিসাবে পূজা অর্চনা করতে হবে। মাথানত করতে হবে একমাত্র আমার কাছে। ’ এভাবে দেশের জনগোষ্ঠী আল্লাহকেও বিশ্বাস করেছে, সেই সাথে তারা আল্লাহর অংশীদার বানিয়েছে।
আল্লাহ তা’আলা ভুলত্রুটি ক্ষমা করুন। এটি খুবই সূক্ষ্ম বিষয়। এ বিষয় নিয়ে কথা বলতে পূর্ববর্তী মনীষীবৃন্দ নিষেধ করেছেন। বলা যায় এটি একটি বিদ’আতি আলোচনা। এ বিষয়ে কথা বলা বিদ’আত। এমনটি-ই আমরা পূর্ববর্তী মুহাক্কিক আলেম-মণ্ডলী থেকে দেখতে পাই। হযরত ইমাম মালিক (রহ:) বলেন —
ﺍﻻﺳﺘﻮﺍﺀ ﻣﻌﻠﻮﻡ ﻭﺍﻟﻜﻴﻔﻴﺔ ﻣﺠﻬﻮﻟﺔ، ﻭﺍﻟﺴﺆﺍﻝ ﻋﻨﻪ ﺑﺪﻋﺔ،ﻭﺍﻻﻳﻤﺎﻥ ﺑﻪ ﻭﺍﺟﺐ,
অর্থাৎ, “আল্লাহ তা’আলার আরশে ইস্তিওয়া এর বিষয়টি জানা যায়, কিন্তু অবস্থা অজানা। এ বিষয়ে প্রশ্ন করা বিদ’আত। আর এ বিষয়ে ঈমান রাখা ওয়াজিব”। যেহেতু এটি খুবই সঙ্গীন একটি বিষয়। আর আল্লাহ তা’আলা আছেন, তিনি সব কিছু দেখছেন, তিনি আমাদের ওপর ক্ষমতাশীল, এসব আমাদের মূল ঈমানের বিষয়। তিনি কোন্ অবস্থায় আছেন? এসব আমাদের ঈমানের মূল বিষয় নয়। তাই এটি নিয়ে অযথা কথোপকথনে লিপ্ত হওয়া কিছুতেই উচিত নয়। খুবই গর্হিত কাজ।
কিন্তু কুরআন শরীফের মুতাশাবিহ তথা অস্পষ্ট আয়াত নিয়ে ধুম্রজাল সৃষ্টি করা, এসবকে মূল প্রাতিপাদ্য বিষয় বানানো যে এক শ্রেণীর ফিতনাবাজদের মূল মিশন, তা আল্লাহ তা’আলা পবিত্র কুরআনেই জানিয়ে দিয়েছেন। ইরশাদ হচ্ছে —
ﻫُﻮَ ﺍﻟَّﺬِﻱ ﺃَﻧﺰَﻝَ ﻋَﻠَﻴْﻚَ ﺍﻟْﻜِﺘَﺎﺏَ ﻣِﻨْﻪُ ﺁﻳَﺎﺕٌ ﻣُّﺤْﻜَﻤَﺎﺕٌ ﻫُﻦَّ ﺃُﻡُّ ﺍﻟْﻜِﺘَﺎﺏِ ﻭَﺃُﺧَﺮُ ﻣُﺘَﺸَﺎﺑِﻬَﺎﺕٌ ۖ ﻓَﺄَﻣَّﺎ ﺍﻟَّﺬِﻳﻦَ ﻓِﻲ ﻗُﻠُﻮﺑِﻬِﻢْ ﺯَﻳْﻎٌ ﻓَﻴَﺘَّﺒِﻌُﻮﻥَ ﻣَﺎ ﺗَﺸَﺎﺑَﻪَ ﻣِﻨْﻪُ ﺍﺑْﺘِﻐَﺎﺀَ ﺍﻟْﻔِﺘْﻨَﺔِ ﻭَﺍﺑْﺘِﻐَﺎﺀَ ﺗَﺄْﻭِﻳﻠِﻪِ ۗ ﻭَﻣَﺎ ﻳَﻌْﻠَﻢُ ﺗَﺄْﻭِﻳﻠَﻪُ ﺇِﻟَّﺎ ﺍﻟﻠَّﻪُ ۗ ﻭَﺍﻟﺮَّﺍﺳِﺨُﻮﻥَ ﻓِﻲ ﺍﻟْﻌِﻠْﻢِ ﻳَﻘُﻮﻟُﻮﻥَ ﺁﻣَﻨَّﺎ ﺑِﻪِ ﻛُﻞٌّ ﻣِّﻦْ ﻋِﻨﺪِ ﺭَﺑِّﻨَﺎ ۗ ﻭَﻣَﺎ ﻳَﺬَّﻛَّﺮُ ﺇِﻟَّﺎ ﺃُﻭﻟُﻮ ﺍﻟْﺄَﻟْﺒَﺎﺏِ [ ٣ : ٧ ],,,
অর্থাৎ, তিনি-ই আপনার প্রতি কিতাব নাযিল করেছেন। তাতে কিছু আয়াত রয়েছে সুস্পষ্ট, সেগুলোই কিতাবের আসল অংশ। আর অন্যগুলো রূপক। সুতরাং যাদের অন্তরে কুটিলতা রয়েছে, তারা অনুসরণ করে ফিৎনা বিস্তার এবং অপব্যাখ্যার উদ্দেশ্যে তন্মধ্যেকার রূপকগুলোর। আর সেগুলোর ব্যাখ্যা আল্লাহ ছাড়া কেউই জানে না। আর যারা জ্ঞানে সুগভীর, তারা বলেন: আমরা এর প্রতি ঈমান এনেছি। এ সবই আমাদের পালনকর্তার পক্ষ থেকে অবতীর্ণ হয়েছে। আর বোধশক্তিসম্পন্ন ব্যক্তিবর্গ ছাড়া অপর কেউ শিক্ষা গ্রহণ করে না। {সূরা আলে ইমরান-৭}।
আল্লাহ তা’আলা কোথায় আছেন?
এটি কুরআনের একটি মুতাশাবিহাত তথা রূপক শব্দের অন্তর্ভুক্ত। তাই আমাদের পূর্ববর্তী মুহাক্কিকবৃন্দ এ ব্যাপারে অতিমাত্রা গবেষণা থেকে নিজেদের বিরত রেখেছেন। কিন্তু যাদের মনে কুটিলতা আছে তারা ফিতনা বিস্তারের জন্যে এ সবকেই প্রচারণার মূল টার্গেট বানিয়ে কাজ করে যায়। সেই কুটিল সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত প্রচলিত বিদ’আতি ফিরকা কথিত আহলে হাদীস। যাদের কাজই হল মুতাশাবিহ এবং মতভেদপূর্ণ বিষয়কে মানুষের সামনে তুলে ধরে ফিতনা ও বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা। যেহেতু এ বিষয়ে ফেইসবুকে লিখালিখি হচ্ছে, তাই আহলে সুন্নাতের বক্তব্য তুলে ধরার প্রয়াস।
তাই বাধ্য হয়ে এ বিষয়ে কলম ধরলাম।
আল্লাহ তা’আলা ক্ষমাশীল। আমাদের ভুলগুলো ক্ষমা করে দিয়ে তাঁর প্রিয়ভাজন হবার পথে অগ্রসর হবার তৌফিক দান করুন, আমীন!
আমরা বিশ্বাস করি, আল্লাহ তায়ালা সর্বত্র বিরাজমান। কিন্তু কথিত আহলে হাদীস সম্প্রদায় প্রচার করে থাকে, আল্লাহ তায়ালা সর্বত্র বিরাজমান নয়। তারা দলীল হিসেবে নিচের কোরানের আয়াত ও হাদীসগুলো পেশ করে থাকে।
১) আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ-
إِنَّ رَبَّكُمُ اللّهُ الَّذِي خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضَ فِي سِتَّةِ أَيَّامٍ ثُمَّ اسْتَوَى عَلَى الْعَرْشِ,,,
নিশ্চয়ই তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহ যিনি আসমান সমূহ ও যমীন ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তিনি আরশের উপর উঠেছেন। [সূরা আরাফ, আয়াত ৫৪] [সূরা ইউনুস, আয়াত ৩]
২) তিনি আরো বলেনঃ
اللَّهُ الَّذِي رَفَعَ السَّمَاوَاتِ بِغَيْرِ عَمَدٍ تَرَوْنَهَا ثُمَّ اسْتَوَى عَلَى الْعَرْش,,,
আল্লাহ যিনি আসমান সমূহ উপরে স্থাপন করেছেন খুঁটি ছাড়া, তোমরা তা দেখছো। অতঃপর তিনি আরশের উপর উঠেছেন। [সূরা রাদ, আয়াত ২]
উল্লেখিত আয়াতগুলো দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, আল্লাহ তায়ালা আরশে সমুন্নত আছেন। কিভাবে সমুন্নত আছেন, এ কথা বলতে নিষেধ করা হয়েছে।
ইমাম মালেক রহিমাহুল্লাহ বলেনঃ “কাইফিয়াত বা (সমুন্নত হওয়ার) পদ্ধতি অজ্ঞাত আর ইসতাওয়া বা সমুন্নত হওয়াটা জ্ঞাত। এর প্রতি ঈমান আনা ওয়াজিব এবং এ বিষয়ে প্রশ্ন করা বিদআত”।[ইমাম বাইহাক্বীর আল আসমা ওয়াস সিফাত, পৃষ্ঠা ৪০৮ ।। তামহীদ ৭/১৫১]
৩) আল্লাহ তায়ালা আসমানের উপর আছেন। এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ
أَمْ أَمِنْتُمْ مَنْ فِي السَّمَاءِ أَنْ يُرْسِلَ عَلَيْكُمْ حَاصِبًا فَسَتَعْلَمُونَ كَيْفَ نَذِيرِ,,,
অথবা তোমরা কি নিরাপদ হয়ে গেছো যে, আকাশের উপর যিনি রয়েছেন তিনি তোমাদের উপর পাথর বর্ষণকারী ঝঞ্ঝা বায়ু প্রেরণ করবেন না? তখন তোমরা জানতে পারবে কিরূপ ছিল আমার সতর্কবাণী”। [সূরা মুলক, আয়াত ১৭]।
হাদীস শরীফ থেকেঃ- (৪)
عَنْ مُعَاوِيَةَ بْنِ الْحَكَمِ السُّلَمِيِّ، قَالَ وَكَانَتْ لِي جَارِيَةٌ تَرْعَى غَنَمًا لِي قِبَلَ أُحُدٍ وَالْجَوَّانِيَّةِ فَاطَّلَعْتُ ذَاتَ يَوْمٍ فَإِذَا الذِّيبُ قَدْ ذَهَبَ بِشَاةٍ مِنْ غَنَمِهَا وَأَنَا رَجُلٌ مِنْ بَنِي آدَمَ آسَفُ كَمَا يَأْسَفُونَ لَكِنِّي صَكَكْتُهَا صَكَّةً فَأَتَيْتُ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم فَعَظَّمَ ذَلِكَ عَلَىَّ قُلْتُ يَا رَسُولَ اللَّهِ أَفَلاَ أُعْتِقُهَا قَالَ " ائْتِنِي بِهَا " . فَأَتَيْتُهُ بِهَا فَقَالَ لَهَا " أَيْنَ اللَّهُ " . قَالَتْ فِي السَّمَاءِ . قَالَ " مَنْ أَنَا " . قَالَتْ أَنْتَ رَسُولُ اللَّهِ . قَالَ " أَعْتِقْهَا فَإِنَّهَا مُؤْمِنَةٌ " .
অর্থঃ- মু’আবিয়া বিন আল হাকাম আস সুলামী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ আমার এক দাসী ছিল। সে উহুদ ও জাওওয়ানিয়্যাহ এলাকায় আমার বকরীপাল চরাতো। একদিন আমি হঠাৎ সেখানে গিয়ে দেখলাম তার বকরীপাল থেকে বাঘে একটি বকরী নিয়ে গিয়েছে। আমি তো অন্যান্য আদম সন্তানের মত একজন মানুষ। তাদের মত আমিও ক্ষোভ ও চপেটাঘাত করলাম। এরপর আমি রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর কাছে আসলাম (এবং সব কথা বললাম) কেননা বিষয়টি আমার কাছে খুবই গুরুতর মনে হলো। আমি জিজ্ঞেস করলামঃ হে আল্লাহর রসূল, আমি কি তাকে মুক্ত করে দিবো? তিনি বললেনঃ তাকে আমার কাছে নিয়ে আসো। সুতরাং আমি তাকে এনে রসূলুল্লাহর কাছে হাজির করলাম।
তিনি তাকে (দাসীকে) জিজ্ঞেস করলেনঃ আল্লাহ কোথায়?
সে বললঃ আকাশে। নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ আমি কে?
সে বললঃ আপনি আল্লাহর রসূল। তখন রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাকে বললেনঃ তুমি তাকে মুক্ত করে দাও, সে একজন মুমিনাহ নারী। [সহীহ মুসলিম, অনুচ্ছেদঃ মসজিদ ও সালাতের স্থান সমূহ, হাদিস নং ১০৮৬]।
৫) আনাস বিন মালেক রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেনঃ যয়নব (রাদিয়াল্লাহু আনহা) নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর অন্যান্য স্ত্রীগণের উপর গর্ব করে বলতেন যে, তাঁদের বিয়ে তাঁদের পরিবার দিয়েছে আর আমার বিয়ে আল্লাহ সপ্তম আসমানের উপর থেকে সম্পাদন করেছেন।
[সহীহ বুখারী, অধ্যায়ঃ তাওহীদ, হাদিস নং ৭৪২০]
সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ১০৮৬।
৬) আব্দুল্লাহ ইবন আমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ
ارْحَمُوا مَنْ فيِ الارضِ يَرْحَمكٌمْ مَنْ في السَّمَاء,,,
যমীনে যারা আছে তাদের প্রতি দয়া কর, আকাশে যিনি আছেন (আল্লাহ) তিনি তোমাদের প্রতি দয়া করবেন।
[তিরমিযী, হাদিস নং ১৮৪৭ ।। আবু দাউদ, হাদিস নং ৪২০৯]
৭) ইমাম আবু হানীফা রহিমাহুল্লাহ আরো বলেনঃ আল্লাহ তায়ালা উপর থেকে বান্দার আহ্বানে সাড়া দেন, নিচ থেকে নয়। কেননা নিচ রুবুবিয়্যাহ ও উলুহিয়্যাতের কোন গুণের মধ্যে পড়ে না। [আল ফিকহুল আবসাত, পৃষ্ঠা ৫১]
৮। ইমাম আবু হানীফা রহিমাহুল্লাহ বলেনঃ যে ব্যক্তি বলবে আল্লাহ আসমানে আছেন নাকি যমীনে আছেন আমি তা জানি না, সে কুফরী করবে। অনুরূপভাবে যে বলবে আল্লাহ আরশে আছেন কিন্তু তাঁর আরশ আসমানে নাকি যমীনে আমি তা জানি না, সেও কুফরী করবে। [আল ফিকহুল আবসাত, পৃষ্ঠা ৪৬ ।। মাজমুউ ফাতওয়া ইবনু তাইমিয়্যাহ, ৫/৪৮ পৃষ্ঠা]।
৯) ইমাম মালিক রহিমাহুল্লাহ বলেছেনঃ আল্লাহ হচ্ছেন আসমানে আর তাঁর জ্ঞান সব জায়গায় বিরাজমান। [মাসায়িলি ইমাম আহমাদ, পৃষ্ঠা ২৬৩ ।। ইবনু আব্দিল বার বর্ণনা করেছেন আত তামহিদ, ৭/১৩৮]
১০) ইমাম শাফেঈ বলেছেনঃ ঐ সুন্নাহ বা রীতির ব্যাপারে কথা হলো যে সুন্নাহ বা রীতির উপর আমি আছি এবং আমার সাথীদেরকে দেখেছি তার উপর। আর আহলে হাদিসদেরকে দেখেছি যাদের কাছ থেকে আমি ইলম গ্রহণ করেছি যেমন সুফইয়ান, মালিক এবং অন্যান্যরা তারা ঐ বিধানের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। আর তা হল এ স্বীকৃতি দেয়াঃ আল্লাহ ছাড়া প্রকৃতপক্ষে কোন ইলাহ নেই। নিশ্চয়ই মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহর রাসূল। এবং আল্লাহ তায়ালা আসমানে আরশের উপর রয়েছেন। তিনি যেভাবে ইচ্ছা তার সৃষ্ট জীবের নিকটবর্তী হন এবং আল্লাহ যেভাবে ইচ্ছা সেভাবেই দুনিয়ার আসমানে নামেন।
[ইজতিমাউল জুউশিল ইসলামী, পৃষ্ঠা ১৬৫। ইসবাতুল উলু, পৃষ্ঠা ১২৪]
১১) ইমাম আহমাদ রহিমাহুল্লাহ বলেনঃ আল্লাহ তায়ালা যেভাবে তিনি চান সেভাবেই তিনি আরশে রয়েছেন। আমরা এর প্রতি বিশ্বাস আনবো এর কোন সীমা বা সিফাত বর্ণনা করা ব্যতীত। কেননা আরশে সমাসীন হওয়া আল্লাহর একটি সিফাত। আর আল্লাহর সিফাত ঐ ভাবেই বর্ণনা করতে হবে যেভাবে তিনি নিজের জন্য বর্ণনা করেছেন। যেখানে কোন চোখের পৌছা সম্ভব নয়। [আদ দূরউ তায়ারুযিল আকলি ওয়ান নাকলি, ২/৩১]।
এই ধরনের ওরা কিছু আয়াত ও হাদীস দিয়ে আরো অসংখ্য আয়াতকে অস্বীকার করে (নাউজুবিল্লাহ!)।
যে সকল আয়াত দ্বারা বোঝা যায় আল্লাহ তায়ালা আরশসহ সর্বত্র বিরাজমান। কিছু আয়াতকে মানতে গিয়ে আরো ১০/ ১২টি আয়াত অস্বীকার করার মতো দুঃসাহস আসলে কথিত ফিতনাবাজ বাতিল ফিরক্বাদেরই মানায়। অসংখ্য আয়াতে কারীমাকে অস্বীকার করে আল্লাহ তা’আলাকে কেবল আরশে সীমাবদ্ধ করার মতো দুঃসাহস ওরা দেখাতে পারলেও আমরা পারি না।
আমরা বিশ্বাস করি, আল্লাহ তা’আলার কুরসী আসমান জমিন সব কিছুকে পরিবেষ্টন করে রেখেছে। তিনি স্থান, কাল থেকে পবিত্র। আল্লাহর গোটা রাজত্বের সর্বত্র তিনি রয়েছেন। আল্লাহ তাআলা আরশে রয়েছেন, একথা আমরা অস্বীকার করি না। তিনি আরশে রয়েছেন। তিনি এছাড়াও সর্বত্র রয়েছেন। তাহলে আমরা সকল আয়াতকেই মানি।
আর ওরা শুধু আরশ সংশ্লিষ্ট কিছু আয়াত মানে, বাকিগুলোকে অস্বীকার করে। কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চলে সীমাবদ্ধ থাকা দেহধারী সত্তার বৈশিষ্ট্য। আল্লাহ তা’আলার মতো নিরাকার সত্তার জন্যে এটা শোভা পায় না। এই আহলে হাদীস বাতিল ফিরকাটি এতোটাই বেয়াদব যে আল্লাহ তা’আলার দেহ আছে বলে তারা বিশ্বাস করে।
দেহ থাকাতো সৃষ্টির বৈশিষ্ট্য। সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী সকল সৃষ্টির স্রষ্টার জন্যে দেহ সাব্যস্ত করা এক প্রকার সুষ্পষ্ট শিরক। এই শিরকী আক্বিদা প্রচার করছে ইংরেজ সৃষ্ট কথিত আহলে হাদীস সম্প্রদায়। আল্লাহ তা’আলা এই ভয়াবহ মারাত্মক বাতিল ফিরকার হাত থেকে আমাদের দেশের সরলমনা মুসলমানদের হিফাযত করুন, আমীন।
বক্ষমান প্রবন্ধে আল্লাহ তা’আলা সর্বত্র বিরাজমান, এ বিষয় নিয়ে উপরোক্ত পোস্টের খন্ডন পূর্বক একটি দলীলভিত্তিক আলোচনা উপস্থাপন করা হলো। পরবর্তী প্রবন্ধে আল্লাহ তা’আলা যে দেহ থেকে পবিত্র, আল্লাহ তা’আলার দেহ সাব্যস্ত করা সুষ্পষ্ট শিরকী, এই ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা প্রকাশ করা হবে, ইনশাআল্লাহ!
১–
ﺛُﻢَّ ﺍﺳْﺘَﻮَﻯ ﻋَﻠَﻰ ﺍﻟْﻌَﺮْﺵِ
অতঃপর তিনি আরশের ওপর ক্ষমতাশীল হন। {সূরা হাদীদ-৩}
২–
ﻭَﺇِﺫَﺍ ﺳَﺄَﻟَﻚَ ﻋِﺒَﺎﺩِﻱ ﻋَﻨِّﻲ ﻓَﺈِﻧِّﻲ ﻗَﺮِﻳﺐٌ ﺃُﺟِﻴﺐُ ﺩَﻋْﻮَﺓَ ﺍﻟﺪَّﺍﻉِ ﺇِﺫَﺍ ﺩَﻋَﺎﻥِ ,,
আর আমার বান্দারা যখন তোমার কাছে জিজ্ঞেস করে আমার ব্যাপারে, বস্তুতঃ আমি রয়েছি সন্নিকটে। যারা প্রার্থনা করে, তাদের প্রার্থনা কবুল করে নেই, যখন আমার কাছে প্রার্থনা করে। {সূরা বাকারা-১৮৬}।
৩–
ﻭَﻧَﺤﻦُ ﺃَﻗﺮَﺏُ ﺇِﻟَﻴﻪِ ﻣِﻦ ﺣَﺒﻞِ ﺍﻟﻮَﺭِﻳﺪِ,,,
আর আমি বান্দার গলদেশের শিরার চেয়েও বেশ নিকটবর্তী। {সূরা কাফ-১৬}
৪–
ﻓَﻠَﻮْﻻ ﺇِﺫَﺍ ﺑَﻠَﻐَﺖِ ﺍﻟْﺤُﻠْﻘُﻮﻡَ ( 83 ) ﻭَﺃَﻧْﺘُﻢْ ﺣِﻴﻨَﺌِﺬٍ ﺗَﻨْﻈُﺮُﻭﻥَ ( 84 ) ﻭَﻧَﺤْﻦُ ﺃَﻗْﺮَﺏُ ﺇِﻟَﻴْﻪِ ﻣِﻨْﻜُﻢْ ﻭَﻟَﻜِﻦْ ﻻ ﺗُﺒْﺼِﺮُﻭﻥَ ( 85 )
অতঃপর এমন কেন হয়না যে, যখন প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়, এবং তোমরা তাকিয়ে থাকো, এবং তোমাদের চেয়ে আমি-ই তার বেশি কাছে থাকি। কিন্তু তোমরা দেখতে পাও না। {সূরা ওয়াকিয়া-৮৩,৮৪,৮৫}।
৫-
{ ﻭَﻟﻠَّﻪِ ﺍﻟْﻤَﺸْﺮِﻕُ ﻭَﺍﻟْﻤَﻐْﺮِﺏُ ﻓَﺄَﻳْﻨَﻤَﺎ ﺗُﻮَﻟُّﻮﺍْ ﻓَﺜَﻢَّ ﻭَﺟْﻪُ ﺍﻟﻠَّﻪِ ﺇِﻥَّ ﺍﻟﻠَّﻪَ ﻭَﺍﺳِﻊٌ ﻋَﻠِﻴﻢٌ,,,
পূর্ব এবং পশ্চিম আল্লাহ তায়ালারই। সুতরাং যেদিকেই মুখ ফেরাও, সেদিকেই রয়েছেন আল্লাহ তায়ালা। নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা সর্বব্যাপী, সর্বজ্ঞাত। {সূরা বাকারা-১১৫}।
৬–
ﻭَﻫُﻮَ ﻣَﻌَﻜُﻢْ ﺃَﻳْﻨَﻤَﺎ ﻛُﻨﺘُﻢْ ,,,
তোমরা যেখানেই থাকো না কেন, তিনি তোমাদের সাথে আছেন। {সূরা হাদীদ-৪}।
৭–
( ﺇِﺫْ ﻳَﻘُﻮﻝُ ﻟِﺼَﺎﺣِﺒِﻪِ ﻻ ﺗَﺤْﺰَﻥْ ﺇِﻥَّ ﺍﻟﻠَّﻪَ ﻣَﻌَﻨَﺎ ( ﺍﻟﺘﻮﺑﺔ ﻣﻦ ﺍﻵﻳﺔ,,,
যখন তিনি তার সাথীকে বললেন, ভয় পেয়োনা, নিশ্চয় আমাদের সাথে আল্লাহ আছেন। {সূরা হাদীদ-৪০}।
৮–
ﻣَﺎ ﻳَﻜُﻮﻥُ ﻣِﻦ ﻧَّﺠْﻮَﻯ ﺛَﻼﺛَﺔٍ ﺇِﻻَّ ﻫُﻮَ ﺭَﺍﺑِﻌُﻬُﻢْ ﻭَﻻ ﺧَﻤْﺴَﺔٍ ﺇِﻻَّ ﻫُﻮَ ﺳَﺎﺩِﺳُﻬُﻢْ ﻭَﻻ ﺃَﺩْﻧَﻰ ﻣِﻦ ﺫَﻟِﻚَ ﻭَﻻ ﺃَﻛْﺜَﺮَ ﺇِﻻَّ ﻫُﻮَ ﻣَﻌَﻬُﻢْ ﺃَﻳْﻦَ ﻣَﺎ ﻛَﺎﻧُﻮﺍ ﺛُﻢَّ ﻳُﻨَﺒِّﺌُﻬُﻢ ﺑِﻤَﺎ ﻋَﻤِﻠُﻮﺍ ﻳَﻮْﻡَ ﺍﻟْﻘِﻴَﺎﻣَﺔِ ﺇِﻥَّ ﺍﻟﻠَّﻪَ ﺑِﻜُﻞِّ ﺷَﻲْﺀٍ ﻋَﻠِﻴﻢٌ ( ﺍﻟﻤﺠﺎﺩﻟﺔ,,,
কখনো তিন জনের মাঝে এমন কোনো কথা হয়না যাতে চতুর্থ জন হিসেবে তিনি উপস্থিত না থাকেন, এবং কখনও পাঁচ জনের মধ্যে এমন কোনো গোপন কথা হয় না, যাতে ষষ্ঠজন হিসেবে তিনি উপস্থিত না থাকেন। এমনিভাবে তারা এর চেয়ে কম হোক বা বেশি, তারা যেখানেই থাকুক, আল্লাহ তাদের সঙ্গে থাকেন। অতঃপর কিয়ামতের দিন তিনি তাদেরকে অবহিত করবেন তারা যা কিছু করতো। নিশ্চয় আল্লাহ সব কিছু জানেন। {সূরা মুজাদালা-৭}।
৯–
ﻭَﺳِﻊَ ﻛُﺮْﺳِﻴُّﻪُ ﺍﻟﺴَّﻤَﺎﻭَﺍﺕِ ﻭَﺍﻷَﺭْﺽَ,,,
আল্লাহ তায়ালার কুরসী আসমান জমিন ব্যাপৃত। {সূরা বাকারা-২৫৫}।
১০-
وَهُوَ اللّهُ فِي السَّمَاوَاتِ وَفِي الأَرْضِ يَعْلَمُ سِرَّكُمْ وَجَهرَكُمْ وَيَعْلَمُ مَا تَكْسِبُونَ,,
তিনিই আল্লাহ নভোমন্ডলে এবং ভূমন্ডলে। তিনি তোমাদের গোপন ও প্রকাশ্য বিষয় জানেন এবং তোমরা যা কর তাও অবগত।
একটি মৌলিক প্রশ্নঃ-
প্রথমে একটি বিষয় সুনির্দিষ্ট করে নিতে হবে। সেটা হলো, আল্লাহ তা’আলার সর্বত্র বিরাজমানতার সব আয়াত গুলোকে ব্যাখ্যাসহ মানা হবে কি? না শুধু শাব্দিক অর্থের মধ্যেই রাখা হবে? দুই পদ্ধতির যে কোনো একটি পদ্ধতি অবশ্যই অবলম্বন করতে হবে।
যদি ব্যাখ্যাসহ মানা হয়, তাহলে সকল আয়াতের ব্যাখ্যাই করতে হবে। এক আয়াতের ব্যাখ্যা আর অন্য আয়াতের শুধু শাব্দিক অর্থ নেয়া যাবে না। আর যদি শুধু শাব্দিক অর্থই গ্রহণ করা হয় ব্যাখ্যা ছাড়া, তাহলে এ সম্পর্কীয় সকল আয়াতকেই তার শাব্দিক অর্থের ওপর রাখতে হবে। কোনোটারই ব্যাখ্যা করা যাবে না। সেই হিসেবে যদি ব্যাখ্যা নেয়া হয়, তাহলে সব আয়াতের ব্যাখ্যা নিতে হবে।
তাই ‘আর আমি বান্দার গলদেশের শিরার চেয়েও বেশি নিকটবর্তী’ {সূরা কাফ-১৬},
’তোমরা যেখানেই থাকো না কেন, তিনি তোমাদের সাথে আছেন’
{সূরা হাদীদ-৪}
ইত্যাদি আয়াতের ব্যাখ্যায় যেমন কথিত ভাইয়েরা বলে থাকেন যে এর মানে হলো, আল্লাহ তাআলা ইলম ও ক্ষমতা হিসেবে সবার সাথে আছেন। ঠিক একই ধরনের ব্যাখ্যা নিতে হবে ’অতঃপর তিনি আরশে সমাসীন হন’ [কর্তৃত্বশীল হোন] {সূরা হাদীদ-৩}
এ আয়াতের ক্ষেত্রেও। অর্থাৎ, তখন আমরা বলবো, এ আয়াতের ব্যাখ্যা হলো আল্লাহ তাআলা ইলম ও ক্ষমতা হিসেবে আরশে সমাসীন।
আর যদি বলা হয়, না আয়াতের শাব্দিক অর্থ গৃহীত হবে। কোনো ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ গ্রহণযোগ্য হবে না, তাহলে ’অতঃপর তিনি আরশে সমাসীন হন’ [কর্তৃত্বশীল হোন] {সূরা হাদীদ-৩}
এ আয়াতেরও শাব্দিক অর্থ হিসেবে যেমন আমরা বলি আল্লাহ তা’আলা আরশে – ঠিক একইভাবে আর আমি বান্দার গলদেশের শিরার চেয়েও বেশি নিকটবর্তী’ {সূরা কাফ-১৬},
’তোমরা যেখানেই থাকো না কেন, তিনি তোমাদের সাথে আছেন’ {সূরা হাদীদ-৪} ইত্যাদি আয়াতের শাব্দিক অর্থ হিসেবে বলতে হবে যে, আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন। সর্বত্র আছেন। কোনো ব্যাখ্যা এমতাবস্থায় করা যাবে না।
যেমনটি সূরা হাদীদের ৩ নং আয়াতের কোনো ব্যাখ্যা করা হচ্ছে না। আশা করি এ মূলনীতি অনুসরণ করলে আর কোনো সমস্যা থাকার কথা নয়। এক আয়াতের ব্যাখ্যা আরেক আয়াতের শাব্দিক অর্থ মনগড়াভাবে করলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না।
আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমান হলে আকাশের দিকে কেন হাত উঠিয়ে দুআ করা হয়? ঃ-
আদবের জন্যে। যদিও আল্লাহ তায়ালা সর্বত্র বিরাজমান, কিন্তু আল্লাহ তায়ালার শান হলো উঁচু; তাই আদব হিসেবে ওপরের দিকে হাত উঠিয়ে দুআ করা হয়। যেমন কোনো ক্লাশরুমে যদি লাউডস্পীকার স্থাপন করা হয়, চারদিক থেকে সেই স্পীকারের মাধ্যমে শিক্ষকের আওয়াজ আসে। তবুও যদি কোনো ছাত্র শিক্ষকের দিকে মুখ না করে অন্যত্র মুখ করে কথা শুনে, তাহলে শিক্ষক তাকে ধমক দেবেন। কারণ এটা আদবের খেলাফ; এই জন্যে নয় যে অন্য দিক থেকে আওয়াজ শোনা যায় না। তেমনি আল্লাহ তায়ালা সর্বত্র বিরাজমান থাকা সত্ত্বেও ওপরের দিকে মুখ করে দুআ করা হয় আল্লাহ তায়ালা উঁচু, সর্বশ্রেষ্ঠ। তাই আদব হিসেবে ওপরের দিকে হাত তুলে দুআ করা হয়।
জিবরাঈল (আ:) ওপর থেকে নিচে নেমে আসেন মানে কি? ঃ-
এর মানে হলো, যেমন পুলিশ এসে কোনো অনুষ্ঠান বন্ধ করে দিয়ে কারণ বলে যে, ওপরের নির্দেশ। এর মানে কি পুলিশ অফিসার ওপরে থাকেন? না সম্মান ও ক্ষমতার দিক থেকে যিনি ওপরে তার নির্দেশ, তাই বলা হয় ওপরের নির্দেশ? তেমনি আল্লাহ তায়ালার ফরমান নিয়ে যখন জিব্রাঈল (আ:) আসেন, একে যদি বলা হয় ওপর থেকে এসেছেন, এর মানেও সম্মানসূচক ও পরাক্রমশালীর কাছ থেকে এসেছেন। তাই বলা হয় ওপর থেকে এসেছেন। এই জন্যে নয় যে, আল্লাহ তায়ালা কেবল আরশেই থাকেন।
আল্লাহ তায়ালা কি সকল নোংরা স্থানেও আছেন? ঃ-
নাউজুবিল্লাহ! এই উদ্ভট যুক্তি যারা দেয় সেই আহাম্মকদের জিজ্ঞেস করুন। তার কলবে কি দু’একটি কুরআনের আয়াত সংরক্ষিত আছে? যদি বলে আছে, তাহলে বলুন তার মানে সীনায় কুরআনে কারীম বিদ্যমান। কারণ সংরক্ষিত সেই বস্তুই থাকে যেটা বিদ্যমান থাকে; অবিদ্যমান বস্তু সংরক্ষণ সম্ভব নয়। তো সীনায় যদি কুরআন বিদ্যমান থাকে, সেটা নিয়ে টয়লেটে যাওয়া কীভাবে জায়েজ?
কুরআন নিয়েতো টয়লেটে যাওয়া জায়েজ নয়। তখন ওদের আকল থাকলে বলবে, কুরআন বিদ্যমান, কিন্তু দেহ থেকে পবিত্র কুরআন। তেমনি আমরাও বলি, আল্লাহ তা’আলা সর্বত্র বিরাজমান। কিন্তু তিনি দেহ থেকে পবিত্র। সেই হিসেবে সর্বত্র বিরাজমান। সুতরাং কুরআন যেমন সীনায় থাকা সত্ত্বেও টয়লেটে যেতে কোনো সমস্যা নেই, কুরআনে কারীমের বেইজ্জতী হয়না সীনায় সংরক্ষিত কুরআনের দেহ না থাকার কারণে, তেমনি আল্লাহ তায়ালার দেহ না থাকার কারণে অপবিত্র স্থানে বিদ্যমান থাকাটাও কোনো বেইজ্জতীর বিষয় নয়।
স্ববিরোধী বক্তব্যঃ-
“আল্লাহ তাআলা কোথায় আছেন” নামের প্রবন্ধটির শুরুতে লেখক বলেন- “কোরআন ও সহিহ হাদীছে আল্লাহ তা’আলার যে সমস্ত সিফাতের কথা বলা হয়েছে তার ওপর ঈমান আনা ওয়াজিব। তাঁর সিফাতসমূহের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করা, অথবা তার কিছু সিফাতকে যেভাবে আছে সেভাবেই স্বীকার করা আর কিছুকে পরিবর্তন করে বিশ্বাস করা কিছুতেই জায়েয হবে না”।
তিনি দাবি করছেন, কুরআন ও হাদীছে বর্ণিত আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কোনো সিফাত যেভাবে বর্ণিত হুবহু সে অবস্থায়ই বিশ্বাস করতে হবে, পরিবর্তন করে ব্যাখ্যা করা যাবে না।
কিন্তু আফসোস ও হাস্যকর বিষয় হলো, তিনি নিজেই প্রবন্ধের শেষ দিকে আল্লাহ তা’আলার সর্বত্র বিরাজমানতার স্পষ্ট প্রমাণবাহী আয়াতের মূল অর্থ পাল্টে মনগড়া ব্যাখ্যার আশ্রয় নিয়ে বলেন “আল্লাহ তাআলার বাণী:
ﻭَﻫُﻮَ ﻣَﻌَﻜُﻢْ ﺃَﻳْﻦَ ﻣَﺎ ﻛُﻨْﺘُﻢْ ( ﺍﻟﺤﺪﻳﺪ,,
তোমরা যেখানেই থাকো না কেন, তিনি তোমাদের সাথেই আছেন। (সূরা হাদীদ, ৫৭: ৪ আয়াত)।
অত্র আয়াতের ব্যাখ্যা হলো: নিশ্চয়ই আল্লাহ তা’আলা আমাদের সাথে আছেন দেখার দ্বারা, শ্রবণের দ্বারা, যা বর্ণিত আছে তফসীরে জালালাইন ও ইবনে কাসীরে। এই আয়াতের পূর্বের ও শেষের অংশ এ কথারই ব্যাখ্যা প্রদান করে”।
বিজ্ঞ পাঠকমণ্ডলী! লক্ষ্য করুন, আয়াতে স্পষ্ট বলা হচ্ছে যে আমরা যেখানেই থাকি না কেন, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদের সাথেই আছেন, যার স্পষ্ট অর্থ আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সর্বত্র রয়েছেন। কিন্তু এ স্পষ্ট অর্থবোধক আয়াতকে ব্যাখ্যা ছাড়া হুবহু বিশ্বাস না করে পাল্টে তিনি ব্যাখ্যা দাঁড় করালেন যে, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সর্বত্র বিরাজমান নন, বরং দেখা ও শ্রবণ শক্তি রয়েছে সর্বত্র। “দেখা ও শ্রবণ দ্বারা বিরাজমান” ব্যাখ্যা করার দ্বারা তিনি তার নিজের ফাতওয়া অনুযায়ী-ই না-জায়েয কাজটি করেছেন। তাই নয় কি?
কারণ তিনি-ই তো আগে বললেন যে, আল্লাহর সিফাত-সম্বলিত আয়াত বা হাদীছকে হুবহু বিশ্বাস করতে হবে, ব্যাখ্যা করা জায়েয নেই। অথচ তিনি নিজেই স্ববিরোধী মত পেশ করে সূরা হাদীদের ৪ নং আয়াতকে “দেখা ও শ্রবণ দ্বারা বিরাজমান” শব্দে ব্যাখ্যা করে না-জায়েয কাজ করলেন।
আল্লাহ তা’আলা শুধুই আসমানে আছেন বলাটা আল্লাহ তা’আলার বিশালত্বকে খাটো করাঃ-
আমরা জানি, কোনো বস্তু যখন অন্য বস্তুর ওপর থাকে, তখন যে বস্তুর ওপর বস্তুটি রাখা হয় তা বড় থাকে, আর যা রাখা হয় তা হয় ছোট। যেমন, যদি বলা হয় যে কলমটি টেবিলের ওপর আছে, তখন বুঝতে হবে যে টেবিলটি বড় আর কলমটি ছোট; কারণ কলম বড় হলে কলমটি টেবিলের ওপর থাকতে পারে না। এটাই ’মুহিত’ ও ’মুহাতের’ পার্থক্য।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ’মুহীত’ তথা সমস্ত কিছুকে পরিবেষ্টনকারী। তাঁকে পরিবেষ্টনকারী কিছু-ই নেই। যদি বলা হয় যে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন শুধু আরশের ওপর আছেন, তাহলে আরশ আল্লাহ রাব্বুল আলামীনকে ’মুহীত’ করে ফেলছে, তথা পরিবেষ্টন করে ফেলছে, তথা আরশ হয়ে যাচ্ছে বড়, আর আল্লাহ রাব্বুল আলামীন হয়ে যাচ্ছেন ছোট – নাউজুবিল্লাহ!
যা কেবল নাস্তিকরাই বলতে পারে, কোনো মু’মিন মুসলমান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনকে এভাবে খাটো করতে পারেন না। তাই সহীহ আক্বিদা হলো, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সর্বত্র বিরাজমান। তিনি যেমন আরশে আছেন, তেমনি জমিন-আসমান সর্বত্র বিরাজমান।
কথিত আহলে হাদীসদের কাছে আমাদের প্রশ্ন:-
১– আল্লাহ তাআলা আরশেই অবস্থান করলে আরশ সৃষ্টির আগে আল্লাহ তাআলা কোথায় ছিলেন?
২– কিয়ামতের সময় সব কিছু যখন ধ্বংস হয়ে যাবে তখন আল্লাহ তাআলা কোথায় থাকবেন?
৩– আল্লাহ তা’আলা আরশেই অবস্থান করলে মুসা (আ:)-কে দেখা দেয়ার জন্যে তূর পাহাড়ে কেন ডেকে নিলেন?
৪– বিভিন্ন সহীহ হাদীছ দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে শেষ রাতে আল্লাহ তা’আলা প্রথম আসমানে এসে বান্দাদেরকে ইবাদত করার জন্যে আহবান করে থাকেন, যেন বান্দা ইবাদত করেন। এখন প্রশ্ন হলো, সারা পৃথিবীতে একই সময়ে শেষ রাত হয় না, এক দেশ থেকে আরেক দেশের সময়ের পার্থক্য রয়েছে। এক ঘন্টা থেকে নিয়ে বারো বা তেরো ঘন্টা, এমন কী বিশ বা বাইশ ঘন্টাও। তাহলে কি আল্লাহ তা’আলা বাংলাদেশের আসমানে শেষ রাতে একবার আসেন, তারপর তিন ঘন্টা পর আবার সৌদিতে যান, তারপর এভাবে একের পর এক দেশের প্রথম আসমান ঘুরতেই থাকেন? কুরআন ও সহীহ হাদীছের শব্দসহ উক্ত বিষয়ের সমাধান চাই।
যে সকল ভাইয়েরা আল্লাহ তায়ালা সর্বত্র বিরাজমানতাকে অস্বীকার করে আল্লাহ তা’আলাকে নির্দিষ্ট স্থানে সমাসীন বলে আল্লাহ তা’আলার পবিত্র সত্তার শানে বেয়াদবী করছে, ওদের অপপ্রচার থেকে, বাতিল আক্বিদা থেকে আমাদের আল্লাহ তায়ালা রক্ষা করুন, আমীন। এসব অপ্রয়োজনীয় বিষয়ের আলোচনা থেকে আমাদের বিরত থাকার মতো পরিবেশ সৃষ্টি করে দিন, সূম্মা আমীন!
**********************************
মানব সৃষ্টির সূচনা থেকে বর্তমানকাল পর্যন্ত খুব অল্প সংখ্যক মানুষই আল্লাহর অস্তিত্ব অস্বীকার করেছে। ফেরাউন, নমরুদ এবং এদের মতো আরো যারা ছিল, তারা কেউ আল্লাহর অস্তিত্বে অবিশ্বাসী ছিলনা। তারা কখনো এ কথা বলেনি যে, এই গোটা বিশ্ব আমি সৃষ্টি করেছি। বরং তারা বলেছে, কোরআনের ভাষায়- আমিই তোমাদের শ্রেষ্ঠ রব। আমার চেয়ে শক্তিশালী আর কেউ নেই।
অর্থৎ তারা দাবী করেছে,‘ এই বিশাল ভূখন্ডের শাসক হিসাবে দেশের জনগণের ওপরে আইন ও বিধান চলবে আমার। এখানে অন্য কারো আইন কানুন চলবে না। জনগণ অন্য কারো আইন অনুসরণ করতে পারে না। আইন চলবে একমাত্র আমার এবং আমাকেই ইলাহ হিসাবে পূজা অর্চনা করতে হবে। মাথানত করতে হবে একমাত্র আমার কাছে। ’ এভাবে দেশের জনগোষ্ঠী আল্লাহকেও বিশ্বাস করেছে, সেই সাথে তারা আল্লাহর অংশীদার বানিয়েছে।
আল্লাহ তা’আলা ভুলত্রুটি ক্ষমা করুন। এটি খুবই সূক্ষ্ম বিষয়। এ বিষয় নিয়ে কথা বলতে পূর্ববর্তী মনীষীবৃন্দ নিষেধ করেছেন। বলা যায় এটি একটি বিদ’আতি আলোচনা। এ বিষয়ে কথা বলা বিদ’আত। এমনটি-ই আমরা পূর্ববর্তী মুহাক্কিক আলেম-মণ্ডলী থেকে দেখতে পাই। হযরত ইমাম মালিক (রহ:) বলেন —
ﺍﻻﺳﺘﻮﺍﺀ ﻣﻌﻠﻮﻡ ﻭﺍﻟﻜﻴﻔﻴﺔ ﻣﺠﻬﻮﻟﺔ، ﻭﺍﻟﺴﺆﺍﻝ ﻋﻨﻪ ﺑﺪﻋﺔ،ﻭﺍﻻﻳﻤﺎﻥ ﺑﻪ ﻭﺍﺟﺐ,
অর্থাৎ, “আল্লাহ তা’আলার আরশে ইস্তিওয়া এর বিষয়টি জানা যায়, কিন্তু অবস্থা অজানা। এ বিষয়ে প্রশ্ন করা বিদ’আত। আর এ বিষয়ে ঈমান রাখা ওয়াজিব”। যেহেতু এটি খুবই সঙ্গীন একটি বিষয়। আর আল্লাহ তা’আলা আছেন, তিনি সব কিছু দেখছেন, তিনি আমাদের ওপর ক্ষমতাশীল, এসব আমাদের মূল ঈমানের বিষয়। তিনি কোন্ অবস্থায় আছেন? এসব আমাদের ঈমানের মূল বিষয় নয়। তাই এটি নিয়ে অযথা কথোপকথনে লিপ্ত হওয়া কিছুতেই উচিত নয়। খুবই গর্হিত কাজ।
কিন্তু কুরআন শরীফের মুতাশাবিহ তথা অস্পষ্ট আয়াত নিয়ে ধুম্রজাল সৃষ্টি করা, এসবকে মূল প্রাতিপাদ্য বিষয় বানানো যে এক শ্রেণীর ফিতনাবাজদের মূল মিশন, তা আল্লাহ তা’আলা পবিত্র কুরআনেই জানিয়ে দিয়েছেন। ইরশাদ হচ্ছে —
ﻫُﻮَ ﺍﻟَّﺬِﻱ ﺃَﻧﺰَﻝَ ﻋَﻠَﻴْﻚَ ﺍﻟْﻜِﺘَﺎﺏَ ﻣِﻨْﻪُ ﺁﻳَﺎﺕٌ ﻣُّﺤْﻜَﻤَﺎﺕٌ ﻫُﻦَّ ﺃُﻡُّ ﺍﻟْﻜِﺘَﺎﺏِ ﻭَﺃُﺧَﺮُ ﻣُﺘَﺸَﺎﺑِﻬَﺎﺕٌ ۖ ﻓَﺄَﻣَّﺎ ﺍﻟَّﺬِﻳﻦَ ﻓِﻲ ﻗُﻠُﻮﺑِﻬِﻢْ ﺯَﻳْﻎٌ ﻓَﻴَﺘَّﺒِﻌُﻮﻥَ ﻣَﺎ ﺗَﺸَﺎﺑَﻪَ ﻣِﻨْﻪُ ﺍﺑْﺘِﻐَﺎﺀَ ﺍﻟْﻔِﺘْﻨَﺔِ ﻭَﺍﺑْﺘِﻐَﺎﺀَ ﺗَﺄْﻭِﻳﻠِﻪِ ۗ ﻭَﻣَﺎ ﻳَﻌْﻠَﻢُ ﺗَﺄْﻭِﻳﻠَﻪُ ﺇِﻟَّﺎ ﺍﻟﻠَّﻪُ ۗ ﻭَﺍﻟﺮَّﺍﺳِﺨُﻮﻥَ ﻓِﻲ ﺍﻟْﻌِﻠْﻢِ ﻳَﻘُﻮﻟُﻮﻥَ ﺁﻣَﻨَّﺎ ﺑِﻪِ ﻛُﻞٌّ ﻣِّﻦْ ﻋِﻨﺪِ ﺭَﺑِّﻨَﺎ ۗ ﻭَﻣَﺎ ﻳَﺬَّﻛَّﺮُ ﺇِﻟَّﺎ ﺃُﻭﻟُﻮ ﺍﻟْﺄَﻟْﺒَﺎﺏِ [ ٣ : ٧ ],,,
অর্থাৎ, তিনি-ই আপনার প্রতি কিতাব নাযিল করেছেন। তাতে কিছু আয়াত রয়েছে সুস্পষ্ট, সেগুলোই কিতাবের আসল অংশ। আর অন্যগুলো রূপক। সুতরাং যাদের অন্তরে কুটিলতা রয়েছে, তারা অনুসরণ করে ফিৎনা বিস্তার এবং অপব্যাখ্যার উদ্দেশ্যে তন্মধ্যেকার রূপকগুলোর। আর সেগুলোর ব্যাখ্যা আল্লাহ ছাড়া কেউই জানে না। আর যারা জ্ঞানে সুগভীর, তারা বলেন: আমরা এর প্রতি ঈমান এনেছি। এ সবই আমাদের পালনকর্তার পক্ষ থেকে অবতীর্ণ হয়েছে। আর বোধশক্তিসম্পন্ন ব্যক্তিবর্গ ছাড়া অপর কেউ শিক্ষা গ্রহণ করে না। {সূরা আলে ইমরান-৭}।
আল্লাহ তা’আলা কোথায় আছেন?
এটি কুরআনের একটি মুতাশাবিহাত তথা রূপক শব্দের অন্তর্ভুক্ত। তাই আমাদের পূর্ববর্তী মুহাক্কিকবৃন্দ এ ব্যাপারে অতিমাত্রা গবেষণা থেকে নিজেদের বিরত রেখেছেন। কিন্তু যাদের মনে কুটিলতা আছে তারা ফিতনা বিস্তারের জন্যে এ সবকেই প্রচারণার মূল টার্গেট বানিয়ে কাজ করে যায়। সেই কুটিল সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত প্রচলিত বিদ’আতি ফিরকা কথিত আহলে হাদীস। যাদের কাজই হল মুতাশাবিহ এবং মতভেদপূর্ণ বিষয়কে মানুষের সামনে তুলে ধরে ফিতনা ও বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা। যেহেতু এ বিষয়ে ফেইসবুকে লিখালিখি হচ্ছে, তাই আহলে সুন্নাতের বক্তব্য তুলে ধরার প্রয়াস।
তাই বাধ্য হয়ে এ বিষয়ে কলম ধরলাম।
আল্লাহ তা’আলা ক্ষমাশীল। আমাদের ভুলগুলো ক্ষমা করে দিয়ে তাঁর প্রিয়ভাজন হবার পথে অগ্রসর হবার তৌফিক দান করুন, আমীন!
আমরা বিশ্বাস করি, আল্লাহ তায়ালা সর্বত্র বিরাজমান। কিন্তু কথিত আহলে হাদীস সম্প্রদায় প্রচার করে থাকে, আল্লাহ তায়ালা সর্বত্র বিরাজমান নয়। তারা দলীল হিসেবে নিচের কোরানের আয়াত ও হাদীসগুলো পেশ করে থাকে।
১) আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ-
إِنَّ رَبَّكُمُ اللّهُ الَّذِي خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضَ فِي سِتَّةِ أَيَّامٍ ثُمَّ اسْتَوَى عَلَى الْعَرْشِ,,,
নিশ্চয়ই তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহ যিনি আসমান সমূহ ও যমীন ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তিনি আরশের উপর উঠেছেন। [সূরা আরাফ, আয়াত ৫৪] [সূরা ইউনুস, আয়াত ৩]
২) তিনি আরো বলেনঃ
اللَّهُ الَّذِي رَفَعَ السَّمَاوَاتِ بِغَيْرِ عَمَدٍ تَرَوْنَهَا ثُمَّ اسْتَوَى عَلَى الْعَرْش,,,
আল্লাহ যিনি আসমান সমূহ উপরে স্থাপন করেছেন খুঁটি ছাড়া, তোমরা তা দেখছো। অতঃপর তিনি আরশের উপর উঠেছেন। [সূরা রাদ, আয়াত ২]
উল্লেখিত আয়াতগুলো দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, আল্লাহ তায়ালা আরশে সমুন্নত আছেন। কিভাবে সমুন্নত আছেন, এ কথা বলতে নিষেধ করা হয়েছে।
ইমাম মালেক রহিমাহুল্লাহ বলেনঃ “কাইফিয়াত বা (সমুন্নত হওয়ার) পদ্ধতি অজ্ঞাত আর ইসতাওয়া বা সমুন্নত হওয়াটা জ্ঞাত। এর প্রতি ঈমান আনা ওয়াজিব এবং এ বিষয়ে প্রশ্ন করা বিদআত”।[ইমাম বাইহাক্বীর আল আসমা ওয়াস সিফাত, পৃষ্ঠা ৪০৮ ।। তামহীদ ৭/১৫১]
৩) আল্লাহ তায়ালা আসমানের উপর আছেন। এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ
أَمْ أَمِنْتُمْ مَنْ فِي السَّمَاءِ أَنْ يُرْسِلَ عَلَيْكُمْ حَاصِبًا فَسَتَعْلَمُونَ كَيْفَ نَذِيرِ,,,
অথবা তোমরা কি নিরাপদ হয়ে গেছো যে, আকাশের উপর যিনি রয়েছেন তিনি তোমাদের উপর পাথর বর্ষণকারী ঝঞ্ঝা বায়ু প্রেরণ করবেন না? তখন তোমরা জানতে পারবে কিরূপ ছিল আমার সতর্কবাণী”। [সূরা মুলক, আয়াত ১৭]।
হাদীস শরীফ থেকেঃ- (৪)
عَنْ مُعَاوِيَةَ بْنِ الْحَكَمِ السُّلَمِيِّ، قَالَ وَكَانَتْ لِي جَارِيَةٌ تَرْعَى غَنَمًا لِي قِبَلَ أُحُدٍ وَالْجَوَّانِيَّةِ فَاطَّلَعْتُ ذَاتَ يَوْمٍ فَإِذَا الذِّيبُ قَدْ ذَهَبَ بِشَاةٍ مِنْ غَنَمِهَا وَأَنَا رَجُلٌ مِنْ بَنِي آدَمَ آسَفُ كَمَا يَأْسَفُونَ لَكِنِّي صَكَكْتُهَا صَكَّةً فَأَتَيْتُ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم فَعَظَّمَ ذَلِكَ عَلَىَّ قُلْتُ يَا رَسُولَ اللَّهِ أَفَلاَ أُعْتِقُهَا قَالَ " ائْتِنِي بِهَا " . فَأَتَيْتُهُ بِهَا فَقَالَ لَهَا " أَيْنَ اللَّهُ " . قَالَتْ فِي السَّمَاءِ . قَالَ " مَنْ أَنَا " . قَالَتْ أَنْتَ رَسُولُ اللَّهِ . قَالَ " أَعْتِقْهَا فَإِنَّهَا مُؤْمِنَةٌ " .
অর্থঃ- মু’আবিয়া বিন আল হাকাম আস সুলামী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ আমার এক দাসী ছিল। সে উহুদ ও জাওওয়ানিয়্যাহ এলাকায় আমার বকরীপাল চরাতো। একদিন আমি হঠাৎ সেখানে গিয়ে দেখলাম তার বকরীপাল থেকে বাঘে একটি বকরী নিয়ে গিয়েছে। আমি তো অন্যান্য আদম সন্তানের মত একজন মানুষ। তাদের মত আমিও ক্ষোভ ও চপেটাঘাত করলাম। এরপর আমি রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর কাছে আসলাম (এবং সব কথা বললাম) কেননা বিষয়টি আমার কাছে খুবই গুরুতর মনে হলো। আমি জিজ্ঞেস করলামঃ হে আল্লাহর রসূল, আমি কি তাকে মুক্ত করে দিবো? তিনি বললেনঃ তাকে আমার কাছে নিয়ে আসো। সুতরাং আমি তাকে এনে রসূলুল্লাহর কাছে হাজির করলাম।
তিনি তাকে (দাসীকে) জিজ্ঞেস করলেনঃ আল্লাহ কোথায়?
সে বললঃ আকাশে। নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ আমি কে?
সে বললঃ আপনি আল্লাহর রসূল। তখন রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাকে বললেনঃ তুমি তাকে মুক্ত করে দাও, সে একজন মুমিনাহ নারী। [সহীহ মুসলিম, অনুচ্ছেদঃ মসজিদ ও সালাতের স্থান সমূহ, হাদিস নং ১০৮৬]।
৫) আনাস বিন মালেক রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেনঃ যয়নব (রাদিয়াল্লাহু আনহা) নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর অন্যান্য স্ত্রীগণের উপর গর্ব করে বলতেন যে, তাঁদের বিয়ে তাঁদের পরিবার দিয়েছে আর আমার বিয়ে আল্লাহ সপ্তম আসমানের উপর থেকে সম্পাদন করেছেন।
[সহীহ বুখারী, অধ্যায়ঃ তাওহীদ, হাদিস নং ৭৪২০]
সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ১০৮৬।
৬) আব্দুল্লাহ ইবন আমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ
ارْحَمُوا مَنْ فيِ الارضِ يَرْحَمكٌمْ مَنْ في السَّمَاء,,,
যমীনে যারা আছে তাদের প্রতি দয়া কর, আকাশে যিনি আছেন (আল্লাহ) তিনি তোমাদের প্রতি দয়া করবেন।
[তিরমিযী, হাদিস নং ১৮৪৭ ।। আবু দাউদ, হাদিস নং ৪২০৯]
৭) ইমাম আবু হানীফা রহিমাহুল্লাহ আরো বলেনঃ আল্লাহ তায়ালা উপর থেকে বান্দার আহ্বানে সাড়া দেন, নিচ থেকে নয়। কেননা নিচ রুবুবিয়্যাহ ও উলুহিয়্যাতের কোন গুণের মধ্যে পড়ে না। [আল ফিকহুল আবসাত, পৃষ্ঠা ৫১]
৮। ইমাম আবু হানীফা রহিমাহুল্লাহ বলেনঃ যে ব্যক্তি বলবে আল্লাহ আসমানে আছেন নাকি যমীনে আছেন আমি তা জানি না, সে কুফরী করবে। অনুরূপভাবে যে বলবে আল্লাহ আরশে আছেন কিন্তু তাঁর আরশ আসমানে নাকি যমীনে আমি তা জানি না, সেও কুফরী করবে। [আল ফিকহুল আবসাত, পৃষ্ঠা ৪৬ ।। মাজমুউ ফাতওয়া ইবনু তাইমিয়্যাহ, ৫/৪৮ পৃষ্ঠা]।
৯) ইমাম মালিক রহিমাহুল্লাহ বলেছেনঃ আল্লাহ হচ্ছেন আসমানে আর তাঁর জ্ঞান সব জায়গায় বিরাজমান। [মাসায়িলি ইমাম আহমাদ, পৃষ্ঠা ২৬৩ ।। ইবনু আব্দিল বার বর্ণনা করেছেন আত তামহিদ, ৭/১৩৮]
১০) ইমাম শাফেঈ বলেছেনঃ ঐ সুন্নাহ বা রীতির ব্যাপারে কথা হলো যে সুন্নাহ বা রীতির উপর আমি আছি এবং আমার সাথীদেরকে দেখেছি তার উপর। আর আহলে হাদিসদেরকে দেখেছি যাদের কাছ থেকে আমি ইলম গ্রহণ করেছি যেমন সুফইয়ান, মালিক এবং অন্যান্যরা তারা ঐ বিধানের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। আর তা হল এ স্বীকৃতি দেয়াঃ আল্লাহ ছাড়া প্রকৃতপক্ষে কোন ইলাহ নেই। নিশ্চয়ই মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহর রাসূল। এবং আল্লাহ তায়ালা আসমানে আরশের উপর রয়েছেন। তিনি যেভাবে ইচ্ছা তার সৃষ্ট জীবের নিকটবর্তী হন এবং আল্লাহ যেভাবে ইচ্ছা সেভাবেই দুনিয়ার আসমানে নামেন।
[ইজতিমাউল জুউশিল ইসলামী, পৃষ্ঠা ১৬৫। ইসবাতুল উলু, পৃষ্ঠা ১২৪]
১১) ইমাম আহমাদ রহিমাহুল্লাহ বলেনঃ আল্লাহ তায়ালা যেভাবে তিনি চান সেভাবেই তিনি আরশে রয়েছেন। আমরা এর প্রতি বিশ্বাস আনবো এর কোন সীমা বা সিফাত বর্ণনা করা ব্যতীত। কেননা আরশে সমাসীন হওয়া আল্লাহর একটি সিফাত। আর আল্লাহর সিফাত ঐ ভাবেই বর্ণনা করতে হবে যেভাবে তিনি নিজের জন্য বর্ণনা করেছেন। যেখানে কোন চোখের পৌছা সম্ভব নয়। [আদ দূরউ তায়ারুযিল আকলি ওয়ান নাকলি, ২/৩১]।
এই ধরনের ওরা কিছু আয়াত ও হাদীস দিয়ে আরো অসংখ্য আয়াতকে অস্বীকার করে (নাউজুবিল্লাহ!)।
যে সকল আয়াত দ্বারা বোঝা যায় আল্লাহ তায়ালা আরশসহ সর্বত্র বিরাজমান। কিছু আয়াতকে মানতে গিয়ে আরো ১০/ ১২টি আয়াত অস্বীকার করার মতো দুঃসাহস আসলে কথিত ফিতনাবাজ বাতিল ফিরক্বাদেরই মানায়। অসংখ্য আয়াতে কারীমাকে অস্বীকার করে আল্লাহ তা’আলাকে কেবল আরশে সীমাবদ্ধ করার মতো দুঃসাহস ওরা দেখাতে পারলেও আমরা পারি না।
আমরা বিশ্বাস করি, আল্লাহ তা’আলার কুরসী আসমান জমিন সব কিছুকে পরিবেষ্টন করে রেখেছে। তিনি স্থান, কাল থেকে পবিত্র। আল্লাহর গোটা রাজত্বের সর্বত্র তিনি রয়েছেন। আল্লাহ তাআলা আরশে রয়েছেন, একথা আমরা অস্বীকার করি না। তিনি আরশে রয়েছেন। তিনি এছাড়াও সর্বত্র রয়েছেন। তাহলে আমরা সকল আয়াতকেই মানি।
আর ওরা শুধু আরশ সংশ্লিষ্ট কিছু আয়াত মানে, বাকিগুলোকে অস্বীকার করে। কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চলে সীমাবদ্ধ থাকা দেহধারী সত্তার বৈশিষ্ট্য। আল্লাহ তা’আলার মতো নিরাকার সত্তার জন্যে এটা শোভা পায় না। এই আহলে হাদীস বাতিল ফিরকাটি এতোটাই বেয়াদব যে আল্লাহ তা’আলার দেহ আছে বলে তারা বিশ্বাস করে।
দেহ থাকাতো সৃষ্টির বৈশিষ্ট্য। সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী সকল সৃষ্টির স্রষ্টার জন্যে দেহ সাব্যস্ত করা এক প্রকার সুষ্পষ্ট শিরক। এই শিরকী আক্বিদা প্রচার করছে ইংরেজ সৃষ্ট কথিত আহলে হাদীস সম্প্রদায়। আল্লাহ তা’আলা এই ভয়াবহ মারাত্মক বাতিল ফিরকার হাত থেকে আমাদের দেশের সরলমনা মুসলমানদের হিফাযত করুন, আমীন।
বক্ষমান প্রবন্ধে আল্লাহ তা’আলা সর্বত্র বিরাজমান, এ বিষয় নিয়ে উপরোক্ত পোস্টের খন্ডন পূর্বক একটি দলীলভিত্তিক আলোচনা উপস্থাপন করা হলো। পরবর্তী প্রবন্ধে আল্লাহ তা’আলা যে দেহ থেকে পবিত্র, আল্লাহ তা’আলার দেহ সাব্যস্ত করা সুষ্পষ্ট শিরকী, এই ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা প্রকাশ করা হবে, ইনশাআল্লাহ!
১–
ﺛُﻢَّ ﺍﺳْﺘَﻮَﻯ ﻋَﻠَﻰ ﺍﻟْﻌَﺮْﺵِ
অতঃপর তিনি আরশের ওপর ক্ষমতাশীল হন। {সূরা হাদীদ-৩}
২–
ﻭَﺇِﺫَﺍ ﺳَﺄَﻟَﻚَ ﻋِﺒَﺎﺩِﻱ ﻋَﻨِّﻲ ﻓَﺈِﻧِّﻲ ﻗَﺮِﻳﺐٌ ﺃُﺟِﻴﺐُ ﺩَﻋْﻮَﺓَ ﺍﻟﺪَّﺍﻉِ ﺇِﺫَﺍ ﺩَﻋَﺎﻥِ ,,
আর আমার বান্দারা যখন তোমার কাছে জিজ্ঞেস করে আমার ব্যাপারে, বস্তুতঃ আমি রয়েছি সন্নিকটে। যারা প্রার্থনা করে, তাদের প্রার্থনা কবুল করে নেই, যখন আমার কাছে প্রার্থনা করে। {সূরা বাকারা-১৮৬}।
৩–
ﻭَﻧَﺤﻦُ ﺃَﻗﺮَﺏُ ﺇِﻟَﻴﻪِ ﻣِﻦ ﺣَﺒﻞِ ﺍﻟﻮَﺭِﻳﺪِ,,,
আর আমি বান্দার গলদেশের শিরার চেয়েও বেশ নিকটবর্তী। {সূরা কাফ-১৬}
৪–
ﻓَﻠَﻮْﻻ ﺇِﺫَﺍ ﺑَﻠَﻐَﺖِ ﺍﻟْﺤُﻠْﻘُﻮﻡَ ( 83 ) ﻭَﺃَﻧْﺘُﻢْ ﺣِﻴﻨَﺌِﺬٍ ﺗَﻨْﻈُﺮُﻭﻥَ ( 84 ) ﻭَﻧَﺤْﻦُ ﺃَﻗْﺮَﺏُ ﺇِﻟَﻴْﻪِ ﻣِﻨْﻜُﻢْ ﻭَﻟَﻜِﻦْ ﻻ ﺗُﺒْﺼِﺮُﻭﻥَ ( 85 )
অতঃপর এমন কেন হয়না যে, যখন প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়, এবং তোমরা তাকিয়ে থাকো, এবং তোমাদের চেয়ে আমি-ই তার বেশি কাছে থাকি। কিন্তু তোমরা দেখতে পাও না। {সূরা ওয়াকিয়া-৮৩,৮৪,৮৫}।
৫-
{ ﻭَﻟﻠَّﻪِ ﺍﻟْﻤَﺸْﺮِﻕُ ﻭَﺍﻟْﻤَﻐْﺮِﺏُ ﻓَﺄَﻳْﻨَﻤَﺎ ﺗُﻮَﻟُّﻮﺍْ ﻓَﺜَﻢَّ ﻭَﺟْﻪُ ﺍﻟﻠَّﻪِ ﺇِﻥَّ ﺍﻟﻠَّﻪَ ﻭَﺍﺳِﻊٌ ﻋَﻠِﻴﻢٌ,,,
পূর্ব এবং পশ্চিম আল্লাহ তায়ালারই। সুতরাং যেদিকেই মুখ ফেরাও, সেদিকেই রয়েছেন আল্লাহ তায়ালা। নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা সর্বব্যাপী, সর্বজ্ঞাত। {সূরা বাকারা-১১৫}।
৬–
ﻭَﻫُﻮَ ﻣَﻌَﻜُﻢْ ﺃَﻳْﻨَﻤَﺎ ﻛُﻨﺘُﻢْ ,,,
তোমরা যেখানেই থাকো না কেন, তিনি তোমাদের সাথে আছেন। {সূরা হাদীদ-৪}।
৭–
( ﺇِﺫْ ﻳَﻘُﻮﻝُ ﻟِﺼَﺎﺣِﺒِﻪِ ﻻ ﺗَﺤْﺰَﻥْ ﺇِﻥَّ ﺍﻟﻠَّﻪَ ﻣَﻌَﻨَﺎ ( ﺍﻟﺘﻮﺑﺔ ﻣﻦ ﺍﻵﻳﺔ,,,
যখন তিনি তার সাথীকে বললেন, ভয় পেয়োনা, নিশ্চয় আমাদের সাথে আল্লাহ আছেন। {সূরা হাদীদ-৪০}।
৮–
ﻣَﺎ ﻳَﻜُﻮﻥُ ﻣِﻦ ﻧَّﺠْﻮَﻯ ﺛَﻼﺛَﺔٍ ﺇِﻻَّ ﻫُﻮَ ﺭَﺍﺑِﻌُﻬُﻢْ ﻭَﻻ ﺧَﻤْﺴَﺔٍ ﺇِﻻَّ ﻫُﻮَ ﺳَﺎﺩِﺳُﻬُﻢْ ﻭَﻻ ﺃَﺩْﻧَﻰ ﻣِﻦ ﺫَﻟِﻚَ ﻭَﻻ ﺃَﻛْﺜَﺮَ ﺇِﻻَّ ﻫُﻮَ ﻣَﻌَﻬُﻢْ ﺃَﻳْﻦَ ﻣَﺎ ﻛَﺎﻧُﻮﺍ ﺛُﻢَّ ﻳُﻨَﺒِّﺌُﻬُﻢ ﺑِﻤَﺎ ﻋَﻤِﻠُﻮﺍ ﻳَﻮْﻡَ ﺍﻟْﻘِﻴَﺎﻣَﺔِ ﺇِﻥَّ ﺍﻟﻠَّﻪَ ﺑِﻜُﻞِّ ﺷَﻲْﺀٍ ﻋَﻠِﻴﻢٌ ( ﺍﻟﻤﺠﺎﺩﻟﺔ,,,
কখনো তিন জনের মাঝে এমন কোনো কথা হয়না যাতে চতুর্থ জন হিসেবে তিনি উপস্থিত না থাকেন, এবং কখনও পাঁচ জনের মধ্যে এমন কোনো গোপন কথা হয় না, যাতে ষষ্ঠজন হিসেবে তিনি উপস্থিত না থাকেন। এমনিভাবে তারা এর চেয়ে কম হোক বা বেশি, তারা যেখানেই থাকুক, আল্লাহ তাদের সঙ্গে থাকেন। অতঃপর কিয়ামতের দিন তিনি তাদেরকে অবহিত করবেন তারা যা কিছু করতো। নিশ্চয় আল্লাহ সব কিছু জানেন। {সূরা মুজাদালা-৭}।
৯–
ﻭَﺳِﻊَ ﻛُﺮْﺳِﻴُّﻪُ ﺍﻟﺴَّﻤَﺎﻭَﺍﺕِ ﻭَﺍﻷَﺭْﺽَ,,,
আল্লাহ তায়ালার কুরসী আসমান জমিন ব্যাপৃত। {সূরা বাকারা-২৫৫}।
১০-
وَهُوَ اللّهُ فِي السَّمَاوَاتِ وَفِي الأَرْضِ يَعْلَمُ سِرَّكُمْ وَجَهرَكُمْ وَيَعْلَمُ مَا تَكْسِبُونَ,,
তিনিই আল্লাহ নভোমন্ডলে এবং ভূমন্ডলে। তিনি তোমাদের গোপন ও প্রকাশ্য বিষয় জানেন এবং তোমরা যা কর তাও অবগত।
একটি মৌলিক প্রশ্নঃ-
প্রথমে একটি বিষয় সুনির্দিষ্ট করে নিতে হবে। সেটা হলো, আল্লাহ তা’আলার সর্বত্র বিরাজমানতার সব আয়াত গুলোকে ব্যাখ্যাসহ মানা হবে কি? না শুধু শাব্দিক অর্থের মধ্যেই রাখা হবে? দুই পদ্ধতির যে কোনো একটি পদ্ধতি অবশ্যই অবলম্বন করতে হবে।
যদি ব্যাখ্যাসহ মানা হয়, তাহলে সকল আয়াতের ব্যাখ্যাই করতে হবে। এক আয়াতের ব্যাখ্যা আর অন্য আয়াতের শুধু শাব্দিক অর্থ নেয়া যাবে না। আর যদি শুধু শাব্দিক অর্থই গ্রহণ করা হয় ব্যাখ্যা ছাড়া, তাহলে এ সম্পর্কীয় সকল আয়াতকেই তার শাব্দিক অর্থের ওপর রাখতে হবে। কোনোটারই ব্যাখ্যা করা যাবে না। সেই হিসেবে যদি ব্যাখ্যা নেয়া হয়, তাহলে সব আয়াতের ব্যাখ্যা নিতে হবে।
তাই ‘আর আমি বান্দার গলদেশের শিরার চেয়েও বেশি নিকটবর্তী’ {সূরা কাফ-১৬},
’তোমরা যেখানেই থাকো না কেন, তিনি তোমাদের সাথে আছেন’
{সূরা হাদীদ-৪}
ইত্যাদি আয়াতের ব্যাখ্যায় যেমন কথিত ভাইয়েরা বলে থাকেন যে এর মানে হলো, আল্লাহ তাআলা ইলম ও ক্ষমতা হিসেবে সবার সাথে আছেন। ঠিক একই ধরনের ব্যাখ্যা নিতে হবে ’অতঃপর তিনি আরশে সমাসীন হন’ [কর্তৃত্বশীল হোন] {সূরা হাদীদ-৩}
এ আয়াতের ক্ষেত্রেও। অর্থাৎ, তখন আমরা বলবো, এ আয়াতের ব্যাখ্যা হলো আল্লাহ তাআলা ইলম ও ক্ষমতা হিসেবে আরশে সমাসীন।
আর যদি বলা হয়, না আয়াতের শাব্দিক অর্থ গৃহীত হবে। কোনো ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ গ্রহণযোগ্য হবে না, তাহলে ’অতঃপর তিনি আরশে সমাসীন হন’ [কর্তৃত্বশীল হোন] {সূরা হাদীদ-৩}
এ আয়াতেরও শাব্দিক অর্থ হিসেবে যেমন আমরা বলি আল্লাহ তা’আলা আরশে – ঠিক একইভাবে আর আমি বান্দার গলদেশের শিরার চেয়েও বেশি নিকটবর্তী’ {সূরা কাফ-১৬},
’তোমরা যেখানেই থাকো না কেন, তিনি তোমাদের সাথে আছেন’ {সূরা হাদীদ-৪} ইত্যাদি আয়াতের শাব্দিক অর্থ হিসেবে বলতে হবে যে, আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন। সর্বত্র আছেন। কোনো ব্যাখ্যা এমতাবস্থায় করা যাবে না।
যেমনটি সূরা হাদীদের ৩ নং আয়াতের কোনো ব্যাখ্যা করা হচ্ছে না। আশা করি এ মূলনীতি অনুসরণ করলে আর কোনো সমস্যা থাকার কথা নয়। এক আয়াতের ব্যাখ্যা আরেক আয়াতের শাব্দিক অর্থ মনগড়াভাবে করলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না।
আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমান হলে আকাশের দিকে কেন হাত উঠিয়ে দুআ করা হয়? ঃ-
আদবের জন্যে। যদিও আল্লাহ তায়ালা সর্বত্র বিরাজমান, কিন্তু আল্লাহ তায়ালার শান হলো উঁচু; তাই আদব হিসেবে ওপরের দিকে হাত উঠিয়ে দুআ করা হয়। যেমন কোনো ক্লাশরুমে যদি লাউডস্পীকার স্থাপন করা হয়, চারদিক থেকে সেই স্পীকারের মাধ্যমে শিক্ষকের আওয়াজ আসে। তবুও যদি কোনো ছাত্র শিক্ষকের দিকে মুখ না করে অন্যত্র মুখ করে কথা শুনে, তাহলে শিক্ষক তাকে ধমক দেবেন। কারণ এটা আদবের খেলাফ; এই জন্যে নয় যে অন্য দিক থেকে আওয়াজ শোনা যায় না। তেমনি আল্লাহ তায়ালা সর্বত্র বিরাজমান থাকা সত্ত্বেও ওপরের দিকে মুখ করে দুআ করা হয় আল্লাহ তায়ালা উঁচু, সর্বশ্রেষ্ঠ। তাই আদব হিসেবে ওপরের দিকে হাত তুলে দুআ করা হয়।
জিবরাঈল (আ:) ওপর থেকে নিচে নেমে আসেন মানে কি? ঃ-
এর মানে হলো, যেমন পুলিশ এসে কোনো অনুষ্ঠান বন্ধ করে দিয়ে কারণ বলে যে, ওপরের নির্দেশ। এর মানে কি পুলিশ অফিসার ওপরে থাকেন? না সম্মান ও ক্ষমতার দিক থেকে যিনি ওপরে তার নির্দেশ, তাই বলা হয় ওপরের নির্দেশ? তেমনি আল্লাহ তায়ালার ফরমান নিয়ে যখন জিব্রাঈল (আ:) আসেন, একে যদি বলা হয় ওপর থেকে এসেছেন, এর মানেও সম্মানসূচক ও পরাক্রমশালীর কাছ থেকে এসেছেন। তাই বলা হয় ওপর থেকে এসেছেন। এই জন্যে নয় যে, আল্লাহ তায়ালা কেবল আরশেই থাকেন।
আল্লাহ তায়ালা কি সকল নোংরা স্থানেও আছেন? ঃ-
নাউজুবিল্লাহ! এই উদ্ভট যুক্তি যারা দেয় সেই আহাম্মকদের জিজ্ঞেস করুন। তার কলবে কি দু’একটি কুরআনের আয়াত সংরক্ষিত আছে? যদি বলে আছে, তাহলে বলুন তার মানে সীনায় কুরআনে কারীম বিদ্যমান। কারণ সংরক্ষিত সেই বস্তুই থাকে যেটা বিদ্যমান থাকে; অবিদ্যমান বস্তু সংরক্ষণ সম্ভব নয়। তো সীনায় যদি কুরআন বিদ্যমান থাকে, সেটা নিয়ে টয়লেটে যাওয়া কীভাবে জায়েজ?
কুরআন নিয়েতো টয়লেটে যাওয়া জায়েজ নয়। তখন ওদের আকল থাকলে বলবে, কুরআন বিদ্যমান, কিন্তু দেহ থেকে পবিত্র কুরআন। তেমনি আমরাও বলি, আল্লাহ তা’আলা সর্বত্র বিরাজমান। কিন্তু তিনি দেহ থেকে পবিত্র। সেই হিসেবে সর্বত্র বিরাজমান। সুতরাং কুরআন যেমন সীনায় থাকা সত্ত্বেও টয়লেটে যেতে কোনো সমস্যা নেই, কুরআনে কারীমের বেইজ্জতী হয়না সীনায় সংরক্ষিত কুরআনের দেহ না থাকার কারণে, তেমনি আল্লাহ তায়ালার দেহ না থাকার কারণে অপবিত্র স্থানে বিদ্যমান থাকাটাও কোনো বেইজ্জতীর বিষয় নয়।
স্ববিরোধী বক্তব্যঃ-
“আল্লাহ তাআলা কোথায় আছেন” নামের প্রবন্ধটির শুরুতে লেখক বলেন- “কোরআন ও সহিহ হাদীছে আল্লাহ তা’আলার যে সমস্ত সিফাতের কথা বলা হয়েছে তার ওপর ঈমান আনা ওয়াজিব। তাঁর সিফাতসমূহের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করা, অথবা তার কিছু সিফাতকে যেভাবে আছে সেভাবেই স্বীকার করা আর কিছুকে পরিবর্তন করে বিশ্বাস করা কিছুতেই জায়েয হবে না”।
তিনি দাবি করছেন, কুরআন ও হাদীছে বর্ণিত আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কোনো সিফাত যেভাবে বর্ণিত হুবহু সে অবস্থায়ই বিশ্বাস করতে হবে, পরিবর্তন করে ব্যাখ্যা করা যাবে না।
কিন্তু আফসোস ও হাস্যকর বিষয় হলো, তিনি নিজেই প্রবন্ধের শেষ দিকে আল্লাহ তা’আলার সর্বত্র বিরাজমানতার স্পষ্ট প্রমাণবাহী আয়াতের মূল অর্থ পাল্টে মনগড়া ব্যাখ্যার আশ্রয় নিয়ে বলেন “আল্লাহ তাআলার বাণী:
ﻭَﻫُﻮَ ﻣَﻌَﻜُﻢْ ﺃَﻳْﻦَ ﻣَﺎ ﻛُﻨْﺘُﻢْ ( ﺍﻟﺤﺪﻳﺪ,,
তোমরা যেখানেই থাকো না কেন, তিনি তোমাদের সাথেই আছেন। (সূরা হাদীদ, ৫৭: ৪ আয়াত)।
অত্র আয়াতের ব্যাখ্যা হলো: নিশ্চয়ই আল্লাহ তা’আলা আমাদের সাথে আছেন দেখার দ্বারা, শ্রবণের দ্বারা, যা বর্ণিত আছে তফসীরে জালালাইন ও ইবনে কাসীরে। এই আয়াতের পূর্বের ও শেষের অংশ এ কথারই ব্যাখ্যা প্রদান করে”।
বিজ্ঞ পাঠকমণ্ডলী! লক্ষ্য করুন, আয়াতে স্পষ্ট বলা হচ্ছে যে আমরা যেখানেই থাকি না কেন, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদের সাথেই আছেন, যার স্পষ্ট অর্থ আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সর্বত্র রয়েছেন। কিন্তু এ স্পষ্ট অর্থবোধক আয়াতকে ব্যাখ্যা ছাড়া হুবহু বিশ্বাস না করে পাল্টে তিনি ব্যাখ্যা দাঁড় করালেন যে, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সর্বত্র বিরাজমান নন, বরং দেখা ও শ্রবণ শক্তি রয়েছে সর্বত্র। “দেখা ও শ্রবণ দ্বারা বিরাজমান” ব্যাখ্যা করার দ্বারা তিনি তার নিজের ফাতওয়া অনুযায়ী-ই না-জায়েয কাজটি করেছেন। তাই নয় কি?
কারণ তিনি-ই তো আগে বললেন যে, আল্লাহর সিফাত-সম্বলিত আয়াত বা হাদীছকে হুবহু বিশ্বাস করতে হবে, ব্যাখ্যা করা জায়েয নেই। অথচ তিনি নিজেই স্ববিরোধী মত পেশ করে সূরা হাদীদের ৪ নং আয়াতকে “দেখা ও শ্রবণ দ্বারা বিরাজমান” শব্দে ব্যাখ্যা করে না-জায়েয কাজ করলেন।
আল্লাহ তা’আলা শুধুই আসমানে আছেন বলাটা আল্লাহ তা’আলার বিশালত্বকে খাটো করাঃ-
আমরা জানি, কোনো বস্তু যখন অন্য বস্তুর ওপর থাকে, তখন যে বস্তুর ওপর বস্তুটি রাখা হয় তা বড় থাকে, আর যা রাখা হয় তা হয় ছোট। যেমন, যদি বলা হয় যে কলমটি টেবিলের ওপর আছে, তখন বুঝতে হবে যে টেবিলটি বড় আর কলমটি ছোট; কারণ কলম বড় হলে কলমটি টেবিলের ওপর থাকতে পারে না। এটাই ’মুহিত’ ও ’মুহাতের’ পার্থক্য।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ’মুহীত’ তথা সমস্ত কিছুকে পরিবেষ্টনকারী। তাঁকে পরিবেষ্টনকারী কিছু-ই নেই। যদি বলা হয় যে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন শুধু আরশের ওপর আছেন, তাহলে আরশ আল্লাহ রাব্বুল আলামীনকে ’মুহীত’ করে ফেলছে, তথা পরিবেষ্টন করে ফেলছে, তথা আরশ হয়ে যাচ্ছে বড়, আর আল্লাহ রাব্বুল আলামীন হয়ে যাচ্ছেন ছোট – নাউজুবিল্লাহ!
যা কেবল নাস্তিকরাই বলতে পারে, কোনো মু’মিন মুসলমান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনকে এভাবে খাটো করতে পারেন না। তাই সহীহ আক্বিদা হলো, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সর্বত্র বিরাজমান। তিনি যেমন আরশে আছেন, তেমনি জমিন-আসমান সর্বত্র বিরাজমান।
কথিত আহলে হাদীসদের কাছে আমাদের প্রশ্ন:-
১– আল্লাহ তাআলা আরশেই অবস্থান করলে আরশ সৃষ্টির আগে আল্লাহ তাআলা কোথায় ছিলেন?
২– কিয়ামতের সময় সব কিছু যখন ধ্বংস হয়ে যাবে তখন আল্লাহ তাআলা কোথায় থাকবেন?
৩– আল্লাহ তা’আলা আরশেই অবস্থান করলে মুসা (আ:)-কে দেখা দেয়ার জন্যে তূর পাহাড়ে কেন ডেকে নিলেন?
৪– বিভিন্ন সহীহ হাদীছ দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে শেষ রাতে আল্লাহ তা’আলা প্রথম আসমানে এসে বান্দাদেরকে ইবাদত করার জন্যে আহবান করে থাকেন, যেন বান্দা ইবাদত করেন। এখন প্রশ্ন হলো, সারা পৃথিবীতে একই সময়ে শেষ রাত হয় না, এক দেশ থেকে আরেক দেশের সময়ের পার্থক্য রয়েছে। এক ঘন্টা থেকে নিয়ে বারো বা তেরো ঘন্টা, এমন কী বিশ বা বাইশ ঘন্টাও। তাহলে কি আল্লাহ তা’আলা বাংলাদেশের আসমানে শেষ রাতে একবার আসেন, তারপর তিন ঘন্টা পর আবার সৌদিতে যান, তারপর এভাবে একের পর এক দেশের প্রথম আসমান ঘুরতেই থাকেন? কুরআন ও সহীহ হাদীছের শব্দসহ উক্ত বিষয়ের সমাধান চাই।
যে সকল ভাইয়েরা আল্লাহ তায়ালা সর্বত্র বিরাজমানতাকে অস্বীকার করে আল্লাহ তা’আলাকে নির্দিষ্ট স্থানে সমাসীন বলে আল্লাহ তা’আলার পবিত্র সত্তার শানে বেয়াদবী করছে, ওদের অপপ্রচার থেকে, বাতিল আক্বিদা থেকে আমাদের আল্লাহ তায়ালা রক্ষা করুন, আমীন। এসব অপ্রয়োজনীয় বিষয়ের আলোচনা থেকে আমাদের বিরত থাকার মতো পরিবেশ সৃষ্টি করে দিন, সূম্মা আমীন!
Comments
Post a Comment