নবিজী কেন উম্মতের আনুগত্যপূর্ণ ভালবাসার পূর্ণ আধারঃ-
++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++
এটা রবিউল আউয়াল মাস। মহান আল্লাহ তাআলার সবচেয়ে প্রিয় বান্দা মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সা,এর জন্মের মাস। সকল নবীর সর্দার রাসূলে কারিম সা,এর দুনিয়াতে আগমনের মাস। এজন্য এ-মাস সিরাত আলোচনা ও রাসূলে কারিম সা,এর জীবনের সাথে সম্পর্কিত সকল বিষয় নিয়ে আলোচনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে হকদার এই মাস। তবে সীরাতুর রাসূল ও সুন্নাতুর রাসূল নিয়ে আলোচনা যেন শুধু এই মাসের মাঝেই সীমাবদ্ধ না থাকে সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।
রাসূলে কারিম সা,এর পাচটি বড় বড় হক রয়েছে আমাদের উপর। যে হকগুলো আদায় না করা পর্যন্ত আমি ও আমরা কেউই খাটি উম্মত হতে পারবো না। আমাদের উপর রাসূলের
#প্রথম হক হলো তার উপর ঈমান আনা।
#দ্বিতীয় হক হলো জীবনের সকল ক্ষেত্রে রাসূলের অনুসরণ করা।
#তৃতীয় হক হলো রাসূলে কারিম সা, কে মুহাব্বত করা।
#চতুর্থ হক হলো তার আনিত দ্বীনকে সাহায্য করা।
#পঞ্চম হক হলো রাসূলকে সবচেয়ে সম্মান ও মর্যাদা প্রদান করা।
রাসূলের মুহাব্বত তার প্রতি সম্মান-মর্যাদারই বহির্প্রকাশ। যে ব্যক্তি রাসূলকে সম্মান করে অবশ্যই সে তাকে মুহাব্বত করবে। আর যে বদবখত ও কপালপোড়ার দীলে রাসূলের সম্মান নেই তার দীল স্বাভাবিকভাবেই রাসূলের মুহাব্বত থেকে শূন্য।
আজকের আলোচনায় হাদীস ও সাহাবা রা, এর ঘটনার দ্বারা রাসূলের প্রতি মুহাব্বত বিষয়ে কিছু আলোকপাত করবো ইনশাআল্লাহ।
আল্লাহ আমাদের সবাইকে রাসূলের সাচ্চা আশেক ও প্রেমিক হওয়ার তাওফিক দান করুন।
সাহাবায়ে কেরাম নবীপ্রেমের যে নমুনা বিশ্ববাসীর কাছে রেখে গেছেন, তা কোনো লেখকের লেখনীতে, কোন সাহিত্যিকের সাহিত্যে, কোনো কবির কবিতায়, কোনো দার্শনিকের দর্শনে, কোনো বক্তার বক্তৃতায়, কোনো শিল্পীর তুলিতে, কোনো বৈজ্ঞানিকের বিজ্ঞানে, এমনকি কোনো গল্পকারের গল্পে প্রকাশ করা আদৌ সম্ভব নয়।
সাহাবিদের লাখ লাখ চক্ষু সার্বক্ষণিক রসুল (সা.)-এর দৈনন্দিন জীবনযাপন ও কর্মের দিকে অধীর আগ্রহে তাকিয়ে থাকত। কোনো করণীয় ও বর্জনীয় আমল প্রিয় রসুল (সা.) থেকে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমলে রূপান্তরিত করার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়তেন। কার আগে কে তা বাস্তবায়ন করতে পারেন।
শত্রু কর্তৃক প্রিয় রসুল আক্রান্ত হোন কিনা সেদিকে সার্বক্ষণিক দৃষ্টি রাখতেন। নবীপ্রেমে নিজেদের সর্বস্ব উজাড় করে দিয়েছিলেন। যেমন সন্তান প্রিয় মায়ের স্নেহ-মমতা, স্বামী-স্ত্রীর ভালোবাসা, ভাই-বোনের হৃদয় নিংড়ানো দরদ, এমনকি পৈতৃক ধর্ম ত্যাগ করে স্বীয় বাপ-দাদার বসতভিটা, উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত ধন-সম্পদ এবং নিজেদের ক্ষমতা প্রভাব-প্রতিপত্তি পেছনে রেখে প্রিয় নবীর সংস্পর্শে লাভের আকাঙ্ক্ষায় অজানা-অচেনা পথ ধরে মদিনার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছেন। পেছনে রেখে আসা সহায়-সম্পত্তির জন্য জীবনে কখনো আক্ষেপ পর্যন্ত করেননি।
হ্যাঁ, আক্ষেপ করেছেন শুধু প্রিয় রসুলের সংস্পর্শে কিংবা তার আদেশ-নিষেধে কোনো ত্রুটি-বিচ্যুতি ঘটলে। প্রিয় নবীর শুধু অঙ্গুলির ইশারায় নিজেদের জীবন উৎসর্গ করতেও তারা কোনোরূপ দ্বিধাবোধ করেননি।
প্রিয় পাঠক! একটু চিন্তা করে দেখুন তো? নবীজী এমন কি আকর্ষণ দেখিয়েছেন যে, তার জন্য নিজের প্রিয় জীবনসহ সর্বস্ব ওয়াকফ করে দিতে হবে। হ্যাঁ, তিনি শুধু সাহাবাদের নিজেদের খালেক (স্রষ্টা)-এর আকর্ষণ দেখিয়েছেন। সঙ্গে সঙ্গে ইবলিসের আকর্ষণ বর্জন করতে তাকিদ করেছেন। ইহকালীন ও পরকালীন সফলতার রাস্তা দেখিয়েছেন। অভিজ্ঞ সাহাবিরা বিচার-বিশ্লেষণ করে চিরশান্তির রাস্তা অবলম্বন করেছেন। আর এই রাস্তা পেতে হলে নবীজীর ভালোবাসা লাগবে। অন্যথায় তা সম্ভব নয়।
বিশ্বনবির প্রতি অত্যাধিক নিষ্ঠা এবং ভালোবাসা না থাকলে তাঁর আদর্শ যথাযথ অনুসরণ আনুগত্য করা সম্ভব নয়। এ জন্য ভালোবাসাসহ তারই আনুগত্য, অনুসরণ এবং আদর্শ বাস্তবায়নে পিতা-মাতা, সন্তান-সন্তুতি এমনকি নিজের ভোগ-বিলাস, আশা-আকঙ্ক্ষার বিসর্জন দিতে হবে বিশ্বনবীর আদর্শের সামনে। তবেই পরিপূর্ণ ঈমানদার হওয়া সম্ভব। আল্লাহ তায়ালা বলেন -
﴿ قُلۡ اِنۡ كُنۡتُمۡ تُحِبُّوۡنَ اللّٰهَ فَاتَّبِعُوۡنِىۡ يُحۡبِبۡكُمُ اللّٰهُ وَيَغۡفِرۡ لَكُمۡ ذُنُوۡبَكُمۡؕ وَاللّٰهُ غَفُوۡرٌ رَّحِيۡمٌ﴾
অর্থ- হে নবী! লোকদের বলে দাওঃ “যদি তোমরা যথার্থই আল্লাহকে ভালোবাসো, তাহলে আমার অনুসরণ করো, আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন এবং তোমাদের গোনাহ মাফ করে দেবেন। তিনি বড়ই ক্ষমাশীল ও করুণাময়।”
সুরা আলে ইমরান ৩১.)
আল্লাহ তাআলা প্রিয়নবীকে বিশ্ববাসীর জন্য রহমতস্বরূপ পাঠিয়েছেন। সবার ওপর তার সুনাম ও খ্যাতি বাড়িয়ে মর্যাদা দান করেছেন। শুধু তাই নয়, ‘আল্লাহ তাআলা মানুষের প্রতি এ মর্মে নির্দেশনা জারি করেছেন যে, ‘প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুসরণ করাকে তাঁর অনুসরণ হিসেবে ঘোষণা করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন,
﴿ مَنۡ يُّطِعِ الرَّسُوۡلَ فَقَدۡ اَطَاعَ اللّٰهَۚ وَمَنۡ تَوَلّٰى فَمَاۤ اَرۡسَلۡنٰكَ عَلَيۡهِمۡ حَفِيۡظًاؕ﴾
অর্থ- যে ব্যক্তি রসূলের আনুগত্য করলো সে আসলে আল্লাহরই আনুগত্য করলো। আর যে ব্যক্তি মুখ ফিরিয়ে নিলো, যাই হোক, তাদের ওপর তো আমি তোমাকে পাহারাদার বানিয়ে পাঠাইনি।
(সুরা নিসা : আয়াত ৮০)
প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাতে বাইয়াত গ্রহণ করাকে আল্লাহর হাতে বাইয়াত গ্রহণ হিসেবে ঘোষণা করে আল্লাহ তাআলা বলেন-
﴿ اِنَّ الَّذِيۡنَ يُبَايِعُوۡنَكَ اِنَّمَا يُبَايِعُوۡنَ اللّٰهَ ؕ يَدُ اللّٰهِ فَوۡقَ اَيۡدِيۡهِمۡ ۚ فَمَنۡ نَّكَثَ فَاِنَّمَا يَنۡكُثُ عَلَىٰ نَفۡسِهٖۚ وَمَنۡ اَوۡفٰى بِمَا عٰهَدَ عَلَيۡهُ اللّٰهَ فَسَيُؤۡتِيۡهِ اَجۡرًا عَظِيۡمًا.﴾
অর্থ- নিশ্চয় ‘যারা আপনার বাইয়াত গ্রহণ করে তারা তো আল্লাহরই বাইয়াত গ্রহণ করে; আল্লাহর হাত তাদের হাতের ওপরই। সুতরাং যে তা ভঙ্গ করে, তা ভঙ্গ করার পরিণাম তাকেই ভোগ করতে হবে। সুতরাং যে আল্লাহর সঙ্গে অঙ্গীকার পূর্ণ করে তিনি তাকে মহা পুরস্কার দেন।’
(সুরা ফাতাহ : আয়াত ১০)
>> প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ইজ্জত করা মানে আল্লাহকে ইজ্জত করা হয়। আল্লাহ তাআলা বলেন-
{َّؕ وَلِلّٰهِ الۡعِزَّةُ وَلِرَسُوۡلِهٖ وَلِلۡمُؤۡمِنِيۡنَ وَلٰكِنَّ الۡمُنٰفِقِيۡنَ لَا يَعۡلَمُوۡنَ﴾
‘যাবতীয় ইজ্জত তথা সম্মান তো আল্লাহরই এবং তাঁর রাসুলও বিশ্বাসীদের। (সুরা মুনাফিকুন: আয়াত ৮)
>> এমনিভাবে প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সন্তুষ্টিকে আল্লাহর সন্তুষ্টির সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন,
﴿ۡۚ وَاللّٰهُ وَرَسُوۡلُهٗۤ اَحَقُّ اَنۡ يُّرۡضُوۡهُ اِنۡ كَانُوۡا مُؤۡمِنِيۡنَ﴾
‘আল্লাহ ও তাঁর রাসুলই হলেন বেশি হকদার (এই বিষয়ে) যে, তারা যেন তাঁকে সন্তুষ্ট করে; যদি তারা বিশ্বাসী হয়।’ (সুরা তাওবা : আয়াত ৬২)
>> প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ডাকে সাড়া দেয়াকে আল্লাহর ডাকে সাড়া দেয়ার সঙ্গে বর্ণনা করে আল্লাহ তায়ালা বলেন,
﴿يٰۤاَيُّهَا الَّذِيۡنَ اٰمَنُوۡا اسۡتَجِيۡبُوۡا لِلّٰهِ وَلِلرَّسُوۡلِ اِذَا دَعَاكُمۡ لِمَا يُحۡيِيۡكُمۡۚ.َ﴾
‘হে মুমিনগণ! আল্লাহ এবং তার রাসুল যখন তোমাদেরকে এমন কিছুর দিকে আহ্বান করে, যা তোমাদেরকে প্রাণবন্ত করে; তখন আল্লাহ ও রাসুলের আহ্বানে সাড়া দাও।’ (সুরা আনফাল : আয়াত ২৪)।
উল্লেখিত আয়াতে কারিমায় আল্লাহ তাআলা নিজেই প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সম্মান, মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনা করেছেন। আলোচ্য আয়াতে কারিমার নির্দেশ পালন করা মুসলিম উম্মাহর একান্ত কর্তব্য।
পবিত্র কোরআন ও হাদিস শরীফে রাসূলে কারিম সা,এর প্রতি উম্মতের কেমন মুহাব্বত ও ভালোবাসা পোষণ করতে হবে তা বলে দেয়া হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন--
قُلْ إِنْ كَانَ آَبَاؤُكُمْ وَأَبْنَاؤُكُمْ وَإِخْوَانُكُمْ وَأَزْوَاجُكُمْ وَعَشِيرَتُكُمْ وَأَمْوَالٌ اقْتَرَفْتُمُوهَا وَتِجَارَةٌ تَخْشَوْنَ كَسَادَهَا وَمَسَاكِنُ تَرْضَوْنَهَا أَحَبَّ إِلَيْكُمْ مِنَ اللَّهِ وَرَسُولِهِ وَجِهَادٍ فِي سَبِيلِهِ فَتَرَبَّصُوا حَتَّى يَأْتِيَ اللَّهُ بِأَمْرِهِ وَاللَّهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الْفَاسِقِينَ,,,
‘(হে নবী!) আপনি বলে দিন, তোমাদের পিতা, তোমাদের পুত্র, তোমাদের ভাই, তোমাদের স্ত্রী, তোমাদের আত্মীয়-স্বজন এবং ওই সম্পদ, যা তোমরা উপার্জন কর এবং ব্যবসা-বাণিজ্য যার ক্ষতির আশঙ্কা তোমরা কর এবং ঘর-বাড়ি, যাতে তোমরা বসবাস কর, যদি তোমাদের কাছে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের চেয়ে এবং তাঁর রাস্তায় জিহাদের চেয়ে অধিক প্রিয় হয়ে থাকে তাহলে অপেক্ষা কর আল্লাহর বিধান আসা পর্যন্ত। আল্লাহ সত্যত্যাগী সম্প্রদায়কে সৎপথ প্রদর্শন করেন না।’ সূরা তাওবার : আয়াত নং ২৪।
সহীহ বুখারী, কিতাবুল ঈমান, ১৫ নং হাদীসে, ও সহীহ মুসলিমের কিতাবুল ঈমান, ১৭৭ নং হাদীসে এসেছে--
عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَا يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتَّى أَكُونَ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِنْ وَالِدِهِ وَوَلَدِهِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِينَ,,,
‘হযরত আনাস ইবনে মালেক রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলে কারীম সা. ইরশাদ করেন, তোমাদের কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হতে পারবে না যতক্ষণ আমি তার কাছে তার পিতা-মাতা, সন্তান-সন্ততি ও অন্য সকল মানুষ থেকে অধিক প্রিয় না হব।’
মুসনাদে আহমদের : ১৮০৪৭ নং হাদীসে এবং তাফসীরে ইবনে কাসীরের : ২/৩৫০ নং পৃষ্ঠায় এসেছে--
عَنْ زُهْرَةَ بْنِ مَعْبَدٍ عَنْ جَدِّهِ قَالَ كُنَّا مَعَ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَهُوَ آخِذٌ بِيَدِ عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ فَقَالَ وَاللَّهِ لَأَنْتَ يَا رَسُولَ اللَّهِ أَحَبُّ إِلَيَّ مِنْ كُلِّ شَيْءٍ إِلَّا نَفْسِي فَقَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَا يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتَّى أَكُونَ عِنْدَهُ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِنْ نَفْسِهِ قَالَ عُمَرُ فَلَأَنْتَ الْآنَ وَاللَّهِ أَحَبُّ إِلَيَّ مِنْ نَفْسِي فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الْآنَ يَا عُمَرُ,,,
হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রা. থেকে বর্ণিত, (উপরোল্লেখিত হাদীস যখন নবীজী বলেছিলেন তখন হযরত উমর রা. নবীজীর কাছেই ছিলেন) তিনি তখন বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি আপনাকে আমার মা-বাবার চেয়ে, ভাই-বোনের চেয়ে এবং সব মানুষের চেয়ে বেশি ভালবাসি। কিন্তু আমার জীবন আমার কাছে আপনার চেয়ে বেশি প্রিয়।
রাসূলুল্লাহ সা. তখন বললেন, নাহ,! হল না। তুমি এখনও প্রকৃত মুমিন হতে পারনি। একথা শুনে হযরত উমর রা. খুব চিন্তায় পড়ে গেলেন। এখনও তিনি প্রকৃত মুমিন হতে পারেননি! প্রকৃত মুমিনই যদি হতে না পারলেন তবে এর চেয়ে বড় দুর্ভাগ্য আর কি আছে ? পরদিন তিনি নবী সা. এর দরবারে হাজির হলেন এবং বললেন, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি আমার কাছে আমার প্রাণের চেয়েও বেশি প্রিয়!’ একথা শুনে প্রিয়নবী সা. খুব খুশী হলেন। বললেন, হাঁ, এখন তুমি প্রকৃত মুমিন হতে পেরেছ।’
উপরোক্ত কোরআনের আয়াত ও হাদিসদ্বয় দ্বারা বুঝে আসে উম্মতের একটি বড় কর্তব্য হলো নবী কারিম সা,কে সবার থেকে বেশি, এমনকি নিজের জান থেকেও বেশি মুহাব্বত করতে হবে। আর যৌক্তিকভাবেও বলা যায় যে, রাসূলে কারিম সা,ই সবচেয়ে বেশি মুহাব্বত পাওয়ার হকদার।
বলা হয় যখন কোন মানুষকে ভালোবাসা হয় তখন তিনটি কারণে ভালোবাসা হয়।
১/কামালিয়্যত তথা পূর্ণাঙ্গতা,
২/ জামালিয়্যত তথা সৌন্দর্য।
৩/ ইহসানিয়্যত তথা অনুগ্রহ করা।
ধনসম্পদ কি মুহাব্বত লাভের কারণ হতে পারে?
-------------------------------------------------------------------------------------
অনেকে মনে করেন ধনসম্পদের কারণেও মুহাব্বত করা হয়ে থাকে। কিন্তু আমি তা সমর্থন করি না। কারণ ধনসম্পদ থাকলে মানুষের তোষামোদ-খোশামোদ করা হয়। একে মুহাব্বত বলে না। সম্পদের কারণে মুহাব্বত করা হয় একথা যদি মেনেও নেই তাহলে বলবো আমার হাবিব সা, দুনিয়ার সবচেয়ে বড় ধনী ছিলেন। কারণ প্রকৃত ধনী বলা হয় যে মনের দিক থেকে ধনী। যার মনে অপরের প্রতি কোন মুখাপেক্ষীতা নেই। রাসূলে কারিম সা, উদারতায় ছিলেন আকাশের মতো। দানশীলতায় ছিলেন সাগরের মতো। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন উদার ও দানশীল মানব পাওয়া যাবে না।
হযরত জাবের রা, বর্ণনা করেন, এমন কখনো হয়নি যে, রাসূলের কাছে কেউ কিছু চেয়েছে অথচ হুজুর তাকে না করে দিয়েছেন। বুখারী ও মুসলিম।
কোন কবি এই হাদিসের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন, কালেমায়ে শাহাদাতের ‘লা’ ব্যতীত রাসূলের যবানে কখনো অন্য কোন ‘লা’ উচ্চারিত হয়নি।
হযরত আবু হোরাইরা রা, বর্ণনা করেন, নবী কারিম সা, আমভাবে ঘোষণা দিয়ে রেখেছিলেন,
“যে ব্যক্তি ঋণের দায় নিয়ে মৃত্যুবরণ করবে আমি তার ঋণ আদায়ের দায়িত্ব নিচ্ছি। আর যে ব্যক্তি সম্পদ রেখে মারা যাবে তার সম্পদ ওয়ারিস হিসেবে তার সন্তানরা পাবে।” মেশকাত।
রাসূলের জীবনে আমরা এমন ঘটনাও দেখতে পাই যে, একবার রাসূলের মালিকানায় সামান্য পরিমাণ রৌপ্য ছিলো। এজন্য সারারাত ঘুমাতে পারেননি। উম্মুল মুমিনিন এমন অস্থিরতার কারণ জিজ্ঞেস করলে হুজুর বললেন, আমি এ ভয়ে ঘুমাতে পারছি না যে, না জানি এই সম্পদ আমার মালিকানায় থাকাবস্থায়ই আমার মওত চলে আসে।
কখনো এমনো হয়েছে যে, রাসূলের নিকট কোন ভিক্ষুক এসেছে। অথচ তখন দেয়ার মতো কিছুই নেই। কিন্তু ভিক্ষুক খালী হাতে ফিরে যাবে এটা নবীজী সা, মেনে নিতে পারেননি। তাই করজ করে তাকে কিছু দান করেছেন।
যে কথা বলছিলাম। যদি ধন-সম্পদের মালিক হওয়াও মুহাব্বত করার কারণ হয় তাহলে আমাদের নবীজী সা,ই সর্বাধিক মুহাব্বত পাবার হকদার। কারণ তিনি ছিলেন সবচেয়ে ধনী ও দানশীল। তবে বাস্তব কথা হলো ধনসম্পদ কখনো মুহাব্বত পাবার কারণ হতে পারে না। ধনী ব্যক্তিদের সাথে অন্যান্যরা যে আচরণ করে তা মুহাব্বত নয়: তোষামোদী ও চাটুকারিতা। মুহাব্বতের মৌলিক কারণ ঐ তিনটিই। কামাল, জামাল ও ইহসান।
মুহাব্বতের প্রথম কারণঃ-
---------------------------------------
কাউকে মুহাব্বত করা ও ভালোবাসার যেসব কারণ হতে পারে তার মাঝে একটি হলো তার কামাল অর্থাৎ পূর্ণতা। অতীতে এমন অনেক লোক গত হয়েছে যাদের সাথে আমাদের কোন আত্মীয়তার সম্পর্ক নেই। তাদের নিকট থেকে আমরা কোন আর্থিক উপকারিতাও পাইনি। তবুও আমরা তাদেরকে মুহাব্বত করি। এই মুহাব্বাতের কারণ হলো তাদের কামালাত ও বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য।
যেমন হাতেম তাঈকে মানুষ ভালোবাসে তার দানশীলতার জন্যে। নওশেরওয়াকে মানুষ পছন্দ করে তার ন্যায়পরায়ণতার কারণে। মানুষ শেকস্পিয়ার এবং হোমারকে স্মরণ করে তাদের যুগান্তকারী সাহিত্যকর্মের কারণে।
আমরা রুস্তমের প্রশংসা করি তার বীরত্ব ও সাহসিকতার কারণে। আমরা সক্রেতিস ও প্লেটোকে শ্রদ্ধা করি তাদের জ্ঞানের গভীরতার কারণে।
আমরা ফেরদাওসী ও শেখ সাদীকে মুহাব্বত করি তাদের কাব্য প্রতিভার কারণে।
আমরা জাহেলী যুগের কবি লাবিদ ও মুতানাব্বিরও আলোচনা করি তাদের ভাষার মাধুর্য ও অলঙ্কারগুণের কারণে।
যেসব গুণ ও বৈশিষ্টের কারণে এসব লোককে মানুষ ভালোবাসে তা নাকেছ ও ত্রুটিপূর্ণ। কিন্তু আমাদের নবী মুহাম্মদ সা,এর বৈশিষ্ট ও গুণাবলী পূর্ণাঙ্গ। আমরা হাতেম তাঈয়ের দানশীলতার প্রশংসা করি। অথচ হাতেম তাঈয়ের দানশীলতা রাসূলের দানশীলতা- উদারতার সাথে তুলনীয় হতে পারে না। যে মহান মানুষটি বন্ধুর যেমন উপকার করেছেন শত্রুরও তেমনই উপকার করেছেন তার সাথে হাতেম তাঈয়ের কী-ই-বা তুলনা চলতে পারে। যে মহান ব্যক্তিত্বের যবানে কখনো কালেমায়ে শাহাদাতের ‘লা’ ছাড়া কোন ‘লা’ অর্থাৎ না-বাচক শব্দ ব্যবহৃত হয়নি তার সাথে কি হাতেম তাঈয়ের কোন তুলনা করা যায়? যে মহান ব্যক্তির দান দুনিয়ার জীবন অতিক্রম করে আখেরাত পর্যন্ত বিস্তৃত, যিনি উম্মতের প্রতি দুনিয়াতেও অনুগ্রহ করেছেন আখেরাতেও করবেন তার অনুগ্রহ আর দানের সাথে দুনিয়ার কোন দানশীলেরই তুলনা হতে পারে না।
আমি নওশেরওয়ার আদল ও ন্যায়পরায়ণতাকে স্বীকার করি। কিন্তু নওশেরওয়ার ন্যায়বিচার কীভাবে রাসূলে আরবী সা,এর ন্যায়বিচারের সমকক্ষ হতে পারে? যিনি জাহিলী যুগের জুলুম অত্যাচারে জর্জরিত আরববাসীর মাঝে ন্যায়পরায়ণতার ফল্গুধারা প্রবাহিত করতে পেরেছিলেন তিনি কত বড় ইনসাফের অধিকারী ছিলেন তা সহজেই অনুমেয়। সে মহান ন্যায়বিচারক দীপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন, যদি মুহাম্মাদের কন্যা ফাতেমাও চুরি করে তাহলেও ইসলামী শাস্তিবিধান হিসেবে তার হাত কাটা হবে। যিনি প্রতিশোধগ্রহণ করার সুযোগ প্রদান করার জন্য সাধারণ সাহাবীর সামনে পেটের কাপড় সরিয়ে দেন, যার অনুসারীরা কিসরা ও কায়সারের অন্যায়-দুঃসাশনের ধ্বংস সাধন করে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে পারে তার ন্যায় পরায়ণতার সাথে দ্বিতীয় কোন ব্যক্তির ন্যায়পরায়ণতার কোন তুলনাই হয় না।
আমি বীর রুস্তম ও আলেকজ্যান্ডারের বীরত্বের প্রশংসা করি। কিন্তু এদের বীরত্ব কখনো ঐ ব্যক্তির বীরত্ব ও সাহসের মুকাবেলা করতে পারে না যিনি কোন ধরনের অস্ত্র ও সৈন্য ছাড়াই আরবের পশুসুলভ মানুষগুলোর একাই মুকাবেলা করেছেন।
আমি সক্রেতিস ও প্লেটোর প্রজ্ঞা ও দর্শনের তারীফ করি। কিন্তু সেই মহান ব্যক্তির হিলম ও প্রজ্ঞা এবং জ্ঞান-গরিমার তারীফ কোন ভাষায় করতে পারি যার জ্ঞান-রশ্মির সামান্য কিরণেই হাজার হাজার সক্রেতিস ও প্লেটো জন্ম নিয়েছে।
আমি শেক্সপিয়ার ও হোমারের সাহিত্য-যোগ্যতাকে অস্বীকার করছি না কিন্তু সেই অলংকারপূর্ণ ভাষার অধিকারী রাসূলে উম্মী সা, এর সাথে শেক্সপিয়ারের কোন তুলনাই চলে না যে ব্যক্তির ভাষার সৌন্দর্য ও অলংকার-শৈলীর আজো পর্যন্ত ভুল ধরতে পারেনি কোন আরব ভাষাবিজ্ঞানী। এসকল ব্যক্তিকে যদি তাদের যোগ্যতা ও বিশেষ গুণাবলীর কারণে মুহাব্বত করা হয় তাহলে সেই মহান ব্যক্তিত্বকে কেন মুহাব্বত করবো না, ভালোবাসবো না যিনি ছিলেন সকল মানবীয় গুণাবলীর আধার। যার মাঝে সকল গুণ ছিল পূর্ণমাত্রায়?
এরা সবাই তো দুনিয়ার সাধারণ মানুষ। আমরা তো বলি দুনিয়াতে যে সকল মহামানব নবী হিসেবে প্রেরিত হয়েছিলেন তাদের প্রত্যেকের গুণ ও বৈশিষ্ট্য আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মদ সা,কে প্রদান করা হয়েছিলো।
হযরত আদম আ,এর চরিত্র, শীস আ,এর মারেফাত, নূহ আ,এর দ্বীনপ্রচারের জযবা, ইবরাহী আ,এর সুগভীর তাওহীদ-বিশ্বাস, ইসমাঈল আ, এর কোরবানি ও আত্মত্যাগ, ইসহাক আ,এর সদা-সন্তুষ্ট-চিত্ত, সালেহ আ,এর ভাষা-কুশলতা, লুকমান আ,এর হিকমাত ও প্রজ্ঞা, মূসা আ,এর গাম্ভীর্য, ইয়াকুব আ,এর ধৈর্য ও সহনশীলতা, দাউদ আ,এর আওয়াজের সৌন্দর্য, আইউব আ,এর কষ্ট-সয়িষ্ণুতা, ইউনুস আ,এর আনুগত্য, ইউশা আ,এর রণদক্ষতা, ইউসুফ আ,এর সৌন্দর্য, এবং ঈসা আ,এর দুনিয়ার প্রতি নিরাসক্তি সহ সকল গুণ জমা হয়েছিল রাসূলে আরাবী সা,এর পবিত্র জীবনে।
এজন্য হযরত কাসেম নানুতুবি রহ, বলেছেন, সারা জাহানের সকল কামালাত আপনার মাঝে রয়েছে, কিন্তু আপনার সকল বৈশিষ্ট্য কারো মাঝে নেই দুয়েকটি ব্যতীত।
মুহাব্বতের দ্বিতীয় কারণ হলো জামাল বা সৌন্দর্যঃ-
----------------------------------------------------------------------------
অনেক সময় মানুষকে ভালোবাসা হয় তার সৌন্দর্যের কারণে। যদিও হুসন ও জামাল এবং সৌন্দর্য ভালোবাসা লাভের হাকিকী কোন কারণ নয়। এবং এটা স্থায়ী কোন ভিত্তিও নয়। তবুও এমন লোকের সংখ্যাও কম নয় যারা শুধু সৌন্দর্য দেখেই মুগ্ধ হয়ে প্রেমে পড়ে।
মনে রাখবেন যে, সমস্ত নবীকেই আল্লাহ তাআলা আখলাকের সৌন্দর্যের সাথে চেহারা ও শরীরের সৌন্দর্য দান করেছেন। যাতে কেউ যেন তাদের আখলাক নিয়েও সমালোচনা করতে না পারে, এবং শারীরিক কোন ত্রুটি ধরেও উপহাস করতে না পারে। নবীগণের চেহারাও এমন হয় যে, মানুষ দেখলেই বলতে বাধ্য হয় ইনি সত্যবাদী। ইনি কখনো মিথ্যাবাদী হতে পারেন না। রাসূলে কারিম সা,এর চেহারার আছর ও সৌন্দর্য বিষয়ে সাহাবায়ে কেরাম রা, কী বলেছেন তা দেখুন।
১/ ইহুদীদের একজন বড় পন্ডিত ছিলেন। নাম আব্দুল্লাহ ইবনে সালাম। তিনি বলেন, আমি যখন রাসূলের চেহারার দিকে তাকালাম তখন বুঝতে পারলাম তার চেহারা কোন মিথ্যাবাদীর চেহারা নয়।
২/ হযরত আবু রাফে রা, কোরাইশদের পয়গাম নিয়ে রাসূলের দরবারে এসেছিলেন। তিনি বলেন, যখন আমি রাসূলে কারিম সা,এর চেহারার দিকে তাকালাম তখনই আমার হৃদয়ে ইসলাম বসে গেলো।
৩/ হযরত আবু হোরাইরা রা, বলেন আমি রাসূলের চেহারার থেকে সুন্দর কোন চেহারা দেখিনি। তার চেহারায় যেন সূর্য খেলা করতো।
৪/ হযরত আনাস রা, রাসূলে কারিম সা,এর নূরানী চেহারা দেখে সবাইকে বলতেন, রাসূলে কারিম সা, ছিলেন শুভ্র রঙের অধিকারী। তার ঘামগুলো দেখলে মনে হত মুক্তোদানা।
৫/ হযরত আলী রা, রাসূলে কারিম সা,এর রূপ-সৌন্দর্য বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন, যে ব্যক্তি রাসূলকে প্রথমবার দেখতো সে কিছুটা ভয় পেতো। আর যে রাসূলের সাথে মিশতো সে তাকে সবচেয়ে ভালোবাসতো। তার প্রশংসাকারী বলতো, আমি তার মতো পূর্ণতার অধিকারী ব্যক্তিত্ব ইতিপূর্বে না কাউকে দেখেছি, না পরে কাউকে দেখেছি।
৬/ হযরত বারা বিন আযেব রা, বলেন, আমি লাল চাদরে আবৃত লম্বা চুলের অধিকারী রাসূলের থেকে সুন্দর দ্বিতীয় কাউকে দেখিনি।
৭/ হযরত কা‘ব বিন মালেক রা, বলেন, নবীজী সা, যখন হাসতেন তখন তার চেহারা এতোটাই উদ্ভাসিত হয়ে যেতো যে, মনে হতো তা যেন একখন্ড চাদ।
হযরত সাহাবায়ে কেরাম রা,এর বর্ণনায় এরকম অসংখ্য হাদিস আলোচিত হয়েছে যাতে রাসূলে কারিম সা,এর অতুলনীয় রূপ-সৌন্দর্যের বর্ণনা রয়েছে। সুতরাং আপনি যদি সৌন্দর্যের কারণেই কাউকে ভালোবাসেন তাহলে আল্লাহর রাসূলকেই সবচাইতে বেশি ভালোবাসা লাভ করার হকদার। এজন্যই রাসূলের সৌন্দর্যের উপমা দিতে গিয়ে বলা হয় সৌন্দর্যের আধার হযরত ইউসুফ আ,এর রূপ দেখে নারীরা তাদের হাত কেটে ফেলেছিল, আর আমাদের নবী মুহাম্মদ সা,এর রূপে পাগল হয়ে সাহাবায়ে কেরাম রা,গলা পর্যন্ত কেটে ফেলতে দ্বিধা করেনি।
মুহাব্বত লাভ করার তৃতীয় কারণ হলো ইহসান ও অনুগ্রহঃ-
--------------------------------------------------------------------------------
মানুষের একটি মানবীয় স্বভাব হলো সে তার প্রতি অনুগ্রহকারীকে অত্যন্ত মুহাব্বত করে। আরবীতে একটি প্রসীদ্ধ প্রবাদ আছে যে, মানুষ অনুগ্রহের দাস। অর্থাৎ কাউকে যদি নিজের অনুগত বানাতে চান তাহলে তার উপর অনুগ্রহ করতে হবে। তার মাঝে যদি কৃতজ্ঞতাবোধ থাকে তাহলে সে আপনার অনুগত হবে। আর একথা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না যে, মহান আল্লাহর পর আমাদের উপর সবচেয়ে অনুগ্রহ ও ইহসান রাসূলে কারিম সা,এর। ভালো করে শুনে নিন, আমার উপর সবচেয়ে বড় অনুগ্রহকারী আমার কোন বন্ধু নয়, আমার কোন আত্মীয় নয়, আমার কোন উস্তায নয়। বরং আমি সহ সকল মানুষের উপর সবচেয়ে বড় অনুগ্রহকারী রাসূলে খোদা সা,।
যিনি আমাদেরকে আল্লাহর সাথে সম্পর্ক করিয়েছে। যিনি গাছ ও পাথড় এবং পোকা-মাকড়ের উপাসনা থেকে মানুষকে বাচিয়ে এক আল্লাহর উপাসনায় নিয়োজিত করেছেন। যিনি এতীমের সম্পদ হেফাজতের ব্যবস্থা করেছেন। জাহেলি যুগে বিধবাকে ঘৃণা করা হতো। এই বিধবাকে গৃহিনী বানিয়ে তিনি উম্মতের সামনে অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত কায়েম করেছেন। সে যুগে শ্রমিকের অধিকার হরণ করা হতো, তার ন্যায্য পাওনা থেকে তাকে বঞ্চিত করা হতো অথচ নবী কারিম সা এরশাদ করেছেন, শ্রমিকের ঘাম শুকানোর পূর্বে তার ন্যায্য পারিশ্রমিক পরিশোধ করে দাও। এভাবে শ্রমিক ও দিনমজুরের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে পৃথিবীর ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করেছেন। সে যুগে সারা পৃথিবীতে নারীর সাথে চতুষ্পদ জন্তু-জানোয়ারের মতো আচরণ করা হতো। নবী কারিম সা, তাকে মা-কন্যা ও স্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে ধন্য করেছেন। বলেছেন,
তোমাদের মধ্যে সেই সর্বোত্তম যে তার বিবির কাছে উত্তম। মার ব্যাপারে এরশাদ করেছেন, মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের জান্নাত। তিনি যে যুগে দুনিয়াতে এসেছিলেন তখন কন্যা সন্তানকে জীবিত দাফন করা হতো। এই নির্মম জুলুমের বিলোপ সাধন করে তিনি ঘোষণা করলেন, যে বাবা আপন কন্যা সন্তানকে সুন্দরভাবে লালন-পালন করবে এবং তার হকগুলো যথাযথভাবে আদায় করবে সে জান্নাতে আমার এতো নিকটে থাকবে যেমন দুই আঙ্গুল পাশাপাশি থাকে।
জাহেলি যুগে মানুষের জীবন ও রক্তের কোন মূল্য ছিল না। যখন তখন যেখানে সেখানে মানুষের রক্ত ঝারানো হতো, নিশংসভাবে হত্যা করা হতো। রাসূলে কারিম সা, ঘোষণা দিলেন, যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করবে সে জাহান্নামী। যে যুগে মানুষ বংশ নিয়ে গর্ব করতো, দুনিয়ার সম্পদ ও ক্ষমতা নিয়ে অহংকার করতো। এজন্য নিম্নস্তরের কোন মানুষকে মানুষ মনে করতো না। জাতিভেদ প্রথায় জর্জরিত ছিলো সবাই। রাসূল সা, ঘোষণা করলেন, কোন আরবীর অনারবীর উপর শ্রেষ্ঠত্ব নেই। শ্রেষ্ঠত্ব হচ্ছে আমলের উপর।
আরেকদিক থেকে চিন্তা করে দেখুন, রাসূল সা,কে পাগল বলা হয়েছে, কিন্তু কী কারণে? রাসূলের গায়ে পাথর নিক্ষেপ করা হয়েছে, পচা নাড়িভুড়ি চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু কী কারণে? মাতৃভূমি ত্যাগ করতে হয়েছে, কী কারণে? সামাজিকভাবে বয়কট করা হয়েছে, কী এমন দোষ ছিলো তার? পিটিয়ে শরীরকে রক্তাক্ত করা হয়েছে, কী অপরাধ ছিল তার? বাস্তবতা এই যে, এ সকল কষ্ট নির্যাতন সহ্য করেছিলেন একমাত্র উম্মতের কারণে। হুজুরের চাহিদা ছিলো না কোন ধন-সম্পদের, চাহাত ছিলো না ক্ষমতা লাভের। একটিই মাত্র তামান্না ছিলো হুজুরের দীলে উম্মত জাহান্নাম থেকে বেচে জান্নাত লাভ করুক।
যে মহান নবী আমাদের জন্য এতো দুঃখ কষ্ট বরদাশত করেছেন অবশ্যই তিনি আমাদের সবচেয়ে বেশি মুহাব্বত লাভের হকদার। নবী সা, সর্বদাই উম্মতের ফিকিরে নিমজ্জিত থাকতেন। রাতের নির্জনতায় উম্মতের ফিকির, দিনের ব্যস্ততায় উম্মতের ফিকির। মক্কাতেও উম্মতের ফিকির, মদীনাতেও। বদর-উহুদ প্রান্তরেও উম্মতের ফিকির। সুস্থতায় উম্মতের ফিকির, অসুস্থতায়ও উম্মতের ফিকির। যৌবনে উম্মতের ফিকির, বার্ধক্যতেও উম্মতের ফিকির। বিছানায় শায়িত তবুও উম্মতের ফিকির, মেরাজের রাতে প্রিয়-প্রেমিকের সাথে সাক্ষাত, সেখানেও উম্মতের ফিকির। দুনিয়া থেকে চলে যাওয়ার পরও উম্মতের ফিকির। রওজা মোবারকেও উম্মতের ফিকির।
কেয়ামতের ভয়ানক দিনে যখন আদম সফীউল্লাহ, ইবরাহীম খলীলুল্লাহ, মূসা কালিমুল্লাহ, ঈসা রুহুল্লাহ সহ সকল নবী ইয়া নাফসি ইয়া নাফসি-হায় আমার কী হবে বলতে থাকবে তখন একমাত্র সওদারে কাওনাইন সাইয়িদুল মুরসালিন শাফীয়ে মুযনিবীন মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সা উম্মাতি উম্মাতি-হায় আজ আমার উম্মতের কী হবে বলে অস্থির থাকবেন।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে বুঝে আসে রাসূলে কারিম সা,ই আমাদের সবচেয়ে বেশি ভালোবাসা ও মুহাব্বত লাভ করার হকদার। আর কোরআনের আয়াত ও হাদিসেও স্পষ্টাকারে বলে দেয়া হয়েছে যে, দুনিয়ার সবার থেকে বেশি মুহাব্বত করতে হবে রাসূলকে। এমনকি নিজের জীবন থেকেও বেশি ভালোবাসতে হবে রাসূলে কারিম সা,কে। তা না হলে পূর্ণাঙ্গ মুমিন হওয়া যাবে না, হওয়া যাবে না রাসূলের সাচ্চা ও খাটি উম্মত।
আল্লাহ আমাদের সবাইকে উপরোক্ত কথাগুলোর উপর আমল করার তাওফিক দান করুন।
Comments
Post a Comment