মদ ও জুয়াবাজি একটি ঘৃণিত ও গর্হিত কাজ:-
**************************************
জাহেলিয়াতের যুগে জুয়ার কার্যক্রম ব্যাপক আকারে প্রচলিত ছিল। তারা এর প্রতি এমন আসক্ত ছিল যে, কখনো কখনো স্ত্রী, ছেলে-মেয়েদেরও বাজির উপকরণ বানিয়ে ফেলত। এ ছাড়াও তাদের মধ্যে জয়-পরাজয়ের বিভিন্ন খেলা-ধুলাসহ নানা রকম জুয়ার প্রচলন ছিল।
বর্তমানে খেলাধুলাকে কেন্দ্র করে বিশ্বব্যাপী চলে এই অবৈধ জুয়াবাজি। বিশেষ করে ক্রিকেট খেলা নিয়ে জুয়াবাজির মাত্রা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। কোন খেলায় কোন দল জিতবে কোন দল হারবে, কোন ওভারে কয় রান করবে, কয়টা ছক্কা-চার মারবে, কয় উইকেট পড়বে, কয়টা বল ওয়াইড-নো হবে, এমনকি বলে বলেও চলে জুয়াবাজি। সাধারণভাবে জুয়াবাজিকে হারাম জানলেও এ ক্ষেত্রে বন্ধু-বান্ধব, রুমমেট কিংবা সহকর্মীদের
মধ্যে হাসতে হাসতেই চলে তা। অমুক দল জিতলে তুমি আমাকে দেবে এক হাজার টাকা, আর হারলে আমি তোমাকে দেবো এক হাজার টাকা এটি হলো জুয়ার ধরন। শুধু একপক্ষ থেকে দেয়ার শর্ত করা হলে তা জুয়ার অন্তর্ভুক্ত হবে না। আন্তর্জাতিক বাজিকররা কোটি কোটি টাকা লাভ-লোকসান করে ক্রিকেট ও বলখেলা নিয়ে। তাদের কারণে অনেক ক্রিকেটারের ক্যারিয়ার পর্যন্ত নষ্ট হয়ে গেছে। এ ছাড়াও বর্তমান সমাজে লটারি, হাউজি, বাজি ধরা, চাক্কি ঘোরানো, রিং নিক্ষেপসহ বিভিন্ন ধরনের জুয়ার প্রচলন রয়েছে। এগুলো কখনো মানুষের কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না।
মদ ও জুয়াখেলা একটি ঘৃণিত কাজ। এটি একটি মারাত্মক সামাজিক অপরাধ। জুয়াড়ির জীবন-সংসার কুঁরে কুঁরে বিনষ্ট হয়। ইসলামের দৃষ্টিতে তা সম্পূর্ণ অবৈধ ও হারাম। হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে,
আবদুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত,
রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, ‘পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তান, জুয়া ও লটারীতে অংশগ্রহণকারী, খোঁটাদানকারী এবং সর্বদা মদপানকারী জান্নাতে যাবে না’।
(দারেমী, মিশকাত হা/৩৬৫৩; বাংলা মিশকাত ৭ম খণ্ড, হা/৩৪৮৬ ‘শাস্তি’ অধ্যায়)।
১০০ সুসাব্যস্ত হাদিস, হাদিস নং ৭৫।
এ ব্যাপারে কোনো আলেম দ্বিমত পোষণ করেননি। আরবিতে জুয়াকে বলা হয় মাইসির ও কিমার। বাংলা ও উর্দুতে এর প্রতিশব্দ হচ্ছে জুয়া। জুয়ার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে তাফসিরে মাআরিফুল কুরআনের লেখক মুফতি মুহাম্মদ শফী (রহ:) বলেন, ‘যে চুক্তিতে কোনো সম্পদের মালিকানায় এমন সব শর্ত আরোপিত হয়, যাতে মালিক হওয়া না হওয়া উভয় সম্ভাবনাই সমানভাবে বিদ্যমান থাকে, এর ফলে পূর্ণ লাভ বা লোকসান উভয় দিকেই বজায় থাকে, এটিই হলো জুয়া।’
(ফাতাওয়া শামী : ৫/৩৫৫)।
রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা মদ, জুয়া ও সব ধরনের বাদ্যযন্ত্র হারাম করেছেন’। (বায়হাক্বী, হাদীছ ছহীহ, মিশকাত হা/৪৫০৩; বাংলা মিশকাত ৮ম খণ্ড হা/৪৩০৪)।
মদ সম্পর্কে সর্বপ্রথম আল্লাহ এভাবেই নিরুৎসাহিত করছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন,
এটি হচ্ছে মদ সম্পর্কে প্রথম নির্দেশ। এখানে শুধুমাত্র অপছন্দের কথা ব্যক্ত করে ছেড়ে দেয়া হয়েছে, যাতে মন ও মস্তিষ্ক তার হারাম হবার বিষয়টি গ্রহণ করে নিতে প্রস্তুত হয়ে যায়। পরে মদ পান করে নামায পড়া নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করা হয়। তারপর সবশেষে মদ ও জুয়া এবং এই পর্যায়ের সমস্ত বস্তুকে চিরতরে হারাম ঘোষণা করা।
পরবর্তীকালে আল্লাহ তায়ালা বলেন,
মদ-জুয়ার ৩টি পরিণাম ভয়াবহ। যেমন-
১.ব্যক্তিগতভাবে অনৈতিক ও অমানবিক অপরাধ।
২.পারিবারিক অশান্তি ও বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি।
৩.সামাজিক অবক্ষয়।
জুয়ার যাবতীয় প্রক্রিয়াকে হারাম ও নিষিদ্ধ
এ আয়াতে চারটি জিনিস চূড়ান্তভাবে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। এক, মদ। দুই, জুয়া। তিন, এমন সব জায়গা যেগুলোকে আল্লাহ ছাড়া আর কারোর ইবাদাত করার অথবা আল্লাহ ছাড়া আর কারো জন্য কুরবানী করার ও নজরানা দেবার জন্য নির্দিষ্ট করা হয়েছে। চার, ভাগ্য নির্ণায়ক শর। এগুলোরর মমধ্যে মদ সম্পর্কে বিস্তারিত বিধান নীচে দেয়া হলোঃ
এই নির্দেশটি আসার আগে নবী ﷺ তাঁর এক ভাষণে লোকদেরকে সতর্ক করে দিয়ে বলেনঃ মহান আল্লাহ মদ অত্যন্ত অপছন্দ করেন। মদ চিরতরে হারাম হয়ে যাবার নির্দেশ জারি হওয়া মোটেই বিচিত্র নয়। কাজেই যাদের কাছে মদ আছে তাদের তা বিক্রি করে দেয়া উচিত। এর কিছুদিন পর এ আয়াত নাযিল হয়। এবার তিনি ঘোষণা করেন, এখন যাদের কাছে মদ আছে তারা তা পান করতে পারবে না এবং বিক্রিও করতে পারবে না বরং তা নষ্ট করে দিতে হবে। কাজেই তখনই মদীনার সমস্ত গলিতে মদ ঢেলে দেয়া হয়। অনেকে জিজ্ঞেস করেন, এগুলো ফেলে না দিয়ে আমরা ইহুদীদেরকে তোহফা হিসেবে দিই না কেন? জবাবে নবী করী (স) বলেন, “যিনি একে হারাম করেছেন তিনি একে তোহফা হিসেবে দিতেও নিষেধ করেছেন।” কেউ কেউ জিজ্ঞেস করেন, আমরা মদকে সিরকায় পরিবর্তিত করে দিই না কেন? তিনি এটিও নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন এবং নির্দেশ দেনঃ “না ওগুলো ঢেলে দাও।” এক ব্যক্তি অত্যন্ত জোর দিয়ে জিজ্ঞেস করেন ওষুধ হিসেবে ব্যবহারের নিশ্চয়ই অনুমতি আছে? জবাব দেনঃ “না, এটা ওষুধ নয় বরং রোগ।” আর একজন আরয করেন, “হে আল্লাহর রসূল! আমরা এমন এক এলাকার অধিবাসী যেখানে শীত অত্যন্ত বেশী এবং আমাদের পরিশ্রমও অনেক বেশী করতে হবে। আমরা মদের সাহায্যে ক্লান্তি ও শীতের মোকাবিলা করি। তিনি জিজ্ঞেস করেন, তোমরা যা পান করো তা কি নেশা সৃষ্টি করে? লোকটি ইতিবাচক জবাব দেন। তখন তিনি বলেন, তাহলে তা থেকে দূরে থাকো। লোকটি তবুও বলেন, কিন্তু এটা তো আমাদের এলাকার লোকেরা মানবে না। জবাব দেন, “তারা না মানলে তাদের সাথে যুদ্ধ করো।”
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) রেওয়ায়াত করেছেন, নবী ﷺ বলেন, “আল্লাহ লানত বর্ষণ করেছেন
(১) মদের ওপর,
(২) মদ পানকারীর ওপর,
(৩) মদ পরিবেশনকারীর ওপর,
(৪) মদ বিক্রতার ওপর,
(৫) মদ ক্রয়কারীর ওপর,
(৬) মদ উৎপাদন ও শোধনকারীর ওপর,
(৭) মদ উৎপাদন ও শোধনের ব্যবস্থাপকের ওপর, (৮) মদ বহনকারীর ওপর এবং
(৯) মদ যার কাছে বহন করে নিয়ে যাওয়া হয় তার ওপর।”
অন্য একটি হাদীসে বলা হয়েছে, নবী ﷺ এমন দস্তরখানে আহার করতে নিষেধ করেছেন যেখানে মদ পান করা হচ্ছে। প্রথম দিকে তিনি যেসব পাত্রে মদ তৈরী ও পান করা হতো সেগুলোর ব্যবহারও নিষিদ্ধ করে দেন। পরে মদ হারাম হবার হুকুমটি পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে তিনি পাত্রগুলো ব্যবহার করার অনুমতি দেন।
‘খামর’ শব্দটি আরবীতে মূলত আংগুর থেকে তৈরী মদের জন্য ব্যবহৃত হতো পরোক্ষ অর্থে গম, যব, কিসমিস, খেজুর ও মধু থেকে উৎপাদিত মদকেও খামর বলা হতো। কিন্তু নবী ﷺ তাঁর এ নির্দেশকে নেশা সৃষ্টিকারী প্রত্যেকটি জিনিসের ওপর ব্যাপ্ত করে দিয়েছেন। তিনি হাদীসে স্পষ্ট বলেছেনঃ (আরবী) “প্রত্যেকটি নেশা সৃষ্টিকারী জিনিস মদ এবং প্রত্যেকটি নেশা সৃষ্টিকারী বস্তু হারাম।” তিনি আরো বলেছেন, “যে কোন পানীয় নেশা সৃষ্টি করলে তা হারাম।
তিনি আরো বলেনঃ (আরবী) “আর আমি প্রত্যেকটি নেশা সৃষ্টিকারী জিনিস ব্যবহার করতে নিষেধ করছি।”
হযরত উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু জুমার খুতবায় মদের সংজ্ঞা এভাবে দেনঃ (আরবী) “মদ বলতে এমন সব জিনিসকে বুঝায় যা বুদ্ধিকে বিকৃত করে ফেলে।”
এ ছাড়াও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা ও মূলনীতি বর্ণনা করেছেনঃ (আরবী) “যে জিনিসের বেশী পরিমাণ নেশা সৃষ্টি করে তার সামান্য পরিমাণও হারাম।” তিনি আরো বলেছেনঃ
“যে জিনিসের বড় এক পাত্র পরিমাণ পান করলে নেশা হয় তা ক্ষুদ্র পরিমাণ পান করাও হারাম।”
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে মদ পানকারীর জন্য বিশেষ কোন শাস্তি নির্ধারিত ছিল না। যে ব্যক্তিকে এ অপরাধে গ্রেফতার করে নিয়ে আসা হতো তাকে কিল থাপ্প্ড়, জুতা, লাথি গিঁট বাঁধা পাকানো কাপড় ও খেজুরের ছড়া দিয়ে পেটানো হতো। রসূলের আমলে এ অপরাধে বড় জোর চল্লিশ ঘা মারা হতো। হযরত আবু বকরের (রা.) আমলে ৪০ ঘা বেত্রাঘাত করা হতো। হযরত উমরের (রা.) আমলেও শুরুতে ৪০ ঘা বেত মারা হতো। কিন্তু যখন তিনি দেখলেন লোকেরা এ অপরাধ অনুষ্ঠান থেকে বিরত থাকছে না তখন তিনি সাহাবায়ে কেরামের সাথে পরামর্শক্রমে এ অপরাধের দণ্ড হিসেবে ৮০ টি বেত্রাঘাত নির্ধারণ করেন। ইমাম মালেক, আবু হানীফা এবং একটি বর্ণনা অনুযায়ী ইমাম শাফেঈও এ শাস্তিকেই মদ পানের দণ্ড হিসেবে গণ্য করেছেন। কিন্তু ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল এবং অন্য একটি বর্ণনা অনুযায়ী ইমাম শাফেঈ ৪০ বেত্রাঘাতকেই এর শাস্তি হিসেবে মেনে নিয়েছেন। হযরত আলীও (রা.) এটিই পছন্দ করেছেন।
শরীয়াতের দৃষ্টিতে মদের প্রতি নিষেধাজ্ঞার এ বিধানটিকে শক্তি প্রয়োগ করে প্রতিষ্ঠিত করা ইসলামী রাষ্ট্রের কর্তব্যের অন্তর্ভুক্ত। হযরত উমরের শাসনামলে রুয়াইশিদ নামক এক ব্যক্তির একটি দোকান পুড়িয়ে দেয়া হয়। কারণ সে লুকিয়ে লুকিয়ে মদ বিক্রি করতো। আর একবার হযরত উমরের হুকুমে পুরো একটি গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া হয়। কারণ সেই গ্রামে গোপনে মদ উৎপাদন ও চালান করা হতো এবং মদ বেচাকেনার কারবারও সেখানে চলতো।পরবর্তী আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন,
(সূরা মায়েদা : ৯০-৯১)
জাহেলিয়াতের যুগে ঘোড়দৌড়েও জুয়ার প্রচলন ছিল। দুই ব্যক্তি ঘোড়দৌড়ের প্রতিযোগিতায় নামত এবং পরস্পরে এ চুক্তিতে আবদ্ধ হতো,যে পরাজিত হবে সে বিজয়ীকে নির্ধারিত পরিমাণ অর্থ দেবে। রাসূলুল্লাহ সা: একেও জুয়ার অন্তর্ভুক্ত করে হারাম ঘোষণা করেছেন। (সুনানে আবু দাউদ)
জুয়ার মৌলিক বিষয়গুলো হচ্ছে :
১. কিমার বা জুয়া দুই বা ততোধিক ব্যক্তির মধ্যে সংঘটিত একটি ভারসাম্যহীন চুক্তি।
২. এ চুক্তিতে নিজের সামান্য পরিমাণ সম্পদ বাজি ধরে অন্যের বিপুল পরিমাণ সম্পদ শোষণের এক অভিনব কৌশল।
৩. জুয়ায় অপরের অর্থসম্পদ শোষণ ও উপার্জন অনিশ্চিত এমন কোনো বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল হয়, যা হওয়া না হওয়া উভয় সম্ভাবনাই সমানভাবে বিদ্যমান থাকে।
৪. জুয়ায় দু’পক্ষের একপক্ষ সমূলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, আর অপরপক্ষ কোনোরূপ বিনিময় ছাড়াই প্রথম পক্ষের অর্থসম্পদ লুটে নেয়। ফলে একপক্ষ জিতে লাভবান হয়, আর অপরপক্ষ হেরে সর্বস্ব হারিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যে চুক্তিতেই এ চারটি মৌলিক বিষয় পাওয়া যাবে, সেটি জুয়া হিসেবে পরিগণিত হবে।
রাসূলুল্লাহ সা: শুধু জুয়াকেই হারাম করেননি, বরং জুয়ার ইচ্ছা প্রকাশকেও গুনাহ সাব্যস্ত করেছেন। যে ব্যক্তি অপরকে জুয়া খেলার জন্য ডাকবে তাকেও গুনাহর প্রায়শ্চিত্ত হিসেবে কিছু সদকা করার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন,
রিয়াদুস সলেহিন, হাদিস নং ১০৬।
উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে বোঝা গেল, খেলা-ধুলাসহ সব ধরনের জুয়াবাজি অবৈধ এবং এর থেকে প্রাপ্ত সম্পদ হারাম। আর হারাম সম্পদ ভোগ করে ইবাদত-বন্দেগি করলে আল্লাহর দরবারে কবুল হয় না। তাই সব ধরনের
Comments
Post a Comment