বিজ্ঞানের সমন্বয়ে নবিজীর মিরাজের তাত্ত্বিক বিশ্লেষণঃ-
*************************************
﴿سُبۡحٰنَ الَّذِىۡۤ اَسۡرٰى بِعَبۡدِهٖ لَيۡلاً مِّنَ الۡمَسۡجِدِ الۡحَرَامِ اِلَى الۡمَسۡجِدِ الۡاَقۡصَا الَّذِىۡ بٰرَكۡنَا حَوۡلَهٗ لِنُرِيَهٗ مِنۡ اٰيٰتِنَاؕ اِنَّهٗ هُوَ السَّمِيۡعُ الۡبَصِيۡرُ﴾,,,
' অর্থাৎ পরম পবিত্র ও মহিমাময় সত্ত্বা তিনি, যিনি স্বীয় বান্দাকে রাতের বেলায় ভ্রমণ করিয়েছেন মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত, যার চার দিকে আমি পর্যাপ্ত বরকত দান করেছি, নিশ্চয়ই তিনি পরম শ্রবণকারী ও দর্শনশীল। (সূরা বনী ইসরাঈল, আয়াত- ১)
উল্লেখিত আয়াতে যে ‘আসরা’ শব্দটি এসেছে, তা 'ইসরা' ধাতু থেকে উৎপন্ন। এর আভিধানিক অর্থ রাতে নিয়ে যাওয়া। যেহেতু রাসূলে পাক (সাঃ) মহান আল্লাহ পাকের নির্দেশে হযরত জিব্রাঈল (আঃ)-এর সঙ্গী হয়ে হযরত উম্মে হানীর ঘর থেকে বের হয়ে পবিত্র খানায়ে কাবায় এসে বোরাকে আরোহনপূর্বক অতি অল্প সময়ের মধ্যে 'বায়তুল মুকাদ্দাস' বা 'মসজিদে আকসায়' এসে উপস্থিত হন।
পথিমধ্যে তিনি 'আলমে বারযাখের' অনেক আশ্চর্যজনক বিষয় প্রত্যক্ষ করেন। মসজিদে আকসায় এসে সমস্ত আম্বিয়া কেরামের উপস্থিতিতে সকল নবী আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইমাম হয়ে তিনি দু’রাকাত নামাজ আদায় করেন। নামাজ শেষে সকল নবী আলাইহি ওয়া সাল্লাম রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শ্রেষ্ঠত্বের প্রশংসা করে সংক্ষিপ্ত ভাষণ বা খুতবা পেশ করেন। খুতবা প্রদান করে ইমামুল মুরসালীন হিসেবে সকলের থেকে বিদায় গ্রহণ করেন। এ প্রক্রিয়াকেই আরবি ভাষায় "ইসরা" বলা হয়।
পবিত্র আয়াতে কারীমায় এ দিকেই ইঙ্গিত প্রদান করা হয়েছে। আয়াতে কারীমায় প্রথমেই 'সুবহানা' শব্দ ব্যবহার করে মহান আল্লাহ তায়ালা জগতবাসীকে জানিয়ে দিলেন যে, মেরাজ তোমাদের কাছে আশ্চর্যের বিষয় মনে হবে আর এ ঘটনাকে আল্লাহ তায়ালা 'সুবহানা' শব্দ দ্বারা বর্ণনা করেছেন। যা সত্যিই আশ্চর্যের বিষয় মনে হবে। অথচ ইহাই বাস্তবে ঘটনা।
আয়াতে কারীমায় 'আসরা' দ্বারা রাত্রিকালীন ভ্রমণ বুঝানো হয়েছে। এর দ্বারা বুঝা যায় যে, মেরাজ রাতে হয়েছে। আয়াতে 'বি-আবদিহী' দ্বারা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বুঝানো হয়েছে। আমার বান্দা বলে প্রেমময়তা বুঝানো হয়েছে। কেননা আল্লাহ তায়ালা তাঁর কোনো বান্দাকে আমার বান্দা বলার দ্বারা তাঁর প্রতি ভালোবাসাই বুঝায়।
আর আয়াতে 'বি-আবদিহী' দ্বারা বুঝা যায় যে, মেরাজ স্ব-শরীরে হয়েছে। কারণ, শুধু আত্মাকে বান্দা বলে না বরং আত্মা ও দেহ উভয়ের সমষ্টিকেই বান্দা বলা হয়।
এছাড়া রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াাসাল্লাম মেরাজ থেকে এসে উম্মে হানীকে যখন ঘটনা শোনালেন তিনি বললেন, আপনি কারোও কাছে ইহা প্রকাশ করবেন না; প্রকাশ করলে কাফেররা আপনাকে আরও বেশি মিথ্যারোপ করবে। মেরাজ যদি স্বপ্নই হতো তাহলে মিথ্যারোপের কারণ থাকতে পারে না। কেননা স্বপ্নে মানুষ অনেক কিছুই দেখতে পারে, তা অস্বীকার বা মিথ্যারোপের কোনো কারণ থাকতে পারে না। মেরাজ সত্য এবং স্ব-শরীরে হয়েছে বিধায় কাফেররা ইহাকে মিথ্যারোপ করতে পারে। এতেই বুঝা গেলো যে, মেরাজ স্ব-শরীরে ছিল।
আয়াতে কারীমায় 'লাইলাম' শব্দ ব্যবহারের দ্বারা বুঝা গেলো মেরাজ রাতের সামান্য সময় ছিলো। মেরাজের জন্য সারারাত প্রয়োজন হয় নি। দুনিয়ার হিসেবে ইহা নিতান্ত সামান্য সময়।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উম্মে হানীর ঘরে শায়িত থেকে সেখান থেকে জিব্রাঈল (আঃ)-এর আহ্বানে সাড়া দিয়ে মহান আল্লাহর নির্দেশে মেরাজে চললেন। মেরাজ শেষ করে ভোর হওয়ার পূর্বেই আবার চলে আসেন। ইহাই রাত্রের সামান্য সময় যা 'লাইলাম' দ্বারা বুঝানো হয়েছে।
অথচ মেরাজ ছিল দীর্ঘ সাতাশ বছর। যা আমাদের হিসেবে সামান্য। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে বিছানায় শায়িত ছিলেন মেরাজ থেকে ফিরে এসে দেখলেন সে বিছানা এখনও গরম। দরজার কড়া নড়ছে। মেরাজ থেকে ফিরে এসে দেখেন (২৭ বছর পার হলো) অযুর পানীয় এখনও গড়াচ্ছে। সুবাহানাল্লাহ। ইহাই 'লাইলাম'। দুনিয়ার হিসেবকে ব্রেক করে দিয়ে আদেশ জারি করে দিলেন চন্দ্র-সূর্যসহ সকল সৃষ্টি যে যেখানে আছে সে সেখানেই থাকো, আমি আমার হাবীবকে মেরাজে নিয়ে আসবো। ঠিক ২৭ বছর পর আবার ঘোষণা জারি করে দিলেন যে, হে সৃষ্টি জগৎ তোমরা পূর্বের ন্যায় চলমান হয়ে যাও। এ ব্রেকেই ২৭ বছর অতিবাহিত হয়েছে। আর ইহা আল্লাহর জন্যই সম্ভব।
কেননা মহান আল্লাহ তায়ালা সকল ক্ষমতার মালিক। আর ইহাই দুনিয়ার হিসেবে 'লাইলাম', এ ‘লাইলাম’ একেবারই সামান্য সময়। যা আল্লাহ তায়ালারই খুদরত। আর এ জন্যই আয়াতের প্রথমেই ‘সুবহানা’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। আয়াতে কারীমায় 'মিনাল মাসজিদিল হারামে ইলাল মাসজিদিল আকসা' উল্লেখ করা হয়েছে। মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত তাঁর এ ভ্রমণ। তাহলে এর দ্বারা বুঝা যায় যে, মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকছা পর্যন্ত ভ্রমণ পবিত্র কুরআন দ্বারা সাবেত (প্রমাণিত)।
যেখানে এক মাসের পথ সেখানে যদি রাতের কিছু সময়ে যাওয়া সাব্যস্ত হয় তাহলে ঊর্ধ্বাকাশে যাওয়াও আল্লাহর ইচ্ছাধীন এবং আল্লাহর ক্ষমতায় অবশ্যই সম্ভব। কেউ কেউ বলেছেন যে, মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত হচ্ছে 'আসরা'। আর মসজিদে আকসা থেকে সপ্তাকাশে, সেখান থেকে আরশে আজীম সেই ঊর্ধ্ব জগতের ভ্রমণই হলো মেরাজ।
আয়াতে 'বারাকনা হাওলাহু' দ্বারা যার চার দিকে বরকতের কথা বলা হয়েছে যে, এ মেরাজে যাওয়ার পথের চতুর্দিকে বরকতময়। এ 'হাওলাহু' দ্বারা সমগ্র সিরিয়াকে বুঝানো হয়েছে। এক হাদিসে রয়েছে, আল্লাহ তায়ালা আরশ থেকে ফোরাত নদী পর্যন্ত বরকতময় ভূ-পৃষ্ঠকে বিশেষ পবিত্রতা দান করেছেন। (রূহল মাআনী)।
'লিনুরিয়াহু মিন আয়াতিনা' অর্থাৎ যাতে আমি তাঁকে কুদরতের কিছু নিদর্শন দেখিয়ে দেই। মেরাজের রজনীতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মহান আল্লাহ তায়ালার কুদরতের অসংখ্য বিষয় অবলোকন করেন। তন্মধ্যে সপ্তাকাশ, নবীদের সাথে সাক্ষাত, বায়তুল মুকাদ্দাসের সনরা পাথর, বোরাক, রফরফ, সিদরাতুল মুনতাহা, জান্নাত-জাহান্নাম ও আলমে বরযখের কতিপয় দৃশ্যাবলীসহ মহান আল্লাহ তায়ালার অসংখ্য নিদর্শনাবলী। নিম্নে আলমে বরযখের কতিপয় বিষয় তুলে ধরা হলো।
বোরাকে আরোহন করার পর তিনি একটি সবুজ মাঠ দেখতে পেলেন। সেখানে নারী-পুরুষ সজ্জিত হয়ে ক্ষেত-খামারের কাজে ব্যস্ত। তারা একদিকে জমিন প্রস্তুত করছে, অপরদিকে বীজ বুনন করছে। আর সাথে সাথে তা শস্য-শ্যামলা হয়ে ক্ষেতে ভরে যাচ্ছে। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত জিব্রাঈল (আঃ)কে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলেন ইহা ওই সম্প্রদায়ের উদাহরণ; যারা আল্লাহর রাহে প্রশস্ত মনে দুনিয়াতে দান সদকা করে।
এমন একদল বদ নসীবদের দেখা পেলেন যেখানে অসংখ্য নারী-পুরুষ বিরাট একটা পাথর যুক্ত মাঠে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। আর তাদের মাথার উপর বড় বড় পাথর দ্বারা আঘাত করা হচ্ছে। পাথরের আঘাতে তাদের মাথা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে, আবার উহা পূর্ববৎ ভালো হয়ে যাচ্ছে আর মারছে। এরা হচ্ছে ওই সম্প্রদায় যারা নামাজ না পড়ে বিছানায় আরামের সাথে শুয়ে থাকতো এবং অলসতা করে বিছানা ছেড়ে নামাজের জন্য যেতো না। বরং অহঙ্কার করে দিন কাটাতো।
মেরাজের বিশাল আলোচনার যৎ কিঞ্চিত এখানে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মেরাজ সংঘটিত হয়েছিল নবুয়তের ১২ সালে যা মক্কা শরীফে উম্মে হানীর ঘর বা কাবার হাতিম থেকে। এ সফরে তাঁর ছিনা চাক (বক্ষ বিদীর্ণ) করা হয়েছে।
তাফসীরে কুরতুবীতে আছে, ইসরার হাদিসসমূহ সব মুতাওয়াতির। নাক্কাশ সম্পর্কে ২০ জন সাহাবীর রেওয়ায়েত উদ্বৃত করেছেন এবং কাযী আয়ায শেফা গ্রন্থে আরও বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন
ইমাম ইবনে কাসীর স্বীয় তাফসীর গ্রন্থে এসব রেওয়ায়েত পূর্ণরূপে যাচাই-বাছাই করে বর্ণনা করেছেন। পবিত্র কুরআন ও হাদিসের দ্বারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মেরাজের সত্যতা এবং স্ব-শরীরে মেরাজ প্রমাণিত।
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ নবী- সরওয়ারে কায়েনাত, ইমামুল মুরসালীন, রহমাতুল্লিল আলামীন হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর অগণিত মোযেজার মধ্যে শ্রেষ্ঠতম একটি মুযেজা হচ্ছে মিরাজ। তাঁর ৫২ বছর বয়সে, নবুয়াতের ১২ তম বর্ষে, রজব মাসের ২৬ তারিখ দিবাগত রাতের কিছু অংশে এই ভ্রমণ তিনি সম্পন্ন করেন।
প্রিয় নবী স. এর এই রাতের ভ্রমণের রয়েছে দুটি স্তর । একটি হচ্ছে ইসরা, যা হাতীমে কাবা থেকে বাইতুল মাকদাস পর্যন্ত। আর দ্বিতীয় অংশ হচ্ছে সেখান থেকে ঊর্ধ্বাকাশে মিরাজ।
সরাসরি আকাশে না উঠিয়ে আল্লাহ তাকে কেন বাইতুল মাকদাসে ইসরা করালেন? এর কারণ আমরা বুঝতে পারি তখন, যখন দেখি মক্কার কাফির নেতৃবৃন্দ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে কাবার সামনে জনসমক্ষে বাইতুল মাকদাস সম্পর্কে বিভিন্ন প্রশ্ন করেছিল। এবং নবী স. যে এক মাসের দূরত্বের সেই বাইতুল মাকদাসে ঠিকই ভ্রমণ করেছেন, তা কাফিররা যাচাই করতে পারল।
এ অংশের ভ্রমণ ছিল কাফিরদের জ্ঞানসীমার মধ্যে। সরাসরি আসমানে ভ্রমণ করলে আসলে কাফিরদের জ্ঞানে তা যাচাই করতে পারতো না। তাই আল্লাহ পাক সুরা বনী ইসরাইলের প্রথম আয়াতে ইসরা এর উল্লেখ করেছেন।
দ্বিতীয় অংশের ভ্রমণে প্রিয় নবী স. বাইতুল মাকদাস হতে হযরত জিবরাইল আ. এর সাথে পুনরায় বোরাকে চড়ে সেখান থেকে সাত আসমান তথা সিদরাতুল মুন্তাহা পাড়ি দিয়ে মহান আল্লাহর ডাকে হাজির হন। এবং খাছ সান্নিধ্য লাভ করে বেহেশত, দোযখ, আরশ, কুরশি, লওহ, কলম প্রভৃতি পরিদর্শন করে সৃষ্টি জগতের সকল রহস্য অবহিত হয়ে আবার রাতের মধ্যেই পৃথিবীতে ফিরে আসেন। যার বিস্তারিত বিবরণ স্পষ্টভাবে তিনি নিজে দিয়েছেন এবং আল কুরআনের প্রায় একশ’ আয়াতে পরোক্ষভাবে বিবরণ দেয়া হয়েছে। শত শত হাদীসে মিরাজের বিভিন্ন ঘটনার বিবরণ দেয়া হয়েছে।
মিরাজ কি?
মিরাজ কেন হয়েছে?
কি উপলক্ষ্যে হয়েছে?
স্বপ্নযোগে হয়েছে নাকি সশরীরে?
এ সফরের ফলাফল বা সার্থকতা কী?
মিরাজ থেকে পৃথিবীবাসীর শিক্ষণীয় কী?
মহাশূন্য পাড়ি দেয়া কিভাবে মানুষের পক্ষে সম্ভব হল? ইত্যাদি এই সম্পর্কে অগণিত প্রশ্ন হতে বিজ্ঞান শুধু একটি প্রশ্ন নিয়েই ব্যাখ্যা বা আলোচনা করতে প্রয়াসী। আর তা হল মহাশূন্য- মহাকাশ পাড়ি দেয়া, আবার পৃথিবীতে ফিরে মানুষের জন্য আসা সম্ভব কিনা?
যদি বলি পুরা ব্যাপারটাই সংঘটিত হয়েছে মহান আল্লাহ পাকের অসীম কুদরত। তাহলে ব্যাখ্যাটি হয়ে দাঁড়ায় ঈমানভিত্তিক, বিজ্ঞান ভিত্তিক নয়। আর মুমিন মাত্রই মহান আল্লাহর কুদরত বিশ্বাস করেন। মহান আল্লাহ তো যা খুশি তা-ই করতে পারেন, ঘটাতে পারেন। তিনি ‘কুন ফাইয়াকুন’ এর মালিক। তার কাছে অসাধ্য কিছুই নেই। কিন্তু যিনি মুমেন নয়, তিনি তো বিজ্ঞান ভিত্তিক কিছু যৌক্তিকতা তালাশ করবেন।
মহাকাশ নিয়ে একের পর এক অনেক প্রশ্ন করবেন। আর জগৎখ্যাত বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন এর আপেক্ষিক তত্ত্ব প্রকাশিত হবার পর অনেক প্রশ্নের উত্তরই তারা পেয়ে গেছেন। বিজ্ঞান আজ প্রমাণ করছে যে, সেকেন্ডে ৬.৯০ কিলোমিটার বেগে কোন জিনিস মহাকাশে নিক্ষেপ করলে সে মাধ্যাকর্ষণ শক্তিকে অতিক্রম করে যেতে পারে।
মহাকাশের বিভিন্ন উল্কা ও তার আক্রমণ থেকে রেহাই পাবার জন্য যে বিশেষ ধরণের পোষাক বা বাহন দরকার, নবী স. কে বেহেশত থেকে সে ধরণের পোষাকই হয়তো সরবরাহ করা হয়েছিল। ভিন্ন জগতে ভ্রমণের জন্য যে পরিমাণ সাহস সঞ্চয় করা দরকার না হয় সে বেহুঁশ হয়ে পড়বে; সে জন্যই প্রিয় নবী স. এর বক্ষ বিদারণ করে রহমাত ও হিকমাত বোঝাই করে দেয়া হয়েছিল। মহাকাশ ভ্রমণে স্থির থাকার মত সাহস তার হৃৎপিণ্ডে বোঝাই করার পরেই তাকে বোরাক নামের বিজলী গতি সম্পন্ন বাহনে আরোহণ করানো হয়েছিল।
বক্ষ ফেঁড়ে হৃৎপিণ্ড বাইরে এনে প্রয়োজনীয় কাজ সেরে আবার যথাস্থানে প্রতিস্থাপন করা বিজ্ঞানের এ আধুনিক যুগে প্রমাণিত ও সহজ ব্যাপার। সুতরাং মিরাজ সশরীরেই ঘটেছিল। যদি স্বপ্নযোগে হত, তাহলে বোরাক নামক বাহন আল্লাহ পাঠাতেন না। কারণ ঘুমন্ত দেহকে রেখে রূহ নিয়ে ভ্রমণ হল স্বপ্ন। রূহ নেয়ার জন্য বোরাক বা রফরফ কোন বাহন এর দরকার ছিল না। সুতরাং নিঃসন্দেহে মিরাজে তিনি সশরীরেই গিয়েছেন। তবে এ কথা সত্য যে, সশরীরে মিরাজ হয়েছে একবার আর স্বাপ্নিকভাবে মিরাজ হয়েছে ৩৩ বার।
সকল নবীর উপর মুহাম্মদ স. এর শ্রেষ্ঠত্ব প্রদান করার যে কয়টি পয়েন্ট আছে, তার মধ্যে মিরাজ অন্যতম। হযরত আদম আ. বেহেশত হতে সকল আসমান পাড়ি দিয়ে সশরীরে পৃথিবীতে অবতরণ করেছেন। কিন্তুঁ সশরীরে আকাশে আর উঠেননি। অপরদিকে হযরত ইদ্রিস আ. সশরীরে বেহেশতে উঠেছেন আকাশ থেকে আর নামেননি। আর একজন নবী হযরত ঈসা আ. আকাশে সশরীরে দ্বিতীয় আসমানে উঠেছেন আবার নামবেন। ঈসা আ. এর ওঠা নামাটা আংশিক। কিন্তু শ্রেষ্ঠ নবী মুহাম্মাদ স. একই সাথে সশরীরে আরশ পর্যন্ত উঠেছেন আবার নেমেছেন। তার মোযেজা সকল কালের, সকল মানুষের এবং সকল শক্তির উপর শ্রেষ্ঠত্বের দাবি রাখে।
এর পরেও যদি প্রশ্ন ওঠে যে, নবী স. আল্লাহ পাকের সাক্ষাতে যাওয়া সম্ভব হল কি করে? কুরআনই তো আমাদেরকে জানিয়ে দিচ্ছে মূসা আ. কে আল্লাহ পাক বলেছেন,
﴿وَلَمَّا جَآءَ مُوۡسٰى لِمِيۡقَاتِنَا وَكَلَّمَهٗ رَبُّهٗۙ قَالَ رَبِّ اَرِنِىۡۤ اَنۡظُرۡ اِلَيۡكَؕ قَالَ لَنۡ تَرٰٮنِىۡ وَلٰكِنِ انْظُرۡ اِلَى الۡجَبَلِ فَاِنِ اسۡتَقَرَّ مَكَانَهٗ فَسَوۡفَ تَرٰٮنِىۡۚ فَلَمَّا تَجَلّٰى رَبُّهٗ لِلۡجَبَلِ جَعَلَهٗ دَكًّا وَّخَرَّ مُوۡسٰى صَعِقًاۚ فَلَمَّاۤ اَفَاقَ قَالَ سُبۡحٰنَكَ تُبۡتُ اِلَيۡكَ وَاَنَا۟ اَوَّلُ الۡمُؤۡمِنِيۡنَ﴾,
১৪৩.) অতঃপর মূসা যখন আমার নির্ধারিত সময়ে উপস্থিত হলো এবং তার রব তার সাথে কথা বললেন তখন সে আকূল আবেদন জানালো, “হে প্রভু! আমাকে দর্শনের শক্তি দাও, “আমি তোমাকে দেখবো।” তিনি বললেনঃ “তুমি আমাকে দেখতে পারো না। হ্যাঁ,, সামনের পাহাড়ের দিকে তাকাও। সেটি যদি নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে পারে তাহলে অবশ্যি তুমি আমাকে দেখতে পাবে।” কাজেই তার রব যখন পাহাড়ে জ্যোতি প্রকাশ করলেন তখন তা তাকে চূর্ণ বিচূর্ণ করে দিল এবং মূসা সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ে গেলো। সংজ্ঞা ফিরে পেয়ে মূসা বললোঃ “পাক-পবিত্র তোমার সত্তা। আমি তোমার কাছে তাওবা করছি এবং আমিই সর্বপ্রথম মুমিন।”
‘লান তারানি’ তুমি আমাকে দেখতে পারবে না। তবে এ আয়াতটির প্রতি একটু নজর করলেই আমরা দেখতে পাই যে, আল্লাহ শুধু মূসা আ. কে লক্ষ্য করে বলেছিলেন যে, তুমি আমাকে দেখতে পারবে না। আমাকে কেউ দেখতে পারবে না, এমন কথা কিন্তু আল্লাহ তায়ালা বলেননি। বরং আমাদের সবাই আল্লাহকে দেখতে পারবো বলে হাদীসে প্রিয় নবী স. সু সংবাদ দিয়ে বলেছেন-
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم " تُضَامُّونَ فِي رُؤْيَةِ الْقَمَرِ لَيْلَةَ الْبَدْرِ وَتُضَامُّونَ فِي رُؤْيَةِ الشَّمْسِ " . قَالُوا لاَ . قَالَ " فَإِنَّكُمْ سَتَرَوْنَ رَبَّكُمْ كَمَا تَرَوْنَ الْقَمَرَ لَيْلَةَ الْبَدْرِ لاَ تُضَامُّونَ فِي رُؤْيَتِهِ "
হযরত আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর সাহাবীদেরকে প্রশ্ন করেনঃ পূর্ণিমার রাতে চাঁদ দেখতে তোমরা কি কোন প্রকার ভিড় অনুভব করো? সূর্য দেখার মধ্যে কি তোমরা কোন রকম ভিড় অনুভব করো? তারা বললেন, না। তিনি বললেনঃ তোমরা যেমনিভাবে পূর্ণিমার চাঁদ দেখতে পাও, ঠিক তেমনিভাবে তোমাদের প্রভুকেও দেখতে পাবে। আর এতে কোন ভীড় অনুভব করবে না। জামে' আত-তিরমিজি, হাদিস নং ২৫৫৪।
মিরাজের এই চতুর্মুখী তত্ত্ব, তথ্য ও ঘটনার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে কি? বৈজ্ঞানিকগণ আজ এমন নক্ষত্রের সন্ধান পান, যার আলো পৃথিবীতে আসতে সময় লাগবে ১০০ কোটি বছর। আর এসব তো প্রথম আসমানের ব্যাপার মাত্র। তাহলে সাত আসমানের উপর সিদরাতুল মুন্তাহা, আরশ, কুরশি, লৌহ, কলম এর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আসবে কিভাবে?
এ প্রশ্নের উত্তর এর আগে আমাদের বুঝতে হবে মুযেজা কী ও বিজ্ঞান কী? মুযেজা শব্দের অর্থ হচ্ছে সকল শক্তি, সামর্থ্যকে অক্ষমকারী তথা পরাজিতকারী। যদি বিজ্ঞান পুরো মিরাজের ব্যাখ্যা দিতে সক্ষম হয়, তাহলে সে আর পরাজয় বরণকারী হল কিভাবে?
আল্লাহ মানুষকে যে সামান্য জ্ঞান বুদ্ধি দিয়েছেন, সেই বিবেক বুদ্ধির ফসল হচ্ছে বিজ্ঞান। ফসল যেমন নিত্য নতুন করে ফলে। বিজ্ঞানের তেমন নিত্য নতুন তত্ত্ব-তথ্য আপডেট হতে থাকে।
তাফসীরে কুরতুবীতে মুযেজার পাঁচটি বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ আছে। যার একটি হচ্ছে- তা আল্লাহর কুদরতের প্রকাশ। আর আল্লাহর কুদরতের কি কোন বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা হতে পারে? উদাহরণস্বরূপ পাথর ফেটে গিয়ে হযরত সালেহ আ. এর জন্য উট বেরিয়ে আসছিল। অথচ পাথর ভাঙলে উট পাওয়া যাবে এর কোন বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা হতে পারে?
নমরুদের আগুনের কূপে তিনদিন পর্যন্ত হযরত ইবরাহীম আ. অক্ষত অবস্থায় থেকে বেরিয়ে আসলেন। কোন বৈজ্ঞানিক কি এটা পরীক্ষা করতেও যাবে যে, অন্তত একদিন আগুনের কূপে নেমে দেখি?
হযরত ইসা আ. এর হাতের ছোঁয়ায় জন্মান্ধ ভাল হয়ে যেত। অন্ধের চোখে কারো হাতের ছোঁয়া লাগলে সে দৃষ্টি ফিরে পাবে এর কোন বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে কি?
কোন খ্রিস্টান বৈজ্ঞানিক বাইবেলে উল্লেখিত ঈসা আ. এর এই মোযেজাকে অস্বীকার করবে?
না এর কোন বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিতে পারবে?
মোটকথা কস্মিনকালেও মোযেজার ব্যাখ্যা বিজ্ঞান দিয়ে হবে না। তবে এ কথা ধ্রুব সত্য যে বিজ্ঞান যতই উন্নত হচ্ছে এবং হবে কুরআনের সাথে ততই সমন্বয় হয়ে যাচ্ছে এবং হবে। বিজ্ঞান যতই তার সিদ্ধান্ত পাল্টিয়ে নতুন সত্য আবিষ্কার করছে, ততই কুরআনের সাথে তার বিরোধ নিষ্পত্তি হয়ে যাচ্ছে। অদূর ভবিষ্যতে তাই আমরা বিজ্ঞানের আরো উৎকর্ষ আশা করছি যে দিন কুরআন আর বিজ্ঞান প্রায় একাকার হয়ে যাবে। যেমনটা ইতোপূর্বে হাজারো বিষয়ে হয়ে গেছে।
আল্লাহ তায়ালা আমাদের সকলের জন্যে মিরাজের যথার্থতা উপলব্ধি করে মিরাজের উপহার আল্লাহ প্রদত্ত পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করার তাওফিক দান করুন। আমীন।
অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, মাশা'আল্লাহ
ReplyDeleteঅনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, মাশা'আল্লাহ
ReplyDeleteমাশা'আল্লা। সুন্দরব্যা।
ReplyDelete