সা‘দ ইবনু মু‘আয (রাঃ) এর সংক্ষিপ্ত জীবনী ও তার মৃত্যু নিয়ে নাস্তিক্যবাদীদের একটি অবান্তর প্রশ্নের যৌক্তিক জবাব।
প্রাথমিক কথাঃ-
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার এক প্রিয় সাহাবি মুসআব রাদিয়াল্লাহু আনহুর মৃত দেহের কাছে দাঁড়িয়ে এই আয়াত তেলাওয়াত করলেন-
‘ঈমানদারদের মধ্যে কেউ কেউ আছে, যারা আল্লাহর কাছে তাদের কৃত অঙ্গীকার পরিপূর্ণরূপে পালন করেছে।’ (সুরা আহযাব : আয়াত ২৩)।
এ ওয়াদা পালনকারীদের মধ্যে অন্যতম আরেক জন ছিলেন আনাসার সাহাবি হজরত সাদ ইবনে মুয়াজ রাদিয়াল্লাহু আনহু।
সা‘দ ইবনু মু‘আয (রাঃ) ছিলেন অন্যতম বদরী ছাহাবী। বনু কুরায়যার ব্যাপারে ফায়ছালা দানকারী এই আনছার ছাহাবীর জানাযায় ৭০ হাযার ফেরেশতা অংশগ্রহণ করেন এবং তাঁর মৃত্যুতে আল্লাহর আরশ কেঁপে ওঠে ও আসমানের দরজা খুলে দেওয়া হয়। এই জলীলুল কদর ছাহাবীর জীবন চরিত এ নিবন্ধে আলোচিত হবে ইনশাআল্লাহ।
নাম ও বংশ পরিচয়ঃ-
তাঁর নাম সা‘দ, কুনিয়াত আবু আমর, উপাধি সাইয়্যেদুল আওস। তাঁর পিতার নাম মু‘আয এবং মাতার নাম কাবশা বিনতু রাফে‘।[1] তাঁর পূর্ণ বংশ পরিচয় হচ্ছে, সা‘দ ইবনু মু‘আয ইবনে নু‘মান ইবনে ইমরাউল কায়েস ইবনে যায়েদ ইবনে আব্দুল আশহাল ইবনে জুশম ইবনে হারেছ ইবনে খাযরাজ ইবনে নাবীত ইবনে মালেক ইবনে আওস আল-আশহালী আল-খাযরাজী আল-আনছারী।[2]।
জন্ম ও শৈশবঃ-
তাঁর জন্মকাল সম্পর্কে কিছু জানা যায় না। তবে তিনি ৫ম হিজরীতে ৩৭ বছর বয়সে ইন্তিকাল করেন।[3] সে হিসাবে তিনি ৫৯০ খৃষ্টাব্দে নবুওয়াতের ২০ বছর পূর্বে মদীনার খাযরাজ গোত্রের বনু আব্দুল আশহাল শাখায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর শৈশব সম্পর্কে ঐতিহাসিক ও চরিতকারগণ কিছু বলেননি। তাই এ সম্পর্কেও কিছু জানা যায় না।
ইসলাম গ্রহণঃ-
সা‘দ (রাঃ) মুছ‘আব ইবনু উমায়ের (রাঃ)-এর হাতে ইসলাম কবুল করেন। ইসলাম গ্রহণের পরে তিনি স্বীয় কওমের সম্মুখে দাঁড়িয়ে বললেন,
হে বনু আব্দুল আশহাল! তোমাদের সাথে আমার ব্যবহার কেমন পেয়েছ? তারা বলল, হে আমাদের নেতা! উত্তম পেয়েছি এবং আমাদের সঠিক দিক নির্দেশক হিসাবে পেয়েছি। তিনি বললেন, আমার ব্যপারে তোমাদের একথা বলা হারাম হবে, যতক্ষণ না তোমাদের পুরুষ-মহিলারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনবে। ফলে বনু আব্দুল আশহালের প্রতিটি পুরুষ-মহিলা ইসলাম কবুল করল।[4]
দেহসৌষ্ঠব ও চেহারাঃ-
সা‘দ (রাঃ) ছিলেন দীর্ঘকায়, ফর্সা, সুন্দর, সৌম্য-কান্তি চেহারা, ডাগর চোখ বিশিষ্ট ও সুন্দর শ্মশ্রুশোভিত মানুষ।[5] তিনি দীর্ঘদেহী, স্বাস্থ্যবান সুপুরুষ ছিলেন।[6]
ওমরা পালন ও আবু জাহলের সাথে বিতর্কঃ-
সা‘দ ইবনু মু‘আয (রাঃ) ওমরা করতে মক্কায় যান এবং বায়তুল্লাহর তওয়াফ করার সময় আবু জাহল তাঁর সাথে বিতর্কে লিপ্ত হয়। আব্দুল্লাহ ইবনু মাস‘ঊদ (রাঃ) বলেন, সা‘দ ইবনু মু‘আয (রাঃ) ওমরা আদায় করার জন্য গেলেন এবং ছাফওয়ানের পিতা উমাইয়াহ ইবনু খালাফের বাড়িতে অতিথি হ’লেন। উমাইয়াহও সিরিয়ায় গমনকালে (মাদীনায়) সা‘দ (রাঃ)-এর বাড়িতে অবস্থান করত। উমাইয়াহ সা‘দ (রাঃ)-কে বলল, অপেক্ষা করুন, যখন দুপুর হবে এবং যখন চলাফেরা কমে যাবে, তখন আপনি গিয়ে তাওয়াফ করবেন। সা‘দ (রাঃ) তাওয়াফ করছিলেন। এমতাবস্থায় আবু জাহল এসে হাযির হ’ল। সা‘দ (রাঃ)-কে দেখে জিজ্ঞেস করল, এ ব্যক্তি কে যে কা‘বার তাওয়াফ করছে? সা‘দ (রাঃ) বললেন, আমি সা‘দ। আবু জাহল বলল, তুমি নির্বিঘ্নে কা‘বার তাওয়াফ করছ?
অথচ তোমরাই মুহাম্মাদ ও তাঁর সাথীদেরকে আশ্রয় দিয়েছ? সা‘দ (রাঃ) বললেন, হ্যাঁ। এভাবে দু’জনের মধ্যে কথা কাটাকাটি হ’ল। তখন উমাইয়াহ সা‘দ (রাঃ)-কে বলল, আবুল হাকামের সঙ্গে উচ্চৈঃস্বরে কথা বল না, কারণ সে মক্কাবাসীদের নেতা। অতঃপর সা‘দ (রাঃ) বললেন,
আল্লাহর কসম! তুমি যদি আমাকে বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করতে বাধা প্রদান কর, তবে আমিও তোমার সিরিয়ার সঙ্গে ব্যবসা বাণিজ্যের রাস্তা বন্ধ করে দিব। উমাইয়া সা‘দ (রাঃ)-কে তখন বলতে লাগল, তোমার স্বর উঁচু কর না এবং সে তাঁকে বিরত করতে চেষ্টা করতে লাগল। তখন সা‘দ (রাঃ) ক্রোধান্বিত হয়ে বললেন, আমাকে ছেড়ে দাও। আমি মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, তারা তোমাকে হত্যা করবে। উমাইয়া বলল, আমাকেই? তিনি বললেন, হ্যাঁ।
উমাইয়া বলল, আল্লাহর কসম মুহাম্মাদ (ছাঃ) কখনও মিথ্যা কথা বলেন না। অতঃপর উমাইয়া তার স্ত্রীর নিকট ফিরে এসে বলল, তুমি কি জান, আমার ইয়াছরিবী ভাই আমাকে কি বলেছে? স্ত্রী জিজ্ঞেস করল, কি বলেছে? উমাইয়া বলল, সে মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছে যে, তারা আমাকে হত্যা করবে। তার স্ত্রী বলল, আল্লাহর কসম! মুহাম্মাদ (ছাঃ) মিথ্যা বলেন না। যখন মক্কার মুশরিকরা বদরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হ’ল এবং আহবানকারী আহবান জানাল। তখন উমাইয়ার স্ত্রী তাকে স্মরণ করে দিল, তোমার ইয়াছরিবী ভাই তোমাকে যে কথা বলছিল, সে কথা তোমার মনে নেই? তখন উমাইয়া না যাওয়ারই সিদ্ধান্ত নিল। আবু জাহল তাকে বলল, তুমি এ অঞ্চলের একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা। আমাদের সঙ্গে দুই একদিনের পথ চল। উমাইয়াহ তাদের সঙ্গে চলল। আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছায় সে নিহত হ’ল।[7]
ভ্রাতৃস্থাপনঃ-
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আনছার ছাহাবী সা‘দ ইবনু মু‘আয ও মুহাজির ছাহাবী আবু উবায়দাহ ইবনুল জাররাহ মতান্তরে সা‘দ ইবনু মু‘আয ও সা‘দ ইবনু আবী ওয়াক্কাছের মাঝে ভ্রাতৃসম্পর্ক স্থাপন করে দেন।[8]
যুদ্ধে অংশগ্রহণঃ-
তিনি ইসলামের প্রথম যুদ্ধ বদর, ওহোদ ও খন্দক বা আহযাব যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।[9] খন্দক যুদ্ধে সা‘দ (রাঃ) আহত হয়েছিলেন। কুরাইশ গোত্রের হিববান ইবনু আরিকা নামক এক ব্যক্তি তাঁর উভয় বাহুর মধ্যবর্তী রগে তীর বিদ্ধ করেছিল। ফলে নিকট থেকে সেবা করার জন্য রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মসজিদে নববীতে (সা‘দের জন্য) একটি তাঁবু তৈরী করেছিলেন।[10] হাকিম নাইসাপুরী (রহঃ) বলেন, কুরাইশের বনু আমের ইবনে লুআই গোত্রের হিববান ইবনু কায়স ইবনে আরিকা নামক জনৈক লোকের নিক্ষিপ্ত তীরে সা‘দ (রাঃ) আহত হন। এরপর বনু কুরায়যার ফায়ছালা প্রদান পর্যন্ত প্রায় ১ মাস জীবিত ছিলেন।[11]।
বিচার-ফায়ছালাঃ-
আহযাব যুদ্ধের সময় বনু কুরায়যার বিশ্বাসঘাতকতার কারণে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে নির্দেশ দেওয়া হয় বনু কুরায়যার দিকে অভিযান পরিচালনার জন্য। মা আয়েশা (রাঃ) বলেন, নবী করীম (ছাঃ) খন্দক যুদ্ধ থেকে ফিরে এসে অস্ত্র রেখে গোসল করছিলেন। এমন সময় তাঁর কাছে জিবরীল (আঃ) এসে বললেন, আপনি অস্ত্র রেখে দিয়েছেন? আল্লাহর কসম আমরা তা খুলিনি। তাদের বিরুদ্ধে অভিযানে চলুন। নবী করীম (ছাঃ) জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় যেতে হবে? তিনি বনু কুরায়যার প্রতি ইশারা করে বললেন, ঐ দিকে। তখন নবী করীম (ছাঃ) তাদের বিরুদ্ধে অভিযানে বেরিয়ে পড়লেন।[12] আর ছাহাবীদের নির্দেশ দিয়ে বললেন, ‘বনু কুরায়যায় না পৌঁছে কেউ আছর ছালাত আদায় করবে না’।[13]
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বনু কুরায়যাকে ২৫ দিন যাবৎ অবরুদ্ধ করে রাখেন। যখন তাদের রসদ ফুরিয়ে গেল এবং জীবন ধারণ করা দুঃসাধ্য হয়ে পড়ল তখন তারা আওসের বনু আশহাল গোত্রের নেতা ও তাদের মিত্র সা‘দ বিন মু‘আযের ফায়ছালা মেনে নিতে সম্মত হ’ল। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সা‘দকে আনার জন্য লোক পাঠালেন।[14]
বুখারী-মুসলিমে এভাবে বর্ণিত হয়েছে, যখন বনু কুরায়যার ইহুদীরা সা‘দ ইবনু মু‘আয (রাঃ)-এর ফয়ছালা মুতাবিক দুর্গ থেকে বেরিয়ে আসে, তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সা‘দ (রাঃ)-কে ডেকে পাঠন। তিনি ঘটনাস্থলের কাছেই ছিলেন। তখন সা‘দ (রাঃ) একটি গাধার পিঠে আরোহণ করে আসলেন। তিনি রাসূলের নিকটবর্তী হ’লে রাসূল (ছাঃ) বললেন, ‘তোমরা তোমাদের নেতার দিকে দন্ডায়মানহও’।[15] তিনি এসে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে বসলেন। তখন তাঁকে বললেন, এগিয়ে যাও এরা তোমার ফায়ছালায় রাযী হয়েছে। সা‘দ (রাঃ) বললেন, আমি এই রায় ঘোষণা করছি যে, তাদের যোদ্ধাদের হত্যা করা হবে, নারী ও সন্তানদের বন্দী করা হবে।[16] আর তাদের ধন-সম্পদ বণ্টন করা হবে।[17] সা‘দ (রাঃ)-এর ফায়ছালা মেনে নিয়ে বনু কুরায়যার লোকেরা দুর্গ থেকে নেমে আসে। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন,
حَكَمْتَ بِحُكْمِ اللهِ، أَوْ بِحُكْمِ الْمَلِكِ
‘তুমি আল্লাহর নির্দেশ অনুসারে ফায়ছালা দিয়েছ। অথবা তিনি বললেন, ‘তুমি রাজাধিরাজের নির্দেশ মুতাবেক ফায়ছালা দিয়েছ’।[18]
সা‘দ (রাঃ)-এর দো‘আঃ-
সা‘দ (রাঃ) আল্লাহর কাছে দো‘আ করেছিলেন, হে আল্লাহ! আপনি তো জানেন, আপনার সন্তুষ্টির জন্য তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করার চেয়ে কোন কিছুই আমার কাছে অধিক প্রিয় নয়। যে সম্প্রদায় আপনার রাসূল (ছাঃ)-কে মিথ্যাচারী বলেছে এবং দেশ থেকে বের করে দিয়েছে হে আল্লাহ! আমি মনে করি (খন্দক যুদ্ধের পর) আপনি তো আমাদের ও তাদের মধ্যে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটিয়েছেন। যদি এখনো কুরায়শদের বিরুদ্ধে কোন যুদ্ধ বাকী থেকে থাকে তাহ’লে আমাকে বাঁচিয়ে রাখুন, যাতে আমি আপনার রাস্তায় তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করতে পারি। আর যদি যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটিয়ে থাকেন তাহ’লে ক্ষত হ’তে রক্ত প্রবাহিত করুন এবং তাতেই আমার মৃত্যু দিন। এরপর তাঁর ক্ষত থেকে রক্তক্ষরণ হয়ে তা প্রবাহিত হ’তে লাগল। মসজিদে বনু গিফার গোত্রের একটি তাঁবু ছিল। তাদের দিকে রক্ত প্রবাহিত হ’তে দেখে তারা বললেন, হে তাঁবুবাসীগণ! আপনাদের দিক থেকে এসব কি আমাদের দিকে আসছে? পরে তাঁরা জানলেন যে, সা‘দ (রাঃ)-এর ক্ষতস্থান থেকে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। এ জখমের কারণেই তিনি মারা যান, আল্লাহ তাঁর উপর সন্তুষ্ট থাকুন।[19]
মৃত্যু ও দাফনঃ-
তিনি ৫ম হিজরীতে আহযাব যুদ্ধ থেকে প্রত্যাবর্তনের ২৫ দিন পরে এবং বনু কুরায়যার ব্যাপারে ফায়ছালা প্রদান শেষে যুলকা‘দাহ মাসের শেষের দিকে কিংবা যুলহিজ্জা মাসের প্রথম দিকে ৩৭ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।[20] তাঁর জানাযা ছালাত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) পড়ান এবং তাকে বাকীউল গারক্বাদে দাফন করা হয়।[21]
আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) সা‘দ (রাঃ)-এর কবর খনন করেন। তিনি বলেন, যখন আমরা কবর খনন করছিলাম, তখন মিসক আম্বারের সুগন্ধি আসছিল।[22] আমরা তাঁর জন্য লাহদ কবর খনন করলাম।[23] যে চার জন ব্যক্তি সা‘দ (রাঃ)-এর কবরে নামেন, তারা হ’লেন
হারেছ ইবনু আওস,
উসাইদ ইবনুল হুযাইর,
আবু নায়েলাহ সিলকান,
সালমা ইবনু সালামাহ ইবনে ওকাশ।
এ সময় রাসূল (ছাঃ) পার্শ্বে দাঁড়িয়ে ছিলেন।[24]
সন্তান-সন্ততিঃ-
সা‘দ (রাঃ)-এর দু’টি ছেলে ছিল, তারা হচ্ছেন আব্দুল্লাহ ও আমর। আর আমরের ৯টি সন্তান হয়েছিল।[25]
বৈশিষ্ট্য বা বিশেষত্বঃ-
সা‘দ (রাঃ) অনন্য বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলীর অধিকারী ছিলেন। তিনি নিজেই বলেন,
সাঈদ ইবনুল মুসাইয়্যেব (রহঃ) বলেন,
অন্যত্র তিনি বলেন,
মানাকিব বা মর্যাদাঃ-
সা‘দ (রাঃ) ছিলেন বিশেষ মর্যাদার অধিকারী একজন জলীলুল কদর ছাহাবী। তাঁকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) পরোক্ষভাবে জান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছিলেন। নিম্নে এই খ্যাতিমান আনছার ছাহাবীর মর্যাদা ও ফযীলতের কতিপয় দিক উল্লেখ করা হ’ল।-
১. তাঁর জানাযায় সত্তর হাযার ফিরিশতা অংশগ্রহণ করেছিলেন।
২. তাঁর মৃত্যুতে আল্লাহর আরশ কেঁপেছিল এবং আসমানের দরজা খুলে দেওয়া হয়েছিল। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,
৩. তাঁকে দাফন করার পরে তাঁর কবর আযাব মাফ করার জন্য রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) দো‘আ করেছিলেন। যেমন হাদীছে এসেছে,
৪. তাঁর কবর প্রশস্ত করে দেওয়া হয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,
৫. হাফেয যাহাবী (রহঃ) বলেন,
যেমন হাদীছে ইঙ্গিত এসেছে। বারা ইবনে আযেব (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে এক জোড়া রেশমী পোশাক উপহার দেওয়া হ’ল। তখন ছাহাবায়ে কেরাম তার কোমলতায় বিস্ময় বোধ করতে লাগলেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন,
অপর একটি হাদীছে এসেছে, আনাস ইবনু মালেক (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে চিকন রেশমের একটি জুববা উপহার দেয়া হ’ল। অথচ নবী করীম (ছাঃ) রেশম পরিধান করতে নিষেধ করতেন। তখন লোকেরা তাতে বিস্ময় বোধ করলো। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, ঐ সত্তার কসম! যাঁর হাতে মুহাম্মাদের প্রাণ রয়েছে। নিঃসন্দেহে জান্নাতে সা‘দ ইবনু মু‘আযের রুমালগুলো এর তুলনায় অধিক উত্তম’।[35]।
৫. ফিরিশতাগণ তার লাশ বহন করেন। আনাস (রাঃ) বলেন, যখন সা‘দ ইবনু মু‘আযের জানাযা (লাশ) বয়ে নিয়ে যাওয়া হয় তখন মোনাফিকরা বলে, কতই না হালকা এ মৃতদেহটি! তাদের এরূপ মন্তব্যের কারণ ছিল বনু কুরায়যা সম্পর্কে তাঁর প্রদত্ত ফায়ছালা। নবী করীম (ছাঃ)-এর কাছে এ সংবাদ পৌঁছলে তিনি বললেন, إِنَّ الْمَلاَئِكَةَ كَانَتْ تَحْمِلُهُ ‘নিশ্চয়ই ফেরেশতাগণ তার জানাযা (লাশ) বহন করেছিলেন (তাই হালকা অনুভূত হয়)।[36]
হাদীছ বর্ণনাঃ-
সা‘দ (রাঃ) থেকে দু’টি হাদীছ বর্ণিত হয়েছে। একটি আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ)-এর সূত্রে এবং একটি আনাস (রাঃ) তাঁর থেকে বর্ণনা করেন সা‘দ ইবনুর রবী-এর হত্যার ঘটনা সম্পর্কিত।[37]।
অবান্তর একটি প্রশ্নঃ-
"আল্লাহ্র আরশ কি এতই দুর্বল যে কেঁপে উঠেছে" ?
আসুন জেনে নিই, হযরত সা'দ ইবনে মুয়াজ (রঃ) সম্পর্কে উপরের হাদিস সমূহ থেকে আমরা যা বুঝতে পারলাম।
১/ হাদিসটি হযরত সাদ ইবনে মুয়াজ (রা) এর মর্যাদা বর্ণনা করার জন্য উল্লেখ করা হয়েছে ।
২/ সাহাবীর মর্যাদা বুঝাতে রূপক অর্থে "আল্লাহ্র আরশ কেঁপে উঠেছে বুঝানো হয়ছে" ।
৩/ দুনিয়ার কমল রুমাল থেকে জান্নাতের রুমাল অনেক গরজিয়াস এবং মুলায়েম ।
৪/ হযরত সাদ ইবনে মুয়াজ (রা) বনু কুরাইজা সন্ত্রাসীদের এমন এক শাস্তি নির্ধারণ করেছিলেন যেটা সরাসরি আল্লাহ্র ফয়সালার সাথে মিলে গিয়েছে ।
৫/ কোন কিছু কেঁপে উঠা মানে, এটা প্রমান হয় না যে সেটি দুর্বল,নরম শক্তিহীন ।
৬/ উদাহরণঃ মোবাইলে আমরা অনেক সময় ভাইব্রেশন অন করে রাখি যাতে কল এলে মোবাইলে আওয়াজ না হয় এবং মোবাইল কেঁপে উঠে , আচ্ছা এর মানে কি মোবাইল তুলার মত নরম ? উত্তর হচ্ছে না । সুতরাং কেঁপে উঠা মানেই সেট দুর্বল এই কথা ভিত্তিহীন ও অযৌক্তিক ।
৭/ উদাহরণঃ আমরা অনেক সময় বলি "বন্ধু তুমি ক্রিকেট খেলায় এমন ভাবে চার ছক্কা মেরেছ যে পুরা মাঠ তুমার খেলায় কাঁপছিল" আচ্ছা এখন কি কোন খগেন বলবেন যে, এর মানে ক্রিকেট খেলার মাঠ তুলার মত দুর্বল মানুষ সেখানে খেলতে পারে না ? হাহাহাহাহা
৮/ উদাহরণঃ বাংলাদেশের নারীদের উন্নয়নের জন্য আয়েশা বেগম এমন কাজ করেছেন এবং এতে সরকার এত খুশি হয়েছেন সে সরকারের পুরো ভবন কেপে উঠেছিল । আচ্ছা এর মানে কি সরকারের ভবন তুলার মত নরম সেটি বাতাসে উড়ে যাবে, সরকারের ভবনের কোন ক্ষমতা নাই ?
৯/ উদাহরণঃ মুক্তিযোদ্ধারা এমন ভাবে দেশেকে স্বাধীন করার জন্য যুদ্ধ করছিলেন যে পুরো দেশ কাঁপছিল ,আচ্ছা এর মানে একটি দেশ নরম তুলার মত ? দেশের মাটি দুর্বল ? যেহেতু দেশ কাঁপছিল সেহেতু কি মুক্তিযোদ্ধারা দুর্বল ?
১০/ প্রশ্ন আসতে পারে আল্লাহ্র আরশের চেয়ে একজন মুমিন বান্দার মর্যাদা কিভাবে বেশি হতে পারে ? এর উত্তর সহজঃ কোন মর্যাদাবান জিনিসকে দিয়ে অন্য কাউকে মর্যাদার উদাহরণ দেয়া হলে এর মানে এটি প্রমান হয় না যে ঐ মর্যাদারবান জিনিসকে ছোট করা হয়েছে । ঠিক একই ভাবে হজরত সাদ ইবনে মুয়াজ (রা) এর মৃত্যুতে আল্লাহ্র আরশ কেঁপে উঠেছিল এর মানে এটি প্রমান হয় না যে আল্লাহ্র আরশের মর্যাদা কমে গিয়েছে । ধরুন আপনাকে বলা হল, "ভাই আপনি তো দেখি সাকিব আল হাসানের মত ক্রিকেট খেলেন" এর মানে এই না যে সাকিব আল হাসানকে ছোট করা হয়েছে ।
সহিহ বুখারি, হাদিসঃ ১৫৯৭, সহিহ হাদিসঃ উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি হাজ্রে আসওয়াদের কাছে এসে তা চুম্বন করে বললেন, আমি অবশ্যই জানি যে, তুমি একখানা পাথর মাত্র, তুমি কারো কল্যাণ বা অকল্যাণ করতে পার না। নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে তোমায় চুম্বন করতে না দেখলে কখনো আমি তোমাকে চুম্বন করতাম না। - দেখুন কাবা ঘরের মতন একটি পবিত্র স্থানের পাথরকে হজরত ওমর (রা) বলছেন - এই হাদিসের হাজ্রে আসওয়াদ পাথরের কোন ক্ষমতা নেই বলা হয়েছে কিন্ত এর মানে এই না যে হাজ্রে আসওয়াদ পাথরের কোন গুরুত্ব নাই । যেহেতু আমাদের নেতা নবী মুহাম্মদ (সা) এই পাথরকে চুম্বন করতেন তাই অবশ্যই এই পাথরের মর্যাদা আমাদের কাছে রয়েছে কিন্তু কোন মানুষের কল্যাণ অথবা অকল্যাণ করার ক্ষমতা এই পাথরের নাই । এর মানে এই না যে পাথরকে অসম্মান করা হয়েছে ।
১১/ সুতরাং প্রশ্নকর্তা যে প্রশ্ন করেছেন সেটির মৌলিক উত্তর হবে হযরত সাদ ইবনে মুয়াজ (রা) এর মর্যাদা বুঝাতে রূপক অর্থে নবী (সা) আরশ কেপে উঠেছিল বুঝিয়েছেন।
উপসংহারঃ-
সা‘দ ইবনু মু‘আয (রাঃ) ছিলেন ইসলামের একনিষ্ঠ খাদেম এবং রাসূল (ছাঃ)-এর একান্ত অনুসারী। তাঁর জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত ব্যয় করেছেন ইসলাম রক্ষার স্বার্থে। জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত তিনি ইসলামের জন্য ছিলেন নিবেদিত ও উৎসর্গিত। মৃত্যুর স্বল্প সময় পূর্বে বনু কুরায়যার ব্যাপারে ফায়ছালা দিয়ে তা তিনি প্রমাণ করে গেছেন। যার ফলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে জান্নাতী বলে ইঙ্গিত করেছেন। এ ছাহাবীর জীবনী থেকে তাই আমাদের জন্য বহু শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে। আল্লাহ আমাদেরকে তাঁর জীবনী থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজেদেরকে সেভাবে গড়ে তোলার তাওফীক দিন-আমীন!
[1]. ইবনু হাজার আসক্বালানী, তাহযীবুত তাহযীব, ৩য় খন্ড (বৈরুতঃ দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, ১ম প্রকাশ, ১৯৯৪ খ্রী.), ১৪১৫ হি.), পৃঃ ৪২০।
[2]. তদেব; আবু আব্দুল্লাহ আল-হাকিম নিসাপুরী, আল-মুস্তাদরাক আলাছ ছহীহাইন, ৪র্থ খন্ড (বৈরুতঃ দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, ১ম প্রকাশ, ১৯৯০ খ্রী./১৪১১ হি.), পৃঃ ২২৬।
[3]. হাফেয শামসুদ্দীন আয-যাহাবী, সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ১ম খন্ড (বৈরুত : মুআসসাসাতুর রিসালাহ, ৩য় সংস্করণ, ১৯৮৫/১৪০৫), পৃঃ ২৯০।
[4]. সিয়ার ১/২৮০।
[5]. সিয়ার ১/২৮৯, ২৯৬।
[6]. ইবনু কাছীর, আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, ২য় খন্ড, ৪র্থ জুয, (কায়রো : দারুর রাইয়ান, ১ম প্রকাশ, ১৪০৮ হিঃ/১৯৮৮ খ্রী.), পৃঃ ১৩১।
[7]. বুখারী হা/৩৬৩২।
[8]. সিয়ার ১/২৯২।
[9]. তাহযীবুত তাহযীব, ৩য় খন্ড, পৃঃ ৪২০।
[10]. বুখারী হা/৪১২২, ‘মাগাযী’ অধ্যায়; মুসলিম হা/১৭৬৯, ‘জিহাদ ও সফর’ অধ্যায়।
[11]. মুস্তাদরাকে হাকেম, ৪/২২৭; তাহযীব ৩/৪২০।
[12]. বুখারী হা/৪১১৭, ‘মাগাযী’ অধ্যায়।
[13]. বুখারী হা/৪১১৯, ঐ।
[14]. আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, ২য় খন্ড, ৪র্থ জুয, পৃঃ ১৩২, ১২৯।
[15]. বুখারী হা/৪১১৭; মুসলিম হা/১৭৬৯।
[16]. বুখারী হা/৩০৪৩।
[17]. বুখারী হা/৪১২১, ৪১২২।
[18]. বুখারী হা/৪১২১; মুসলিম হা/১৭৬৮, ১৭৬৯, ‘জিহাদ ও সফর’ অধ্যায়।
[19]. বুখারী হা/৪১২২; মুসলিম হা/১৭৬৯।
[20]. বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, ২য় খন্ড, ৪র্থ জুয, পৃঃ ১৩২; সিয়ার ১/২৯০।
[21]. তদেব।
[22]. তদেব, পৃঃ ২৯৫।
[23]. তদেব, পৃঃ ২৮৯।
[24]. তদেব, পৃঃ ২৯০।
[25]. তদেব, পৃঃ ২৯৭।
[26]. তাহযীবুত তাহযীব ৩/৪২০।
[27]. তদেব।
[28]. তদেব।
[29]. সিয়ার ১/২৯৬।
[30]. নাসাঈ, মিশকাত হা/১৩৬।
[31]. আহমাদ, মিশকাত হা/১৩৫; সনদ ছহীহ। দ্র. ইরওয়াউল গালীল ৩/১৬৬ পৃঃ।
[32]. ছহীহুল জামে‘ হা/৫৩০৬, হাদীছ ছহীহ।
[33]. তদেব, পৃঃ ২৯০।
[34]. বুখারী হা/৩২৪৯, ৩৮০২; মুসলিম হা/১২৬।
[35]. বুখারী হা/২৬১৫, ৩২৪৮; মুসলিম হা/১২৭/২৪৬৯।
[36]. তিরমিযী হা/৩৮৪৯ ‘ফাযাইল’ অধ্যায়; মিশকাত হা/৬২২৮, সনদ ছহীহ।
[37]. তদেব।
Comments
Post a Comment