সূরা নিসার ৬৪ ও ৬৫ নং আয়াতের সহীহ অনুবাদ ও তাফসীরঃ-
রসূল (সাঃ)-এর কোন কথা অথবা কোন ফায়সালার ব্যাপারে বিরোধিতা করা তো দূরের কথা সে ব্যাপারে অন্তরে কোন 'কিন্তু' রাখাও ঈমানের পরিপন্থী। কুরআনের এই আয়াত হাদীস অস্বীকারকারীদের জন্য তো বটেই এবং সেই সাথে অন্য এমন লোকদের জন্যও চিন্তা ও চেতনার দ্বার উদ্ঘাটন করে, যাঁরা তাঁদের ইমামের উক্তির মোকাবেলায় সহীহ হাদীসকে মানতে কেবল সংকোচ বোধই করেন না, বরং হয় পরিষ্কার ভাষায় তা মানতে অস্বীকার করেন, নতুবা বিষয়ের সাথে সম্পর্কহীন অপব্যাখ্যা করেন, নতুবা বিশ্বস্ত রাবী (বর্ণনাকারী)-কে যয়ীফ বা দুর্বল আখ্যা দিয়ে হাদীস প্রত্যাখ্যান করার নিন্দনীয় প্রচেষ্টা চালান। সূরা আন নিসার ৬৪ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
وَمَا أَرْسَلْنَا مِنْ رَسُولٍ إِلَّا لِيُطَاعَ بِإِذْنِ اللَّهِ وَلَوْ أَنَّهُمْ إِذْ ظَلَمُوا أَنْفُسَهُمْ جَاءُوكَ فَاسْتَغْفَرُوا اللَّهَ وَاسْتَغْفَرَ لَهُمُ الرَّسُولُ لَوَجَدُوا اللَّهَ تَوَّابًا رَحِيمًا
"আমি সব নবী রাসূলকেই এ উদ্দেশ্যে পাঠিয়েছি যে, আল্লাহর নির্দেশে মানুষ তার আনুগত্য করবে। যদি তারা নিজেদের ওপর জুলুম করার পর অর্থাৎ আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করে আপনার কাছে তথা মুহাম্মদ(সা.)'র কাছে আসে এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা চায়, আর রাসূলও তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে, তবে তারা আল্লাহকে ক্ষমাশীল ও দয়াময়রূপে পাবে।"
সূরা নিসা, আয়াত ৬৪।
মোনাফিকরা বিচারক হিসেবে রাসূলকে মনোনীত না করে বিধর্মীদের কাছে বিচারের জন্য যেত৷ এ আয়াতে বলা হয়েছে বিভিন্ন বিষয়ে মহানবী (সা.)'র আনুগত্য করাই জনগণের দায়িত্ব। মহানবী (সা.) শুধু আল্লাহর বাণী প্রচারের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত নন, তিনি একইসঙ্গে রাষ্ট্রেরও প্রধান৷ তাই মুসলমানদের উচিত সব বিষয়ে একমাত্র তাঁরই আনুগত্য করা, অন্যদের নয়।
উল্লেখ্য, রাসূল,,,,,,,, (সা.)'র আনুগত্য করা আল্লাহরই নির্দেশ। কারণ, আল্লাহর নির্দেশ ছাড়া কারো আনুগত্য করা হলে তা হবে শির্ক ও কুফুরী কাজ৷ অবশ্য নবীগণ আল্লাহর নির্দেশের বিরোধী কোন নির্দেশ দেন না।
এরপর বলা হয়েছে, রাসূলের নির্দেশ অমান্য করার গোনাহ মোচনের জন্য আগে মহানবী (সা.) এর সন্তুষ্টি অর্জন করতে হবে, এরপর মহানবী (সা.) তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করলে তখনই আল্লাহ ঐ ক্ষমা গ্রহণ করবেন। এ আয়াত শুধু যে রাসূল (সা.)'র যুগের জন্য প্রযোজ্য তা নয়, এই আয়াতের নির্দেশ সব যুগের জন্যেই প্রযোজ্য।
অনেকেই বলেন, এ যুগেও কেউ যদি আল্লাহ ও রাসূলের নির্দেশ অমান্য করার কারণে অনুতপ্ত হয়ে মহানবী (সা.)'র মাজারে যায় এবং তার জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে মহানবীকে অনুরোধ করে তাহলে মহানবী (সা.)'র শাফায়াতের ওসিলায় তার তওবা কবুলের সম্ভাবনা রয়েছে৷
এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলোঃ-
প্রথমতঃ
ধমীয় নেতাদের অনুসরণের মধ্যেই রয়েছে মানুষের মুক্তি৷ নামাজ ও মুক্তির জন্যে শুধু মৌখিক ঈমানই যথেষ্ট নয়, ধর্মীয় নেতাদের আনুগত্য করাও জরুরী।
দ্বিতীয়তঃ
নবীদের দেখানো শিক্ষা ও আদর্শ থেকে দূরে সরে গিয়ে জালেম বা বিজাতীয়দের শরণাপন্ন হওয়া নিজের ওপরই জুলুম মাত্র৷ এটা নবী বা ধর্মীয় নেতাদের প্রতি জুলুম নয়।
তৃতীয়তঃ
আল্লাহর প্রিয় বান্দা বা অলী আওলিয়াদের মাজার জিয়ারত করা এবং গোনাহ মোচন ও সুপারিশের জন্য তাঁদেরকে ওসিলা করা পবিত্র কোরআনেরই পরামর্শ।
সূরা নিসার ৬৫ নং আয়াতের সহীহ অনুবাদ ও তাফসীর দ্বারা প্রমাণিত, যারা রসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ফায়ছালাকারী-কাজী মেনে না নিবে তারা কখনো মুমিন হতে পারবে না অর্থাৎ তারা বেঈমান। আল্লাহ পাক বলেন,
فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤْمِنُونَ حَتَّى يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لَا يَجِدُوا فِي أَنْفُسِهِمْ حَرَجًا مِمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوا تَسْلِيمًا
অর্থঃ “অতএব হে রসূল! মহান আল্লাহ পাকের কসম! তোমরা ততক্ষণ পর্যন্ত মু’মিন হতে পারবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত তোমাদের যাহিরী এবং বাতিনী প্রত্যেক বিষয়ে হুযূর পাককে কজী বা ফায়ছালাকারী হিসেবে মেনে না নিবে এবং যতক্ষণ পর্যন্ত তোমাদের অন্তরে সে বিষয়ে চুল-চেরা, ক্বীল-ক্বাল থাকবে। বরং (বাহ্যিক-আভ্যান্তরীণ) উভয় দিক থেকে তা আনুগত্যতার সাথে মেনে নিতে হবে।”
(পবিত্র সূরা নিসা: আয়াত ৬৫)।
তাফসীরঃ- হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর (রাঃ) বললেন, আল্লাহর কসম! আমার মনে হয়, এই আয়াতটি এ সম্পর্কে নাযিল হয়েছে। “
عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ الزُّبَيْرِ ـ رضى الله عنهما ـ أَنَّهُ حَدَّثَهُ أَنَّ رَجُلاً مِنَ الأَنْصَارِ خَاصَمَ الزُّبَيْرَ عِنْدَ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم فِي شِرَاجِ الْحَرَّةِ الَّتِي يَسْقُونَ بِهَا النَّخْلَ فَقَالَ الأَنْصَارِيُّ سَرِّحِ الْمَاءَ يَمُرُّ فَأَبَى عَلَيْهِ، فَاخْتَصَمَا عِنْدَ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم لِلزُّبَيْرِ " اسْقِ يَا زُبَيْرُ، ثُمَّ أَرْسِلِ الْمَاء إِلَى جَارِكَ ". فَغَضِبَ الأَنْصَارِيُّ، فَقَالَ أَنْ كَانَ ابْنَ عَمَّتِكَ. فَتَلَوَّنَ وَجْهُ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ثُمَّ قَالَ " اسْقِ يَا زُبَيْرُ، ثُمَّ احْبِسِ الْمَاءَ، حَتَّى يَرْجِعَ إِلَى الْجَدْرِ ". فَقَالَ الزُّبَيْرُ وَاللَّهِ إِنِّي لأَحْسِبُ هَذِهِ الآيَةَ نَزَلَتْ فِي ذَلِكَ {فَلاَ وَرَبِّكَ لاَ يُؤْمِنُونَ حَتَّى يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ}.
হযরত ‘আবদুল্লাহ ইবনু যুবাইর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, জনৈক আনসারী নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সামনে যুবাইর (রাঃ)-এর সঙ্গে হাররার নালার পানির ব্যাপারে ঝগড়া করল যে পানি দ্বারা খেজুর বাগান সিঞ্চন করত। আনসারী বলল, নালার পানি ছেড়ে দিন, যাতে তা (প্রবাহিত থাকে) কিন্তু যুবাইর (রাঃ) তা দিতে অস্বীকার করেন। তারা দু’জনে নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকটে এ নিয়ে বিতর্কে লিপ্ত হলে আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যুবাইর (রাঃ)- কে বলেন, হে যুবাইর! তোমার যমীনে (প্রথমে) সিঞ্চন করে নাও। এরপর তোমার প্রতিবেশীর দিকে পানি ছেড়ে দাও।
এতে আনসারী অসন্তুষ্ট হয়ে বলল, সে তো আপনার ফুফাতো ভাই। এতে আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর চেহারায় অসন্তুষ্টির লক্ষণ প্রকাশ পেল। এরপর তিনি বললেন, হে যুবাইর! তুমি নিজের জমি সিঞ্চন কর। এরপর পানি আটকিয়ে রাখ, যাতে তা বাঁধ পর্যন্ত পৌঁছে। হযরত যুবাইর (রাঃ) বললেন, আল্লাহর কসম! আমার মনে হয়, নিচের এই আয়াতটি এ সম্পর্কে নাযিল হয়েছে। “
﴿ فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤۡمِنُوۡنَ حَتّٰى يُحَكِّمُوۡكَ فِيۡمَا شَجَرَ بَيۡنَهُمۡ ثُمَّ لَا يَجِدُوۡا فِىۡۤ اَنۡفُسِهِمۡ حَرَجًا مِّمَّا قَضَيۡتَ وَيُسَلِّمُوۡا تَسۡلِيۡمًا
সহিহ বুখারী, হাদিস নং ২৩৫৯।
অন্য বর্ণনায় এসেছে, এক ব্যক্তি তার নাম ছিল বিশর। সে মুসলমান দাবি করতো, হাক্বীক্বত সে ছিল মুনাফিক। এই মুনাফিক বিশরের সাথে এক ইহুদীর সাথে গন্ডগোল হয়ে যায়। যখন গন্ডগোল হয়ে গেল, তখন মুনাফিক বিশরকে ইহুদী বললো, হে বিশর এটার বিচার বা ফায়ছালা করতে হবে। কে বিচার করবেন? ইহুদী বললো, তোমাদের যিনি নবী ও রসূল, যিনি আখিরী নবী, নূরে মুজাসসাম,হুযূর পাক তিনি বিচার করবেন।
মুনাফিক বিশর মনে মনে চিন্তা করলো, নূরে মুজাসসাম, হুযূর পাক যদি বিচার করেন, উনি তো হক্ব বিচার করবেন, তাহলে ইহুদীর পক্ষে রায় চলে যাবে। তখন মুনাফিক বিশর বললো যে, না তুমি এক কাজ করো, তোমাদের যে বিচারক, কাব ইবনে আশরাফ অথবা আবু রফে ইহুদী রয়েছে তারা বিচার করবে। কিন্তু ইহুদী ব্যক্তি জানতো যে, কাব ইবনে আশরাফ অথবা আবু রফে যদি বিচার করে, তাহলে তারা মুনাফিকী করবে। হেরফের করবে, তারা ঘুষ খেয়ে পক্ষপাতিত্ব করবে। কারণ ইতিপূর্বেও তারা এমন অনেক করেছে যার নজির রয়েছে। তখন সেই ইহুদী বললো- না, নূরে মুজাসসাম হুযূর পাক বিচার করবেন।
এই কথা বলে মুনাফিক বিশরকে বুঝিয়ে নিয়ে গেল হুযূর পাকের কাছে। বিচার হয়ে গেল। হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিচার করলেন। মুনাফিক বিশরের বিরুদ্ধে ইহুদীর পক্ষে রায় পড়লো। মুনাফিক বিশর সেখানে তা বাহ্যিকভাবে মেনে নিলেও দরবার শরীফ থেকে বের হয়ে বললো, বিচারটা আমার মনঃপূত হচ্ছে না। নাউযুবিল্লাহ!
ইহুদী বললো, হে বিশর তুমি বলো কি? তোমাদের যিনি রসূল, যিনি আল আমীন উনার বিচার তোমার মনঃপূত হয়নি? তবে তুমি কার বিচার মানবে?
সেই যামানায় খলীফায়ে ছানী সাইয়্যিদুনা হযরত ফারূক্বে আ’যম রঃ বিচার করতেন। মুনাফিক বিশর সে মনে করলো যে, সাইয়্যিদুনা হযরত ফারূক্বে আ’যম রঃ খুব জালালী তবিয়ত। উনার প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক বলেন-
اشداء على الكفار,,,
অর্থাৎ “উনি কাফিরদের প্রতি কঠোর।” (সূরা ফাতহ, আয়াত ২৯)
তিনি হয়তো আমার পক্ষেই রায় দিবেন এবং ইহুদী কাফির তার বিপক্ষে রায় দিবেন। মুনাফিক বিশর সে ইহুদীকে নিয়ে গেল সাইয়্যিদুনা হযরত উমর ইবনুল খাত্তাবের রঃ কাছে বিচারের জন্য। ইহুদী খুব চালাক ছিল, সে বললো, হে উমর ইবনুল খত্তাব রঃ এই বিশর আমাকে নিয়ে এসেছে আপনার কাছে বিচারের জন্য। অথচ আমরা এই মাত্র মহান আল্লাহ পাকের রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে নববী শরীফ থেকে আসলাম; তিনি নিজে বিচার করে দিয়েছেন। রায় আমার পক্ষে দেয়া হয়েছে। কিন্তু বিশর সে বিচার মানতে নারাজ; সেজন্য সে আমাকে আপনার কাছে নিয়ে এসেছে। পুনরায় বিচার করার জন্য।
সাইয়্যিদুনা হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রঃ একথা শুনে বললেন, ঠিক আছে। তোমরা বস, আমি তোমাদের বিচার করবো। উনি ঘরে প্রবেশ করলেন, ঘরে প্রবেশ করে একটা তরবারী নিয়ে আসলেন। তরবারী এনে মুনাফিক বিশরকে এক কোপে দু’ভাগ করে দিলেন এবং বললেন, এটাই তোমার বিচার।
কারণ, মহান আল্লাহ পাকের রসূল, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে বিচার করেছেন, সেটা তুমি মান নাই। তোমার একমাত্র শাস্তি ও বিচার হচ্ছে মৃত্যুদণ্ড।
যখন উনি তাকে হত্যা করে ফেললেন, তখন মুনাফিক বিশরের আত্মীয়-স্বজন নূরে মুজাসসাম হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে গিয়ে বললো, ইয়া রসূলাল্লাহ্, ইয়া হাবীবাল্লাহ! হযরত ফারূক্বে আ’যম রঃ কে আপনি বিচারের দায়িত্ব দিয়েছেন। উনি আমাদের একজন আত্মীয়কে হত্যা করে ফেলেছেন। মহান আল্লাহ পাকের রসূল হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, দেখ এটা কি করে সম্ভব? সাইয়্যিদুনা হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রঃ তো খাছ লোক-
( لَوْ كَانَ بَعْدِي نَبِيٌّ لَكَانَ عُمَرَ بْنَ الْخَطَّابِ )
“আমার পরে যদি কেউ নবী হতেন, তাহলে হযরত উমর ইবনুল খত্তাব নবী হতেন।” কাজেই উনার পক্ষে এটা সম্ভব নয়। ঠিক আছে উনাকে ডাকা হোক। সাইয়্যিদুনা হযরত উমর ইবনুল খত্তাব রঃ কে আনা হলো। হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “হে ফারূক্বে আ’যম রঃ! আপনি নাকি একজন মুসলমানকে হত্যা করেছেন?” সাইয়্যিদুনা হযরত ফারূক্বে আ’যম বললেন, ইয়া রসূলাল্লাহ্, ইয়া হাবীবাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! মূলতঃ আমি তাকে হত্যা করার কারণ হচ্ছে- সে মুনাফিকী করেছে। আপনি যে বিচার করেছিলেন, সে বিচার মানেনি, সেজন্য আমি তাকে হত্যা করেছি। হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “হে ফারূক্বে আ’যম রঃ! আপনি যাকে হত্যা করেছেন, সে যে মুনাফিকী করেছে, তার প্রমাণ কি?
কোথায় আপনার দলীল, আপনার সাক্ষী কোথায়?” যেহেতু ইসলামে সাক্ষী ছাড়া কোনো কথা গ্রহণযোগ্য নয়। সাইয়্যিদুনা হযরত উমর ইবনুল খত্তাব রঃ চুপ করে রইলেন। সাথে সাথে মহান আল্লাহ পাক স্বয়ং নিজে সাক্ষী হয়ে গেলেন। মহান আল্লাহ পাক উক্ত আয়াত শরীফ নাযিল করে দিলেন।
সূত্রঃ তাফসীরে জালালাইন শরীফ, ১/৮৪২
তাফসীরে দুররে মানছুর , ২/৩২২
তাফসীরে ইবনে কাছীর , ২/৪০২।
এ দ্বারা এ বিষয়ও প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহর রাসূলের আদেশ-
নিষেধ নির্দ্বিধায় মেনে নেয়া শুধু আচার অনুষ্ঠান কিংবা অধিকারের সাথেই সম্পৃক্ত নয়; আকীদা এবং অপরাপর বৈষয়িক বিষয়েও ব্যাপক। অতএব, কোন সময় কোন বিষয়ে পারস্পারিক মতবিরোধ দেখা দিলে বিবাদ পরিহার করে উভয় পক্ষকে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এবং তার অবর্তমানে তার প্রবর্তিত শরীআতের আশ্রয়ে গিয়ে মীমাংসা অন্বেষণ করা প্রতিটি মুসলিমের উপর ফরয।
এতে এ কথাও জানা গেল যে, যে কাজ বা বিষয় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক কথা বা কাজের মাধ্যমে প্রমাণিত, তা সম্পাদন করতে গিয়ে মনে কোন রকম সংকীর্ণতা অনুভব করাও ঈমানের দূর্বলতার লক্ষণ।
উদাহারণতঃ যে ক্ষেত্রে শরীআত তায়াম্মুম করে সালাত আদায় করার অনুমতি দিয়েছে, সে ক্ষেত্রে যদি কেউ সম্মত না হয় তবে একে পরহেযগারী বলে মনে করা যাবে না, বরং এটা একান্তই মানসিক ব্যাধি। রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম অপেক্ষা কেউ বেশী পরহেযগার হতে পারে না। যে অবস্থায় মহানবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বসে সালাত আদায়ের অনুমতি দিয়েছেন এবং নিজেও বসে সালাত আদায় করেছেন, কারো মন যদি এতে সম্মত না হয় এবং অসহনীয় পরিশ্রম ও কষ্ট সত্ত্বেও দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করে, তবে তার জেনে রাখা উচিত যে, তার মন ব্যাধিগ্রস্ত।
[এ আয়াতে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের মহত্ত্ব ও সুউচ্চ মর্যাদার বিষয় প্রকাশ করার সঙ্গে সঙ্গে কুরআনের অসংখ্য আয়াতের দ্বারা প্রমাণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনুগত্যের অপরিহার্যতার বিষয়টি সবিস্তারে বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
এ আয়াতে আল্লাহ তা’আলা শপথ করে বলেছেন যে, কোন মানুষ ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন কিংবা মুসলিম হতে পারে না যতক্ষণ না সে ধীরস্থির মস্তিস্কে মহানবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম- কে এভাবে স্বীকার করে নেবে যাতে রাসূলের কোন সিদ্ধান্তেই মনে কোন রকম সংকীর্ণতা না থাকে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাসূল হিসেবে গোটা উম্মতের শাসক এবং যে কোন বিবাদের মীমাংসার যিম্মাদার। তার শাসন ও সিদ্ধান্ত অপর কাউকে বিচারক সাব্যস্ত করার উপর নির্ভরশীল নয়। তিনি শুধুমাত্র একজন শাসকই নন, বরং তিনি একজন নিষ্পাপ রাসূল, রাহমাতুল্লিল আলামীন এবং উম্মতের জন্য একান্ত দয়ালু ব্যক্তিত্ব।
কাজেই শিক্ষা দেয়া হয়েছে যে, যখনই কোন বিষয়ে, কোন সমস্যার ব্যাপারে মতবিরোধ দেখা দেয়, তখনই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বিচারক সাব্যস্ত করে তার মীমাংসা করিয়ে নেয়া উচিত এবং অতঃপর তার মীমাংসাকে স্বীকার করে নিয়ে সেমতে কাজ করা উভয় পক্ষের উপর ফরয।
হাদিস অস্বীকার করে যারা শুধু কোরআনকেই দ্বীন ইসলামের উৎস মনে করে, কোরআনের ওই সমস্ত আয়াতকেও তাদের অস্বীকার করতে হবে, যেখানে পরিষ্কার বলা হয়েছে- হাদিস ও সুন্নাত দ্বীনের উৎস এবং শরীয়তের স্বতন্ত্র দলীল। যদি স্বীকার না করে তবে তা হবে কোরআন অস্বীকার করার নামান্তর।
শ্রদ্ধেয় ওস্তাদ আল্লামা ইউসুফ বান্নুরী রহ. বলেছিলেন, কোরআনের একশতেরও অধিক আয়াত এমন আছে, যেগুলোর প্রত্যেকটি হাদিসের শরয়ী দলীল হওয়ার প্রতি স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়। উদাহরণ স্বরূপ নিন্মে তিনটি আয়াত উল্লেখ করা হলো। আল্লাহ তায়ালা বলেন,
فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤۡمِنُوۡنَ حَتّٰى يُحَكِّمُوۡكَ فِيۡمَا شَجَرَ بَيۡنَهُمۡ ثُمَّ لَا يَجِدُوۡا فِىۡۤ اَنۡفُسِهِمۡ حَرَجًا مِّمَّا قَضَيۡتَ وَيُسَلِّمُوۡا تَسۡلِيۡمًا
‘আপনার প্রতিপালকের শপথ, তারা ততক্ষণ মুমিন হবে না, যতক্ষণ না পারস্পরিক বিবাধে তারা আপনাকে মীমাংসাকারী হিসেবে মেনে নেয়। অতঃপর আপনার মীমাংসায় তাদের মনে কোনো ধরনের সঙ্কোচ না আসে এবং তা পূর্ণরূপে মেনে নেয়। (সূরা নিসা : আয়াত ৬৫)।
এ আয়াতে স্পষ্ট ঘোষণা আছে যে, রাসূল সা. এর আদেশের আনুগত্য শুধু যে আবশ্যক তা নয়; বরং মুমিন হওয়ারও পূর্বশর্ত। সেই আদেশ উপদেশ ও কর্মনীতিকেই পরিভাষায় হাদিস বলা হয়। আল্লাহ তায়ালা আরও বলেন,
وَمَا كَانَ لِمُؤۡمِنٍ وَّلَا مُؤۡمِنَةٍ اِذَا قَضَى اللّٰهُ وَرَسُوۡلُهٗۤ اَمۡرًا اَنۡ يَّكُوۡنَ لَهُمُ الۡخِيَرَةُ مِنۡ اَمۡرِهِمۡؕ وَمَنۡ يَّعۡصِ اللّٰهَ وَرَسُوۡلَهٗ فَقَدۡ ضَلَّ ضَلٰلاً مُّبِيۡنًاؕ
‘কোনো মুমিন নারী-পুরুষের অবকাশ নেই যে, আল্লাহ ও তার রাসূল সা. কোনো কাজের আদেশ দিলে সে কাজে প্রশ্ন করবে। আর যে আল্লাহ ও তার রাসূলের আদেশ অমান্য করে সে স্পষ্ট গোমরাহিতে নিপতিত হলো।’
(সূরা আহযাব : আয়াত ৩৬)।
এ আয়াতে আল্লাহ তায়ালা নিজের ও তার রাসূলের আদেশ পালনকে ঈমানের জন্য অপরিহার্য ও মুসলমানের জন্য তা আবশ্যকীয় করে দিয়েছেন। আর রাসূল সা.-এর অবাধ্যতাকে খোদার অবাধ্যতার সাথে তুলনা করেছেন। সুতরাং রাসূল সা.-এর হাদিস তথা বাণী ও কর্ম যদি শরীয়তের অন্যতম দলীল না হত তবে উক্ত আয়াতে এতো কঠোর সাবধান বাণী দেয়া হতো না। আল্লাহ তায়ালা আরও ইরশাদ করেন,
هُوَ الَّذِىۡ بَعَثَ فِىۡ الۡاُمِّيّٖنَ رَسُوۡلاً مِّنۡهُمۡ يَتۡلُوۡا عَلَيۡهِمۡ اٰيٰتِهٖ وَيُزَكِّيۡهِمۡ وَيُعَلِّمُهُمُ الۡكِتٰبَ وَالۡحِكۡمَةَ وَاِنۡ كَانُوۡا مِنۡ قَبۡلُ لَفِىۡ ضَلٰلٍ مُّبِيۡنٍۙ
‘সেই আল্লাহ নিরক্ষর লোকদের কাছে, তাদের থেকে একজন রাসূল প্রেরণ করেছেন, যেন তিনি তাদের নিকট আল্লাহর আয়াতগুলো তেলাওয়াত করেন। এতে করে যাতে তিনি তাদের পবিত্র করেন এবং কিতাব ও প্রজ্ঞার শিক্ষা দান করেন। এর এই লোকেরাই ইতিপূর্বে স্পষ্ট গোমরাহীতে পতিত ছিল।
(সূরা জুমআ, আয়াত ০২)।
এই আয়াতে রাসূল সা. এর চারটি দায়িত্বের কথা উল্লেখ করা হয়।
১. কোরআন তেলাওয়াত,
২. পরিশুদ্ধকরণ,
৩. কিতাবের শিক্ষা,
৪. প্রজ্ঞার শিক্ষা দান।
এখানে কিতাবের শিক্ষা বলতে কোরআনের তাফসির ও ব্যাখ্যার কথা বোঝানো হয়েছে। আর প্রজ্ঞা অর্থ হাদীস ও সুন্নাত। (ইবনে কাসির)। সুতরাং বোঝা যায় রাসূল সা.-এর দায়িত্ব ডাক পিয়নের মতো শুধু মানুষের কাছে আল্লাহর বাণী পৌঁছানো নয়; বরং কোরআনের তালিম এবং তাফসির তথা ব্যাখ্যার দায়িত্বও তার প্রতি ন্যস্ত হয়েছে। যারা শুধু কোরআনকেই শরীয়তের দলীল মনে করে, কোরআন তাদের তাগিদ দিচ্ছে যে, পাশাপাশি যেন হাদিস ও সুন্নাতকেও শরীয়তের দলীলরূপে স্বীকার করা হয়।
মনে রাখতে হবে যে, কুরআনের বাণী ও রাসূলের হাদীসসমূহের উপর আমল করা মহানবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগের সাথেই সীমিত নয়। তাঁর তিরোধানের পর তাঁর পবিত্র শরীআতের মীমাংসাই হল তাঁর মীমাংসা। কাজেই এ নির্দেশটি কিয়ামত পর্যন্ত তেমনিভাবেই বলবৎ থাকবে, যেমন ছিল তাঁর যুগে। তখন যেমন সরাসরি কোন বিষয়ের সিদ্ধান্তকল্পে তাঁর কাছে উপস্থিত করা হত, তেমনি তাঁর পরে তাঁর প্রবর্তিত শরীআতের সিদ্ধান্ত মেনে নিতে হবে। এটা প্রকৃতপক্ষে তাঁরই অনুসরণ। আল্লাহ পাক বলেন,
وَمَا آتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوا
“রসুলূল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তোমাদের যা দিয়েছেন তা তোমরা গ্রহণ কর, আর তিনি যা নিষেধ করেন তা থেকে বিরত থাক।” (সূরা হাশরঃ ৭)
আল্লাহ পাক কালামুল্লাহ শরীফে ইরশাদ করেনঃ
وَمَا يَنطِقُ عَنِ الْهَوَى إِنْ هُوَ إِلَّا وَحْيٌ يُوحَى
অর্থঃ আমার হাবীব রাসুলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের ইচ্ছামতো কোন কথা বলেন না। আমি যা ওহীর মাধ্যমে উনার কাছে পাঠাই তাই বলে থাকেন। (সূরা নাজম শরীফঃ ৩-৪)
তার মানে এই আয়াত শরীফ প্রমাণ করে রসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে কথাই বলতেন তা সম্মানিত ওহীর অন্তর্ভুক্ত।
মহান আল্লাহ পাক কালামুল্লাহ শরীফে আরো ইরশাদ করেনঃ
مَنْ يُطِعِ الرَّسُولَ فَقَدْ أَطَاعَ اللَّهَ وَمَنْ تَوَلَّى فَمَا أَرْسَلْنَاكَ عَلَيْهِمْ حَفِيظًا
যে লোক রসুল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হুকুম মান্য করবে সে মহান আল্লাহ পাকের হুকুম মান্য করলো। আর যে লোক বিমুখতা অবলম্বন করল, আমি আপনাকে (হে রাসুলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম), তাদের জন্য রক্ষণাবেক্ষণকারী নিযুক্ত করে পাঠাইনি (তাদের কোনো হেফাজত কারি নাই)। (পবিত্র সূরা আন নিসা, আয়াত ৮০)।
তাহলে আল্লাহ পাকের রাসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা বলতেন , যা করতেন সবই ওহীর অন্তর্ভুক্ত। উনি যে বিচার করতেন , ফায়সালা করতেন তা উনার নিজের মত বা নিজের ফায়সালা না সবই ছিল আল্লাহ পাকের ওহী। সুবহানাল্লাহ!
Comments
Post a Comment