“রাসুলের সাথে বেয়াদবীর পরিণাম।
*********************************
প্রসংগঃ-
আবু লাহাব ও তার পরিবার এবং মুনাফিক বিশরের পরিণতি।
বিশ্বনবী মক্কায় যেসব ঘনিষ্ঠজনকে তৌহিদের দিকে আহ্বান জানিয়েছেন তাদের মধ্যে যারা সত্য গ্রহণ না করে শিরকের প্রতি অটল থেকেছে তাদের ব্যাপারে আপনি নিজের অবস্থান স্পষ্ট করুন। বলে দিন যে, তাদের এ কাজের প্রতি আপনার কোনো সায় নেই এবং আপনি এ কাজকে ঘৃণা করেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন,
وَأَنْذِرْ عَشِيرَتَكَ الْأَقْرَبِينَ,,
“এবং আপনার আত্মীয়-স্বজনকে আপনি সতর্ক করে দিন।”
যখন কোরআন মজিদের আয়াত নাজিল হলো তখন একদিন নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা কোরাইশদের ডেকে মূর্তিপূজা ত্যাগ করে এক লা-শরীক আল্লাহর ইবাদাত করার আহবান জানালেন। সকলে চুপ রইলো। কিন্তু চাচা আবু লাহাব অগ্রসর হয়ে দুই হাত নেড়ে বললোঃ
تبالک یا محمد الھذا دعوتنا,,
অর্থঃ-“হে মুহাম্মদ! তোমার সর্বনাশ হোক!নএজন্যই কি তুমি আমাদেরকে ডেকেছো”?
তার এই বেয়াদবীপূর্ন উক্তি আল্লাহর সহ্য হলোনা। তার বিরুদ্ধে সূরা লাহাব নাযিল হলো। তার স্ত্রী নবীজীকে গালাগাল দিত এবং নবীজীর যাতায়াত পথে কাঁটা গেড়ে রাখতো। সূরা লাহাবে আল্লাহ তায়ালা উভয়ের বিরুদ্ধে নিম্নোক্ত শাস্তি ঘোষনা করলেন,
{ تَبَّتْ يَدَآ أَبِي لَهَبٍ وَتَبَّ, مَآ أَغْنَىٰ عَنْهُ مَالُهُ وَمَا كَسَبَ, سَيَصْلَىٰ نَاراً ذَاتَ لَهَبٍ, وَٱمْرَأَتُهُ حَمَّالَةَ ٱلْحَطَبِ, فِي جِيدِهَا حَبْلٌ مِّن مَّسَدٍ }
“আবু লাহাবের উভয় হাত ধ্বংস হোক এবং সে নিজেও ধ্বংস হোক। তার মালদৌলত ও জনবল কোন উপকারে আসবেনা। সে লেলিহান অগ্নিশিখায় অচিরেই পৌছে যাবে এবং তার স্ত্রীও তার সমগামিনী হবে। লাকড়ী বহনকালে তার গলায় রশি পড়বে” (সূরা লাহাব)।
মূলতঃ- নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা এর সাথে বেয়াদবী করে কেউ রক্ষা পায়নি। আবু লাহাবের দুই ছেলে ওতবা ও ওতায়বা এর নিকট নবীজীর দু’কন্যা রোকাইয়া ও উম্মে কুলসুম রাদিয়াল্লাহু আনহুমা এর বাল্য বিবাহ হয়েছিল ছোটকালে। সূরা লাহাব নাযিল হওয়ার পর তারা পিতার নির্দেশে দু’বোনকে বিবাহ বাসরের পূর্বেই তালাক প্রদান করে। এক পর্যায়ে ওতায়বা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা এর জামা মুবারক ছিড়ে ফেলে। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা এতে মনে বড় আঘাত পেলেন এবং বদদোয়া করলেন,
"اللهم سلط عليه كلبًا من كلابك".
“হে আল্লাহ!তুমি ওতায়বার ওপর তোমার পক্ষ থেকে একটি কুকুর লেলিয়ে দাও”।
নবীজীর বদদোয়া অক্ষরে অক্ষরে ফলে গেলো। কোন এক বানিজ্য সফরে (সিরিয়া) একটি বাঘ এসে বহুলোকের মধ্যখান থেকে ঘুমন্ত অবস্থায় ওতায়বার ঘাড় মটকে রক্ত চুষে চলে গেলো।
নবীজীর সাথে বেয়াদবী করে আপন চাচা-চাচী ও চাচাত ভাইয়েরা বাঁচতে পারেনি। আল্লাহর গযবে পতিত হতে হয়েছে তাদের উপর। যারা রাসূলের আত্মীয় নয়-তারা বেয়াদবী করলে আল্লাহ কি তাদের ছেড়ে দেবেন? কখনই নয়। কবি বলেছেনঃ
خدا جسکو پکڑے چھوڑالے محمد,,
محمد جو پکڑے چھوڑا کوءی نہیں سکتا-
“খোদা কাউকে পাকড়াও করলে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা শাফায়াত করে তাকে ছাড়িয়ে আনবেন বলে প্রমাণ আছে। কিন্তু মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা কাউকে পাকড়াও করলে তাকে ছাড়িয়ে নেয়ার কেউ নাই”
এজন্যই ফতোয়ায়ে শামীতে উল্লেখ আছে-নবীজীর সাথে কেউ বেয়াদবী করলে তার ক্ষমা নাই- তাকে কতল করা ওয়াজিব। অন্য কেউ ক্ষমা করার অধিকারী নয়। যার কাছে অপরাধী-তিনি ছাড়া অন্য কেউ ক্ষমা করতে পারে না। এ ব্যাপারে অনেক কাহিনি কিতাবে উল্লেখ আছে।
হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু জনৈক বেয়াদব হাফেয ইমামকে কতল করে ফেলেছিল- সে ফজরের নামাজে সব সময় সূরা আবাছা পাঠ করতো নবীজীকে হেয় করার উদ্দেশ্যে।
(সুত্রঃ-নূর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)।
মুনাফিক বিশরের পরিণাম।
অন্য বর্ণনায় এসেছে, এক ব্যক্তি তার নাম ছিল বিশর। সে মুসলমান দাবি করতো, হাক্বীক্বত সে ছিল মুনাফিক। এই মুনাফিক বিশরের সাথে এক ইহুদীর সাথে গন্ডগোল হয়ে যায়। যখন গন্ডগোল হয়ে গেল, তখন মুনাফিক বিশরকে ইহুদী বললো, হে বিশর এটার বিচার বা ফায়ছালা করতে হবে। কে বিচার করবেন? ইহুদী বললো, তোমাদের যিনি নবী ও রসূল, যিনি আখিরী নবী, নূরে মুজাসসাম,হুযূর পাক তিনি বিচার করবেন।
মুনাফিক বিশর মনে মনে চিন্তা করলো, নূরে মুজাসসাম, হুযূর পাক যদি বিচার করেন, উনি তো হক্ব বিচার করবেন, তাহলে ইহুদীর পক্ষে রায় চলে যাবে। তখন মুনাফিক বিশর বললো যে, না তুমি এক কাজ করো, তোমাদের যে বিচারক, কাব ইবনে আশরাফ অথবা আবু রফে ইহুদী রয়েছে তারা বিচার করবে। কিন্তু ইহুদী ব্যক্তি জানতো যে, কাব ইবনে আশরাফ অথবা আবু রফে যদি বিচার করে, তাহলে তারা মুনাফিকী করবে। হেরফের করবে, তারা ঘুষ খেয়ে পক্ষপাতিত্ব করবে। কারণ ইতিপূর্বেও তারা এমন অনেক করেছে যার নজির রয়েছে। তখন সেই ইহুদী বললো- না, নূরে মুজাসসাম হুযূর পাক বিচার করবেন।
এই কথা বলে মুনাফিক বিশরকে বুঝিয়ে নিয়ে গেল হুযূর পাকের কাছে। বিচার হয়ে গেল। হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিচার করলেন। মুনাফিক বিশরের বিরুদ্ধে ইহুদীর পক্ষে রায় পড়লো। মুনাফিক বিশর সেখানে তা বাহ্যিকভাবে মেনে নিলেও দরবার শরীফ থেকে বের হয়ে বললো, বিচারটা আমার মনঃপূত হচ্ছে না। নাউযুবিল্লাহ!
ইহুদী বললো, হে বিশর তুমি বলো কি? তোমাদের যিনি রসূল, যিনি আল আমীন উনার বিচার তোমার মনঃপূত হয়নি? তবে তুমি কার বিচার মানবে?
সেই যামানায় খলীফায়ে ছানী সাইয়্যিদুনা হযরত ফারূক্বে আ’যম রঃ বিচার করতেন। মুনাফিক বিশর সে মনে করলো যে, সাইয়্যিদুনা হযরত ফারূক্বে আ’যম রঃ খুব জালালী তবিয়ত। উনার প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক বলেন-
اشداء على الكفار,,,
অর্থাৎ “উনি কাফিরদের প্রতি কঠোর।” (সূরা ফাতহ, আয়াত ২৯)।
তিনি হয়তো আমার পক্ষেই রায় দিবেন এবং ইহুদী কাফির তার বিপক্ষে রায় দিবেন। মুনাফিক বিশর সে ইহুদীকে নিয়ে গেল সাইয়্যিদুনা হযরত উমর ইবনুল খাত্তাবের রঃ কাছে বিচারের জন্য। ইহুদী খুব চালাক ছিল, সে বললো, হে উমর ইবনুল খত্তাব রঃ এই বিশর আমাকে নিয়ে এসেছে আপনার কাছে বিচারের জন্য। অথচ আমরা এই মাত্র মহান আল্লাহ পাকের রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে নববী শরীফ থেকে আসলাম; তিনি নিজে বিচার করে দিয়েছেন। রায় আমার পক্ষে দেয়া হয়েছে। কিন্তু বিশর সে বিচার মানতে নারাজ; সেজন্য সে আমাকে আপনার কাছে নিয়ে এসেছে। পুনরায় বিচার করার জন্য। সাইয়্যিদুনা হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রঃ একথা শুনে বললেন, ঠিক আছে। তোমরা বস, আমি তোমাদের বিচার করবো।
উনি ঘরে প্রবেশ করলেন, ঘরে প্রবেশ করে একটা তরবারী নিয়ে আসলেন। তরবারী এনে মুনাফিক বিশরকে এক কোপে দু’ভাগ করে দিলেন এবং বললেন, এটাই তোমার বিচার।
কারণ, মহান আল্লাহ পাকের রসূল, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে বিচার করেছেন, সেটা তুমি মান নাই। তোমার একমাত্র শাস্তি ও বিচার হচ্ছে মৃত্যুদণ্ড।
যখন উনি তাকে হত্যা করে ফেললেন, তখন মুনাফিক বিশরের আত্মীয়-স্বজন নূরে মুজাসসাম হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে গিয়ে বললো, ইয়া রসূলাল্লাহ্, ইয়া হাবীবাল্লাহ! হযরত ফারূক্বে আ’যম রঃ কে আপনি বিচারের দায়িত্ব দিয়েছেন। উনি আমাদের একজন আত্মীয়কে হত্যা করে ফেলেছেন। মহান আল্লাহ পাকের রসূল হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, দেখ এটা কি করে সম্ভব? সাইয়্যিদুনা হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রঃ তো খাছ লোক-
لَوْ كَانَ بَعْدِي نَبِيٌّ لَكَانَ عُمَرَ بْنَ الْخَطَّابِ
“আমার পরে যদি কেউ নবী হতেন, তাহলে হযরত উমর ইবনুল খত্তাব নবী হতেন।” কাজেই উনার পক্ষে এটা সম্ভব নয়। ঠিক আছে উনাকে ডাকা হোক। সাইয়্যিদুনা হযরত উমর ইবনুল খত্তাব রঃ কে আনা হলো। হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “হে ফারূক্বে আ’যম রঃ! আপনি নাকি একজন মুসলমানকে হত্যা করেছেন?” সাইয়্যিদুনা হযরত ফারূক্বে আ’যম বললেন, ইয়া রসূলাল্লাহ্, ইয়া হাবীবাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! মূলতঃ আমি তাকে হত্যা করার কারণ হচ্ছে- সে মুনাফিকী করেছে। আপনি যে বিচার করেছিলেন, সে বিচার মানেনি, সেজন্য আমি তাকে হত্যা করেছি। হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “হে ফারূক্বে আ’যম রঃ! আপনি যাকে হত্যা করেছেন, সে যে মুনাফিকী করেছে, তার প্রমাণ কি?
কোথায় আপনার দলীল, আপনার সাক্ষী কোথায়?” যেহেতু ইসলামে সাক্ষী ছাড়া কোনো কথা গ্রহণযোগ্য নয়। সাইয়্যিদুনা হযরত উমর ইবনুল খত্তাব রঃ চুপ করে রইলেন। সাথে সাথে মহান আল্লাহ পাক স্বয়ং নিজে সাক্ষী হয়ে গেলেন। মহান আল্লাহ পাক উক্ত আয়াত শরীফ নাযিল করে দিলেন।
সূত্রঃ তাফসীরে জালালাইন শরীফ, ১/৮৪২।
তাফসীরে দুররে মানছুর , ২/৩২২।
তাফসীরে ইবনে কাছীর , ২/৪০২।
এ দ্বারা এ বিষয়ও প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহর রাসূলের আদেশ-
নিষেধ নির্দ্বিধায় মেনে নেয়া শুধু আচার অনুষ্ঠান কিংবা অধিকারের সাথেই সম্পৃক্ত নয়; আকীদা এবং অপরাপর বৈষয়িক বিষয়েও ব্যাপক। অতএব, কোন সময় কোন বিষয়ে পারস্পারিক মতবিরোধ দেখা দিলে বিবাদ পরিহার করে উভয় পক্ষকে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এবং তার অবর্তমানে তার প্রবর্তিত শরীআতের আশ্রয়ে গিয়ে মীমাংসা অন্বেষণ করা প্রতিটি মুসলিমের উপর ফরয।
Comments
Post a Comment