একটু সময় নিয়ে পড়ুন ইনশা আল্লাহ অনেক উপকৃত হবেন। ইসলামে ওযুর গুরুত্ব, ফরজ ও অযু ভঙ্গের কারণ সমূহঃ-
***************************************************
ইসলামি বিধান মতে অযু হল দেহের অঙ্গ-প্রতঙ্গ ধৌত করার মাধ্যমে পবিত্রতা অর্জনের একটি উত্তম পন্থা। যার মাধ্যমে পবিত্রতা অর্জন করা যায় এবং এর মাধ্যমে ইসলামের গুরুত্বপূর্ন ইবাদাত গুলোর মধ্যে বিশেষ করে নামাজ আদায় ও কুরআন তেলাওয়াত করা হয়। একজন মানুষ ঈমান আনার পর সর্বপ্রথম প্রধানতম কাজ হলো দৈনন্দিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া। এই নামাজের জন্য প্রয়োজন হয় পবিত্রতার। এই পবিত্রতা অর্জিত হয় দুইভাবে। (১) ওজু। (২) গোসল।
ওযুর গুরুত্বঃ-
নাযাম ও কুরআন তেলাওয়াত করার জন্য অবশ্যই পবিত্রতা অর্জন করা প্রয়োজন । কারণ পবিত্রতা ছাড়া আল্লাহ তাআলার কাছে নামায গৃহীত হবে না। এ সম্পর্কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন-
ﻻَ ﻳَﻘْﺒَﻞُ ﺍﻟﻠَّﻪُ ﺻَﻼَﺓَ ﺃَﺣَﺪِﻛُﻢْ ﺇِﺫَﺍ ﺃَﺣْﺪَﺙَ ﺣَﺘَّﻰ ﻳَﺘَﻮَﺿَّﺄَ,,,
“আল্লাহ তাআলা তোমাদের কারও নামায গ্রহণ করবেন না, যখন সে অপবিত্র হয়ে যায়, যতক্ষন না সে অযু করে। (বুখারী ও মুসলিম)।
অন্য এক হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী “নামাজকে বলা হয় জান্নাতের চাবি আর ওযুকে বলা হয় নামাজের চাবি”।
পবিত্র কোরানে আছে,
ﺇِﻥَّ ﺍﻟﻠَّﻪَ ﻳُﺤِﺐُّ ﺍﻟﺘَّﻮَّﺍﺑِﻴﻦَ ﻭَﻳُﺤِﺐُّ ﺍﻟْﻤُﺘَﻄَﻬِّﺮِﻳﻦَ,,,
“নিশ্চই আল্লাহ্ তওবাকারীকে ভালবাসেন এবং যাহারা পবিত্র থাকে তাদেরকেও ভালবাসেন।" (সূরা বাকারাঃ ২২২)।
অনুরূপভাবে কুরআন শরীফ পড়তে ও স্পর্শ করতেও অযুর প্রয়োজন হয়। পবিত্র কোরানে আছে।
لَّا يَمَسُّهٗۤ اِلَّا الۡمُطَهَّرُوۡنَؕ,,
“যাহারা পূত-পবিত্র তাহারা ব্যতীত অন্য কেহ তাহা স্পর্শ করো না।“[১] (সূরা ওয়াক্কিয়াহ্, আয়াত:৭৯)।
দেহ ও পরিধেয় কাপড়ের পবিত্রতা অর্জনকে বলা হয় তাহারাত্। অযু বা গোসলের মাধ্যমে সেই তাহারাত্ আর্জন করা যায়। হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) বলেন -
ﺍﻟﻄُّﻬُﻮﺭُ ﺷَﻄْﺮُ ﺍﻹِﻳﻤَﺎﻥِ “
“পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা ঈমানের অঙ্গ।“ (সহীহ মুসলিম)।
অতএব প্রত্যেকটা মুমিনের উচিৎ ওযু বা তাহারাত সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারনা রাখা ও সব সময় ওযু অবস্থায় থাকা।
অযু ও বিজ্ঞান সম্পর্কে বিস্তারিত.
অযুর ফরজ ফরজসমূহঃ-
ওযুর ফরজ সম্পর্কে আল কোরআনে বর্নিত আছে,
یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اِذَا قُمۡتُمۡ اِلَی الصَّلٰوۃِ فَاغۡسِلُوۡا وُجُوۡہَکُمۡ وَ اَیۡدِیَکُمۡ اِلَی الۡمَرَافِقِ وَ امۡسَحُوۡا بِرُءُوۡسِکُمۡ وَ اَرۡجُلَکُمۡ اِلَی الۡکَعۡبَیۡنِ ؕ وَ اِنۡ کُنۡتُمۡ جُنُبًا فَاطَّہَّرُوۡا ؕ,,
“হে মু’মিনগণ! যখন তোমরা সালাতের জন্য প্রস্তুত হবে তখন তোমরা তোমাদের মুখ ও হাতের কনূই পর্যন্ত ধৌত করে নিবে এবং তোমাদের মাথা মসেহ্ করবে এবং পা গ্রন্থি পর্যন্ত ধৌত করবে; যদি তোমরা আপবিত্র থাক। (সূরা মায়িদা, আয়াত:৬)।
১. মুখমন্ডল পরিপূর্ণ ধৌত করা।
২. দুই হাত কনূই পর্যন্ত ধৌত করা।
৩. মাথার এক চতুর্থাংশ মাসেহ করা (ভেজা হাত মাথায় বুলানো)।
৪. দুই পায়েরর টাখনু পর্যন্ত উত্তম রুপে ধৌত করা।
এ ফরজগুলি ছাড়াও আছে কিছু সুন্নাত ও মুস্তাহাব কাজ যার মাধ্যমে সুন্দরভাবে ওযু করা সম্ভব। তবে ফরজের কোন একটি কাজ বাদ পড়লে ওযু হবে না।
অযু ভঙ্গের কারণসমুহঃ-
কোন ব্যক্তি অযু করার পর কিছু নির্দিষ্ট কাজ না করলে তার অযু বলবৎ থাকে। কিন্তু ঐ কাজগুলো যখনই করা হয় তখনই অযু অকার্যকর হয়ে যায় যা অযু ভেঙ্গে হওয়াও বলে।
রাসুল(স:) বলেন,
রাসুল (সঃ) এরশাদ করেন-
ﻣَﻦْ ﺃَﺗَﻢَّ ﺍﻟْﻮُﺿُﻮﺀَ ﻛَﻤَﺎ ﺃَﻣَﺮَﻩُ ﺍﻟﻠَّﻪُ ﺗَﻌَﺎﻟَﻰ ﻓَﺎﻟﺼَّﻠﻮَﺍﺕُ ﺍﻟْﻤَﻜْﺘُﻮﺑَﺎﺕُ ﻛَﻔَّﺎﺭَﺍﺕٌ ﻟِﻤَﺎ ﺑَﻴْﻨَﻬُﻦَّ,,
‘মুসলমান যখন ফরয সালাত আদায়ের জন্য ওযু করে, পূর্ন মনোযোগ দিয়ে রুকু, সেজদা করে,তখন সেই ওযু,সালাত তার বিগত দিনের গুনাহের কাফফরা হিসাবে বিবেচিত হয়, তবে কবীরা গুনাহ ছাড়া। (মুসলিম)।
মৌলিকভাবে অযু ভঙ্গের কারণ ৭টি। যথাঃ-
১. পেশাব-পায়খানার রাস্তা দিয়ে কোনো কিছু বের হওয়া। যেমন বায়ু, পেশাব পায়খানা, পোকা ইত্যাদি। (হেদায়া-১/৭) এর দলিল হল, আল্লাহ তাআলা বলেন,
أَوْ جَاءَ أَحَدٌ مِّنكُم مِّنَ الْغَائِطِ,,,
তোমাদের কেউ প্রসাব-পায়খানা সেরে আসে [তাহলে নামায পড়তে পবিত্রতা অর্জন করে নাও]। (সূরা মায়িদা ৬)।
আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাযি. থেকে বর্ণিত, নিশ্চয় রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,
إِنَّمَا الْوُضُوءُ مِمَّا خَرَجَ ، وَلَيْسَ مِمَّا دَخَلَ,,,
শরীর থেকে যা কিছু বের হয় এ কারণে অযু ভেঙ্গে যায়, প্রবেশের দ্বারা ভঙ্গ হয় না। (সুনানে কুবরা লিলবায়হাকী ৫৬৮)
২. রক্ত, পূঁজ, বা পানি বের হয়ে গড়িয়ে পড়া। (হেদায়া-১/১০)
এর দলিল হল,
أَنَّ عَبْدَ اللهِ بْنَ عُمَرَ كَانَ إِذَا رَعَفَ، انْصَرَفَ فَتَوَضَّأَ,,,
আব্দুল্লাহ বিন উমর রাযি.-এর যখন নাক দিয়ে রক্ত ঝরতো, তখন তিনি ফিরে গিয়ে অযু করে নিতেন। (মুয়াত্তা মালিক ১১০)।
عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عُمَرَ أَنَّهُ كَانَ يُفْتِي الرَّجُلَ إِذَا رَعَفَ فِي الصَّلَاةِ، أَوْ ذَرَعَهُ قَيْءٌ، أَوْ وَجَدَ مَذِيًّا أَنْ يَنْصَرِفَ فَيَتَوَضَّأُ,,,
আব্দুল্লাহ বিন উমর রাযি. থেকে বর্ণিত। তিনি যদি কারো নামাযরত অবস্থায় নাক দিয়ে রক্ত ঝড়তো, বা বমি হতো, বা মজি বের হতো তাহলে তাকে ফিরে গিয়ে অযু করার ফাতওয়া প্রদান করতেন। (মুসান্নাফ আব্দুর রাজ্জাক ৩৬১০)
৩. মুখ ভর্তি বমি অর্থাৎ বেশি পরিমাণে বমি হলে। এর দলিল হল,
আয়েশা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,
مَنْ أَصَابَهُ قَيْءٌ أَوْ رُعَافٌ أَوْ قَلَسٌ أَوْ مَذْيٌ، فَلْيَنْصَرِفْ، فَلْيَتَوَضَّأْ,,,
যে ব্যক্তির বমি হয়, অথবা নাক দিয়ে রক্ত ঝরে, বা মজি বের হয়, তাহলে ফিরে গিয়ে অযু করে নিবে। (সুনানে ইবনে মাজাহ ১২২১)
مُغِيرَةُ، عَنْ إِبْرَاهِيمَ، قَالَ: سَأَلْتُهُ عَنِ الْقَلْسِ، فَقَالَ: ذَلِكَ الرَّسْعُ، إِذَا ظَهَرَ فَفِيهِ الْوُضُوءُ,,,
ইবরাহীম নাখয়ী রহ.-কে বমির ব্যপারে জিজ্ঞাসা করলেন মুগীরাহ রহ.। তখন তিনি উত্তরে বললেন, যদি তা মুখ ভরে হয়, তাহলে অযু করতে হবে। (মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা ৪৩৩)
৪. থুথুর সঙ্গে রক্তের ভাগ সমান বা বেশি হওয়া। এর দলিল হল,
عَنِ الْحَسَنِ فِي رَجُلٍ بَزَقَ فَرَأَى فِي بُزَاقِهِ دَمًا، أَنَّهُ لَمْ يَرَ ذَلِكَ شَيْئًا حَتَّى يَكُونَ دَمًا غَلِيظًا، يَعْنِي فِي الْبُزَاقِ,,,
হাসান বসরী রহ. বলেন, যে ব্যক্তি তার থুথুতে রক্ত দেখে তাহলে থুথুতে রক্ত প্রবল না হলে তার উপর অযু করা আবশ্যক হয় না। (মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা ১৩৩০)।
عَنْ إِبْرَاهِيمَ فِي الرَّجُلِ يَبْزُقُ فَيَكُونُ فِي بُزَاقِهِ الدَّمُ، قَالَ: إِذَا غَلَبَتِ الْحُمْرَةُ الْبَيَاضَ تَوَضَّأَ، وَإِذَا غَلَبَ الْبَيَاضُ الْحُمْرَةَ لَمْ يَتَوَضَّأْ,,,
ইবরাহীম নাখয়ী রহ. বলেন, যে ব্যক্তি তার থুথুতে রক্ত দেখে, তাহলে সাদার উপর লাল রঙ বেশি থাকে, তাহলে অযু করবে, আর যদি লালের উপর সাদার আধিপত্য থাকে, তাহলে অযু লাগবে না। (মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা ১৩৩২)
عَنِ ابْنِ سِيرِينَ فِي الرَّجُلِ يَبْصُقُ دَمًا قَالَ: إِنْ كَانَ الْغَالِبُ عَلَيْهِ الدَّمُ تَوَضَّأَ,
ইবনে সীরীন রহ. বলেন, যদি থুথুতে রক্তের আধিক্য হয়, তাহলে অযু করা আবশ্যক। (মুসান্নাফ আব্দুর রাজ্জাক ৫৬০)।
৫. ঘুমানো- চিৎ হয়ে; কাত হয়ে; হেলান দিয়ে কিংবা কোনো কিছুর সঙ্গে ঠেস দিয়ে ঘুমালে যা সরিয়ে ফেললে ঘুমন্ত ব্যক্তি পড়ে যাবে। এর দলিল হল, ইবনে আব্বাস রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,
لَيْسَ عَلَى مَنْ نَامَ سَاجِدًا وُضُوءٌ، حَتَّى يَضْطَجِعَ، فَإِنَّهُ إِذَا اضْطَجَعَ، اسْتَرْخَتْ مَفَاصِلُهُ,,,
সেজদা অবস্থায় ঘুমালে অযু ভঙ্গ হয় না, তবে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লে ভেঙ্গে যাবে, কেননা, চিৎ বা কাত হয়ে শুয়ে পড়লে শরীর ঢিলে হয়ে যায়। [ফলে বাতকর্ম হয়ে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে]। (মুসনাদে আহমাদ ২৩১৫ আবু দাউদ ২০২)।
৬.পাগল, মাতাল বা অচেতন হলে। এর দলিল হল,
عَنْ حَمَّادٍ قَالَ: إِذَا أَفَاقَ الْمَجْنُونُ تَوَضَّأَ وُضُوءَهُ لِلصَّلَاةِ,,,
হাম্মাদ রহ. বলেন, যখন পাগল ব্যক্তি সুস্থ হয়, তখন নামাযের জন্য তার অযু করতে হবে। (মুসান্নাফ আব্দুর রাজ্জাক ৪৯৩)।
৭. নামাযে উচ্চস্বরে হাসি দিলে। এর দলিল হল, ইমরান বিন হুসাইন রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ ﷺ-কে বলতে শুনেছি যে,
مَنْ ضَحِكَ فِي الصَّلَاةِ قَرْقَرَةً ، فَلْيُعِدِ الْوُضُوءَ وَالصَّلَاةَ,,,
যে ব্যক্তি নামাজে উচ্চস্বরে হাসে, সে ব্যক্তি অজু ও নামাজ পুনরায় আদায় করবে। হাসান বিন কুতাইবা রহ. বলেন,
إِذَا قَهْقَهَ الرَّجُلُ أَعَادَ الْوُضُوءَ وَالصَّلَاةَ,,,
যখন কোনো ব্যক্তি উচ্চস্বরে হাসি দেয়, সে ব্যক্তি অজু ও নামাজ পুনরায় আদায় করবে। (সুনানে দারা কুতনি ১/১৫৬)।
৮. কেউ কেউ বলেন, পুরুষ ও মহিলার গুপ্তাঙ্গ কোনো পর্দা বা অন্তরায় ব্যতিত একত্রিত হলে; বীর্যপাত হোক বা নাই হোক ওজু নষ্ট হবে।
والله اعلم بالصواب,,,
Comments
Post a Comment