বিবর্তনবাদ মিথ্যাঃ মানবজাতী এক আদিমাতার সন্তান।

 মানুষ কি বানর থেকে রুপান্তরিত নাকি এক আদিমাতার সন্তানঃ-

********************************************

মানুষ এক আজব সৃষ্টি আশরাফুল মাখলুকাত। আল্লাহ তায়ালা তার স্রষ্টা। কুরআন মাজীদে কত স্পষ্টভাবেই না এ সত্য বর্ণনা করা  হয়েছে। মানুষের কর্তব্য, আপন স্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা এবং তাঁর নৈকট্য অন্বেষণ করা। আল্লাহ তায়ালা বলেন, 

وَهُوَ الَّذِي أَنشَأَكُم مِّن نَّفْسٍ وَاحِدَةٍ فَمُسْتَقَرٌّ وَمُسْتَوْدَعٌ ۗ قَدْ فَصَّلْنَا الْآيَاتِ لِقَوْمٍ يَفْقَهُونَ,,,

আর তিনিই তোমাদেরকে একই ব্যাক্তি থেকে সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর রয়েছে দির্ঘ ও স্বল্পকালীন বাসস্থান। অবশ্যই আমি অনুধাবনকারী সম্প্রদায়ের জন্য আয়াতসমূহ বিশদভাবে বর্ণনা করেছি। সূরা আনআম, আয়াত ৯৮।

কুরআনুল কারীমের এক আয়াত দ্বারাও এ উক্তির অগ্রগণ্যতা বুঝা যায়। যেখানে বলা হয়েছে, (لَتَرْكَبُنَّ طَبَقًا عَنْ طَبَقٍ) -অর্থাৎ তোমরা সর্বদা এক স্তর থেকে অন্য স্তরে আরোহণ করতে থাকবে। [সূরা আল-ইনশিকাক্ব-২০] 

এর সারমর্ম এই যে, আখেরাতের পূর্বে মানুষ সমগ্র জীবনে একজন মুসাফিরসদৃশ। বাহ্যিক স্থিরতা ও অবস্থিতির সময়ও প্রকৃতপক্ষে সে জীবন-সফরের বিভিন্ন মনযিল অতিক্রম করতে থাকে।

পৃথিবীর সব কিছু সৃষ্টির মূল উপাদান হচ্ছে পানি। এই মৌলিক উপাদান পৃথিবীর সব জীবদেহের মধ্যে বিদ্যমান। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন,

أَوَلَمْ يَرَ الَّذِينَ كَفَرُوا أَنَّ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ كَانَتَا رَتْقًا فَفَتَقْنَاهُمَا ۖ وَجَعَلْنَا مِنَ الْمَاءِ كُلَّ شَيْءٍ حَيٍّ ۖ أَفَلَا يُؤْمِنُونَ,,,

অর্থঃ- কাফেররা কি ভেবে দেখে না যে, আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর মুখ বন্ধ ছিল, অতঃপর আমি উভয়কে খুলে দিলাম এবং প্রাণবন্ত সবকিছু আমি পানি থেকে সৃষ্টি করলাম। এরপরও কি তারা বিশ্বাস স্থাপন করবে না? সূরা আম্বিয়া, আয়াত-৩০।

জীববিজ্ঞানের মতে, সাগরের অভ্যন্তরের পানিতে যে প্রটোপ্লাজম বা জীবনের আদিম মূলীভূত উপাদান রয়েছে তা থেকেই সব জীবের সৃষ্টি। আবার সব জীবদেহ কোষ দ্বারা গঠিত। আর এই কোষ গঠনের মূল উপাদান হচ্ছে পানি। ভিন্নমতে, পানি অর্থ শুক্র। (কুরতুবি)।

আসুন, আমরা আদি মানব-মানবী ও তাদের সন্তান সৃষ্টির পূর্ব ও পরের রহস্য নিয়ে নিম্নে আলোকপাত করার প্রয়াস পাব, ইনশাআল্লাহ।

মানব সৃষ্টির আদি কথাঃ-

আদি পিতা আদম (আ.)-এর সৃষ্টি নিয়ে বিভিন্ন বস্তুবাদী গবেষক, দার্শনিক নানা বক্তব্য-বিবৃতি দিয়েছেন। যেমন—আদি মানব সম্প্রদায় বানর ছিল! কালের আবর্তনে পর্যায়ক্রমে বানর থেকে মানবে রূপান্তরিত হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, বর্তমান যুগে কি বিশ্বের কোথাও একটি বানর মানবে রূপান্তরিত হয়ে জীবন যাপন করছে? কিংবা কোনো বানরের গর্ভ থেকে মানব সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়েছে ও বেঁচে আছে এরকম কোন উদাহরণ আছে কিনা?

এর জবাব হলো নেতিবাচক। এটা সকলের জানা। আদি মানব কী বস্তু থেকে সৃষ্টি তা মহাগ্রন্থ আল-কোরআনে মহান আল্লাহ স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেছেন যে

 الَّذِیۡۤ اَحۡسَنَ کُلَّ شَیۡءٍ خَلَقَہٗ وَ بَدَاَ خَلۡقَ الۡاِنۡسَانِ مِنۡ طِیۡنٍ ۚ﴿۷

যিনি তাঁর প্রত্যেকটি সৃষ্টিকে উত্তমরূপে সৃজন করেছেন এবং মাটি হতে মানব-সৃষ্টির সূচনা করেছেন। (সুরা সাজদাহ, আয়াতঃ-৭)। অন্য আয়াতে এসেছে,  

وَلَقَدْ خَلَقْنَا الإِنسَانَ مِن صَلْصَالٍ مِّنْ حَمَإٍ مَّسْنُونٍ

আমি মানবকে পচা কর্দম থেকে তৈরী শুস্ক ঠনঠনে মাটি দ্বারা সৃষ্টি করেছি। (সুরা হিজর, আয়াতঃ ২৬)। অন্য আয়াতে এসেছে, 

خَلَقَ الْإِنْسَانَ مِنْ صَلْصَالٍ كَالْفَخَّارِ,,,

পোড়া মাটির মতো শুষ্ক মাটি থেকে (মানুষকে) সৃষ্টি করেছি।’ (সুরা আর-রহমান, আয়াত: ১৪)।

আল্লাহ্‌ চারটি জিনিসকে তাঁর নিজ হাতে সৃষ্টি করেছেনঃ-

সহিহ সনদে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রাঃ) থেকে উল্লেখ করেছেন যে, তিনি বলেন: "আল্লাহ্‌ চারটি জিনিসকে নিজ হাতে সৃষ্টি করেছেন: আরশে আজীম, কলম, আন্নাতুল আদন(জান্নাত) ও আদম (আঃ)। এরপর অন্যসব সৃষ্টিকে লক্ষ্য করে বলেন: হও; তখন তারা হয়ে যায়।"

অথচ আল্লাহ তায়ালা হযরত আদমকে নিজ হাতে সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, 

قَالَ يَا إِبْلِيسُ مَا مَنَعَكَ أَنْ تَسْجُدَ لِمَا خَلَقْتُ بِيَدَيَّ أَسْتَكْبَرْتَ أَمْ كُنْتَ مِنَ الْعَالِينَ, قَالَ أَنَا خَيْرٌ مِنْهُ خَلَقْتَنِي مِنْ نَارٍ وَخَلَقْتَهُ مِنْ طِينٍ,,

(আল্লাহ) বললেন, হে ইবলীস! আমি (নিজে আমার কুদরতি) হাতে যাকে সৃষ্টি করেছি, তার সম্মুখে সেজদা করতে তোকে কিসে বাধা দিল? তুমি অহংকার করলে, নাকি তুমি তার চেয়ে উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন?” “সে বলল: আমি তার চেয়ে উত্তম; আপনি আমাকে আগুন দ্বারা সৃষ্টি করেছেন, আর তাকে সৃষ্টি করেছেন মাটি দ্বারা। ’(সুরা সোয়াদ, আয়াত: ৭৫,৭৬)।

এখানে ঈসা (আ.)-এর জন্ম সম্পর্কে প্রশ্ন হতে পারে, কিন্তু মহান আল্লাহ এ প্রশ্নের সমাধান পবিত্র কোরআনে যথাযথভাবে দিয়েছেন। তিনি বলেন,

إِنَّ مَثَلَ عِيسَى عِنْدَ اللَّهِ كَمَثَلِ آَدَمَ خَلَقَهُ مِنْ تُرَابٍ ثُمَّ قَالَ لَهُ كُنْ فَيَكُونُ,,,

"আল্লাহর কাছে ঈসাকে সৃষ্টির পদ্ধতি আদম সৃষ্টির মতই। আল্লাহ আদমকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছিলেন। তারপর তাকে বলেছিলেন ‘হও' ফলে সে হয়ে গেল।"(সূরা আলে ইমরান)।

একবার মদীনায় একদল খ্রিস্টান ইসলামের নবীজীর সঙ্গে সাক্ষাত করতে এল। তারা পিতা ছাড়া হযরত ঈসার জন্ম হওয়াকে তাঁদের খোদা হবার প্রমাণ বলে উল্লেখ করল। এ সময় উপরোক্ত কোরআনের এই আয়াত নাজেল হয়।

রাসুল (সা.) তাদেরকে বললেন- যদি পিতা ছাড়া জন্ম হওয়াটা কোন মানুষের জন্য খোদা হবার প্রমাণ হয়, তাহলে তো আদমের সৃষ্টি আরো গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, তার পিতাও ছিল না, মাতাও ছিল না। তাই আপনারা আদমকে কেন খোদার সন্তান বা খোদা মনে করেন না?

ডারউইনের বিবর্তবাদঃ একটি মিথ্যা মতবাদ!!!

প্রচলিত নাস্তিকদের একটি অংশ এই ডারউনের বিবর্তবাদে বিশ্বাসী হয়ে নিজেকে বানরের জাত মনে করে থাকে। তো যারা নিজেকে বানরের জাত মনে করে তারা তো বানরের মতই হবে। চিড়িয়াখানায় বানরগুলো সর্বদা অস্থির, মানুষ যা কিছু দেয় তা-ই খেয়ে নেয়। তো যারা নিজেদেরকে বানরের জাতি হিসেবে দেখে সেই মানুষগুলোও বানরের মত সকল ভ্রান্ত, অপ্রমাণিত, অযৌক্তিক ফালতু মতবাদে বিশ্বাসী হয়ে নাস্কিকতার মতো চরম মূর্খতার পথে চলে।

আসুন বিবর্তনবাদের বিষয়ে কিছু কথা বলি। প্রথমেই বলা যায় বিবর্তনবাদ তথা বানর টু মানুষ পর্যন্ত এসে থেমে গেল কেন? আপনারা কি জবাব দিবেন? বিবর্তনবাদ যদি চলমান প্রক্রিয়া হয়ে থাকে তবে মানুষগুলো আস্তে আস্তে অন্য প্রাণীতে রুপান্তরিত হতে থাকবে, চলমান প্রক্রিয়া।

আরো দেখার বিষয় এই বিবর্তনবাদ শুধু বানর টু মানুষ কেন হবে। এটা তো সকল প্রাণীর ক্ষেত্রেই হওয়া উচিত নয় কি?

ধরে নিলাম আপনারা বললেন যে প্রকৃতির চাওয়া ছিল বিবর্তমান বানর টু মানুষ-এ এসে থেমে যাবে। তাহলে পরে তো মেনে নিচ্ছেন যে কেউ প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করছেন। 

আজ কত কতদিন হয়ে গেল মানুষ পৃথিবীতে মজা লুটছে। বিপরীতে বানরগুলো এখনো জঙ্গলে বানরই থাকলো। তো বাকি বানরগুলোর কি অপরাধ যে তারা মানুষ হতে পারলো না। 

তো তখন হতে পারেনি বলেকি পরেও হতে পারবেনা এমন কি হতে পারে? অন্তত বর্তমান বানরের রুপ কিছুটা হলেও তো মানুষে রুপান্তর হতে দেখা যেতো। পাশাপাশি মানুষ বিবর্তনের চক্রে হয় পুনরায় বানর বা ভিন্ন জাতিতে রুপান্তর হওয়া উচিত। এসবের কিছুই প্রকৃতিতে দেখা যাচেছনা তারপরও কিভাবে এমন গাজাখুরী বিবর্তনবাদে নাস্তিকরা দৃঢ় বিশ্বাস রাখেন আর মনগড়া ব্যাখ্যা দাড় করিয়ে বেড়াচ্ছেন।

অতি সহজ বিষয় হলো স্বেচ্ছাচারী জীবন-যাপনের জন্য অতি সহজ পদ্ধতি হলো নাস্তিকতার চর্চা। এটাই ইবলিশ মানুষের দ্বারা করিয়ে জাহান্নামের পথে এগিয়ে নিয়ে যাচেছ। জ্ঞানীরা যদি একটু ভাবত, কতইনা ভাল হতো।

বিশিষ্ট নাস্তিক্যবাদী দারশনিক ম্যালকম মাগারিজ বলেন- "আমার নিজের  দৃঢ় বিশ্বাস, বিবর্তন তত্ত, বিশেষত তত্তটির যতখানি প্রয়োগ করা হয়েছে, ভবিষ্যতের ইতিহাস বইগুলোতে এক বিরাট পরিহাসরুপেই পরিগণিত হবে। 

এরকম একটা তুচ্ছ, যুক্তিহীন ও সন্দেহজনক তত্ত এমন অবিশ্বাস্য রকমের বিশ্বাসযোগ্যতা কিভাবে পেয়েছিল একথা ভেবে হতবাক হয়ে যাবে ভবিষ্যতের মানুষ।"

(Malclom Muggeridge, the end of the christendom,Grand Rapids:Eerdmans,1980,p 43).

আদম (আ.) মাটির সারাংশ থেকে সৃষ্টি। কিন্তু মা হাওয়া (আ.) কী দিয়ে সৃষ্টি? পৃথিবীতে প্রথম মানব আদম (আ.) মাটি থেকে এবং প্রথম মানবী হাওয়া (আ.) আদমের পাঁজরের বাঁকা হাড় থেকে সৃষ্টি। এতদ্ব্যতীত সকল মানব-মানবী এক ফোঁটা অপবিত্র তরল পদার্থ (বীর্য) থেকে অদ্যাবধি সৃষ্টি হয়ে চলেছে।

মহান আল্লাহ আদম (আ.)-এর পাঁজরের বাঁকা হাড় থেকে মা হাওয়াকে সৃষ্টি করেছেন। এ বিষয়ে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ الْمَرْأَةُ كَالضِّلَعِ إِنْ أَقَمْتَهَا كَسَرْتَهَا وَإِنْ اسْتَمْتَعْتَ بِهَا اسْتَمْتَعْتَ بِهَا وَفِيهَا, عِوَجٌ.

আবূ  হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, নারীরা হচ্ছে পাঁজরের হাড়ের ন্যায়। যদি একেবারে সোজা করতে চাও, তাহলে ভেঙ্গে যাবে। সুতরাং, যদি তোমরা তাদের থেকে উপকার লাভ করতে চাও, তাহলে ঐ বাঁকা অবস্থাতেই লাভ করতে হবে। সহিহ বুখারী, হাদিস নং ৫১৮৪

وَاسْتَوْصُوا بِالنِّسَاءِ خَيْرًا فَإِنَّهُنَّ خُلِقْنَ مِنْ ضِلَعٍ وَإِنَّ أَعْوَجَ شَيْءٍ فِي الضِّلَعِ أَعْلاَه“ فَإِنْ ذَهَبْتَ تُقِيمُه“ كَسَرْتَه“ وَإِنْ تَرَكْتَه“ لَمْ يَزَلْ أَعْوَجَ فَاسْتَوْصُوا بِالنِّسَاءِ خَيْرًا.

বর্ণনাকারী থেকে আরও বর্ণিত, আর তোমরা নারীদের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করবে। কেননা, তাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে পাঁজরার হাড় থেকে এবং সবচেয়ে বাঁকা হচ্ছে পাঁজরার ওপরের হাড়। যদি তা সোজা করতে যাও, তাহলে ভেঙ্গে যাবে। আর যদি তা যেভাবে আছে সেভাবে রেখে দাও তাহলে বাঁকাই থাকবে। অতএব, তোমাদেরকে ওসীয়ত করা হলো নারীদের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করার জন্য।(আধুনিক প্রকাশনী- ৪৮০৪, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৪৮০৭)। সহিহ বুখারী, হাদিস নং ৫১৮৬।

এভাবে আজও মানব বংশবিস্তার অব্যাহত আছে বিবাহ-বন্ধন ও স্বামী-স্ত্রীর মিলন ব্যবস্থার মাধ্যমে, যাতে মহান আল্লাহর মহৎ উদ্দেশ্য সফল হয়। আল্লাহ তায়ালা আরও বলেন,

﴿يٰۤاَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُوۡا رَبَّكُمُ الَّذِىۡ خَلَقَكُمۡ مِّنۡ نَّفۡسٍ وَّاحِدَةٍ وَّخَلَقَ مِنۡهَا زَوۡجَهَا وَبَثَّ مِنۡهُمَا رِجَالاً كَثِيۡرًا وَّنِسَآءً‌ۚ,,,

হে মানব জাতি! তোমাদের রবকে ভয় করো। তিনি তোমাদের সৃষ্টি করেছেন একটি প্রাণ থেকে। আর সেই একই প্রাণ থেকে সৃষ্টি করেছেন তার জোড়া। তারপর তাদের দু’জনার থেকে সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে দিয়েছেন বহু পুরুষ ও নারী। সূরা নিসা,আয়াত-১।

এই আয়াতে একদিকে আল্লাহকে ভয় করার ও তাঁর অসন্তোষ থেকে আত্মরক্ষার জন্য জোর তাগীদ করা হয়েছে এবং অন্যদিকে একথা মনের মধ্যে গেঁথে দেয়া হয়েছে যে, একজন মানুষ থেকে সমস্ত মানুষের উৎপত্তি এবং রক্ত-মাংস ও শারীরিক উপাদানের দিক দিয়ে তারা প্রত্যেকে প্রত্যেকের অংশ।

“তোমাদের একটি প্রাণ থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে।” অর্থাৎ প্রথমে এক ব্যক্তি থেকে মানব জাতির সৃষ্টি করেন।

অন্যত্র কুরআন নিজেই এর ব্যাখ্যা করে বলেছে যে, সেই প্রথম ব্যক্তি ছিলেন হযরত আদম আলাইহিস সালাম। তাঁর থেকেই এ দুনিয়ায় মানব জাতীর বংশ বিস্তার লাভ করে।

“সেই একই প্রাণ থেকে সৃষ্টি করেছেন তার জোড়া।” এ বিষয়টির বিস্তারিত জ্ঞান আমাদের কাছে নেই। সাধারণভাবে কুরআনের তাফসীরকারগণ যা বর্ণনা করেন তা হচ্ছে নিম্নরূপঃ আদমের পাঁজর থেকে হাওয়াকে সৃষ্টি করা হয়েছে। অথবা ডান দিকের ত্রয়োদশ হাড় থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। কিন্তু কুরআন মজীদ এ ব্যাপারে নীরব। আর এর সপক্ষে যে হাদীসটি পেশ করা হয় তার অর্থ লোকেরা যা মনে করে নিয়েছে তা নয়। কাজেই কথাটিকে আল্লাহ‌ যেভাবে সংক্ষিপ্ত ও অস্পষ্ট রেখেছেন তেমনি রেখে এর বিস্তারিত অবস্থান জানার জন্য সময় নষ্ট না করাই ভালো। আল্লাহ তায়ালা বলেন, 

وَمِنْ آَيَاتِهِ أَنْ خَلَقَ لَكُمْ مِنْ أَنْفُسِكُمْ أَزْوَاجًا لِتَسْكُنُوا إِلَيْهَا وَجَعَلَ بَيْنَكُمْ مَوَدَّةً وَرَحْمَةً إِنَّ فِي ذَلِكَ لَآَيَاتٍ لِقَوْمٍ يَتَفَكَّرُونَ,,

"এবং তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে আর এক নিদর্শন (হচ্ছে): তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য হতে তোমাদের সঙ্গিনীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা ওদের নিকট শান্তি পাও এবং তিনি তোমাদের মধ্যে ভালোবাসা ও সহানুভূতি সৃষ্টি করেছেন; নিশ্চয় চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য এতে নিদর্শন আছে।" (৩০:২১)।

মানুষ সৃষ্টির রহস্যের কথা বর্ণনা করার পর এই আয়াতে দাম্পত্য জীবন সংক্রান্ত অলৌকিক নিদর্শনের কথা উল্লেখ করতে গিয়ে মহান আল্লাহ বলছেন: পৃথিবীতে প্রত্যেক মানুষের জন্য আমি সঙ্গী বা সঙ্গিনী সৃষ্টি করেছি যাতে জীবন চলার পথে তোমরা একাকীত্বে না ভোগো এবং তাদের কাছে শান্তি ও সুখ পাও। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে এই মধুময় সম্পর্ক তৈরি হয়েছে আল্লাহর পক্ষ থেকে দেয়া পারস্পরিক ভালোবাসা ও আকর্ষণের কারণে। এই ভালোবাসার কারণে তারা সারাজীবন পরস্পরের প্রতি নির্ভরশীল থাকে। স্বামী-স্ত্রীর পরস্পরের প্রতি এই মধুর সম্পর্কের ফলস্বরূপ ধরার বুকে মানবপ্রজন্ম টিকে রয়েছে হাজার হাজার বছর ধরে। এ ছাড়া, ছোট ছোট দাম্পত্য জীবনের সমষ্টিতে সমাজ গড়ে ওঠে এবং সমাজবদ্ধ জীব হিসেবে মানুষ সুখে-শান্তিতে জীবন কাটায়। সূরা হুজুরাতের বিখ্যাত আয়াত-

يَاأَيُّهَا النَّاسُ إِنَّا خَلَقْنَاكُمْ مِنْ ذَكَرٍ وَأُنْثَى وَجَعَلْنَاكُمْ شُعُوبًا وَقَبَائِلَ لِتَعَارَفُوا إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ إِنَّ اللَّهَ عَلِيمٌ خَبِيرٌ,

হে মানুষ! আমি তোমাদের সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ ও এক নারী হতে; পরে তোমাদের বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে, যাতে তোমরা একে অপরের সাথে পরিচিত হতে পার। তোমাদের মধ্যে আল্লাহর নিকট সেই অধিক মর্যাদাসম্পন্ন যে তোমাদের মধ্যে অধিক মুত্তাকী। নিশ্চয় আল্লাহ সকল কিছু জানেন, সমস্ত খবর রাখেন। সূরা হুজুরাত: ১৩।

আল্লাহ তাআলা আরো জানিয়েছেন, মানুষকে তিনি সৃষ্টি করেছেন এক নর ও এক নারী থেকে। সুতরাং সকল মানুষ শত বৈচিত্র্য সত্ত্বেও একই বংশের, একই মা-বাবার সন্তান। আর আল্লাহর কাছে শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি হল তাকওয়া। এজন্য আল্লাহ তায়ালা বলেন, 

يَاأَيُّهَا النَّاسُ اعْبُدُوا رَبَّكُمُ الَّذِي خَلَقَكُمْ وَالَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ,,

হে মানুষ! তোমাদের রবের ইবাদত কর, যিনি তোমাদের ও তোমাদের পূর্ববর্তীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা আত্মরক্ষা করতে পার। সূরা বাকারা: ২১-২২।

অথচ আল্লাহর ঘোষণা ভুলে মানুষ কত বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছে এবং জাতপাতের কত ব্যবধান রচনা করেছে! প্রজন্মের পর প্রজন্ম এই বিভেদ-বিভ্রান্তিকেই সত্য মনে করে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছে। অবশেষে ঐ সত্যের দিকেই মানুষকে প্রত্যাবর্তন করতে হচ্ছে যা মহাজ্ঞানী আল্লাহ স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছিলেন। আরো ইরশাদ হয়েছে, 

كَيْفَ تَكْفُرُونَ بِاللَّهِ وَكُنْتُمْ أَمْوَاتًا فَأَحْيَاكُمْ ثُمَّ يُمِيتُكُمْ ثُمَّ يُحْيِيكُمْ ثُمَّ إِلَيْهِ تُرْجَعُونَ,

তোমরা কীভাবে আল্লাহকে অস্বীকার কর? অথচ তোমরা ছিলে প্রাণহীন, তিনি তোমাদের জীবন্ত করেছেন, আবার তোমাদের মৃত্যু ঘটাবেন ও পুনরায় জীবন্ত করবেন। পরিশেষে তাঁর দিকেই তোমাদের ফিরিয়ে আনা হবে। সূরা বাকারা ২: ২৮।

 এখানেই মুমিনের জিত, ঈমানের মাহাত্ম্য। যে মহা সত্য ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে উদঘাটন করা সম্ভব নয়, কিংবা যা উদঘাটনে এক মানবপ্রজন্ম যথেষ্ট নয় মুমিন তার রবের উপর বিশ্বাস রেখে প্রথম দিনেই তার সন্ধান পেয়ে যায়। এরপর তার অবশিষ্ট জীবন সেই সত্যের আলোকে পরিচালিত হয়। এ সৌভাগ্যের কি কোনো তুলনা হতে পারে!

এখানে আরও একটি বিষয় মনে রাখতে হবে যে, বিজ্ঞানের অনেক সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত কিছু নয়। আজ বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত আসছে, কাল তা বাতিল হয়ে যাচ্ছে। আবার বহু বিষয়ে খোদ বিজ্ঞানীদের মধ্যেই মতভেদ আছে। এসকল বাস্তবতা সামনে রেখেই বিজ্ঞানের সিদ্ধান্তকে মূল্যায়ন করতে হবে। বিজ্ঞানের সঠিক সিদ্ধান্ত কখনো কুরআনের বর্ণনার বিরোধী হতে পারে না। কারণ কুরআন আল্লাহ রাববুল আলামীনের কালাম।

জাগতিক শিক্ষায় শিক্ষিত বন্ধুগণ যদি সচেতন হন, তাহলে তারা তাদের নিজস্ব বিষয়বস্তু দ্বারাও ইসলামের খেদমত করতে পারেন। এমনকি তাদের অধীত বিদ্যার দ্বারাও ‘ইসলামী’ সাহিত্য তৈরি হতে পারে। তা না করে প্রত্যেকেই যদি কুরআন-হাদীসের ব্যাখ্যা, ও শরীয়তের বিধি-বিধান সম্পর্কে ‘গবেষণা’র দায়িত্ব নিয়ে নিতে চান তাহলে একদিকে এ অঙ্গনে অরাজকতার সৃষ্টি হয়, অন্যদিকে অন্যান্য ক্ষেত্রের সেবা থেকে, যা তাদের পক্ষে সম্ভবপর ছিল এবং যার প্রয়োজনও ছিল, তা থেকে ব্যক্তি নিজেও বঞ্চিত হন, অন্যদেরও বঞ্চিত করেন। তাই যোগ্য ও উদ্যমী বন্ধুদের কর্তব্য, নিজ নিজ অধ্যয়ন, অভিজ্ঞতা ও বিশেষজ্ঞতার সীমানার ভেতরে থেকে দ্বীনী খেদমতের ও ‘ইসলামী’ সাহিত্য সৃষ্টির চেষ্টায় আত্মনিয়োগ করা। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সকলকে বুঝার তৌফিক দান করুন। 


Comments