কোরান-হাদীসের আলোকে জিকিরের পরিচিতি ও গুরুত্ব। [প্রথম অংশ ]

পবিত্র কোরানে জিকিরের ব্যবহার, ও এর গুরুত্ব। (প্রথম অংশ)
*********************************************
আভিধানিক অর্থঃ- আল্লাহকে ডাকা, স্বরণ করা, মনে করা, উল্লেখ করা, বর্ণনা করা ইত্যাদি।
পারিভাষিক অর্থঃ- শরীয়তের আলোকে জিকির বলা হয়, মুখে বা অন্তরে আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা এবং প্রশংসা করা।
জিকির করবেন কীভাবে?
জিকিরের পরিপূর্ণতাই বা আসে কীভাবে?
নাবুঝে জিকির করলে সাওয়াব পাওয়া যাবে কিনা?
জিকির কি জিহ্বায়, ক্বলবের স্মরণে নাকি অর্থ বুঝে?
সব সময় জিকির করা প্রসঙ্গে বিশ্বনবির বক্তব্যই বা কী ছিল?
ইমাম বুখারি রহমাতুল্লাহি আলাইহি ‘আল্লাহর জিকিরের ফজিলত’ নামে একটি অধ্যায় হাদিসের বিখ্যাত গ্রন্থ বুখারিতে সংযোজন করেছেন। এ জিকির দ্বারা কী উদ্দেশ্য, তা বর্ণনা করে ইবনে হাজার আসকালানি বলেছেন, ‘এ জিকির হলো ওই সব শব্দ বা বাক্য, যা বললে সাওয়াব পাওয়া যায়।
এসব জিকিরের মধ্যে ‘সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আল্লাহু আকবার, লা হাওলা ওয়ালা কুয়্যাতা ইল্লা বিল্লাহ, বিসমিল্লাহ, হাসবুনাল্লাহ, আসতাগফিরুল্লাহ সহ দুনিয়া ও পরকালের কল্যাণ কামনায় যে কোনো দোয়া করাই জিকিরের শামিল।
এ ছাড়াও নিয়মিত ফরজ নামাজ ও কাজ, কুরআন তেলাওয়াত, জ্ঞানার্জন এবং নফল নামাজ আদায় করাকেও জিকির হিসেবে গন্য করা হয়। জিকির শুধুমাত্র মানুষের জিহ্বার উচ্চারণের মাধ্যমেও হতে পারে। আবার জিহ্বার উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে অন্তরের স্মরণ বা উপলব্দি সংযুক্ত হলে তা উত্তম ও পরিপূর্ণতার জিকিরে পরিণত হবে। অন্তরের স্মরণের সঙ্গে সঙ্গে যদি জিকিরের অর্থ উপলব্দি করে মুমিন তবে তা হবে আরো উত্তম এবং ফজিলতপূর্ণ।
সুতরাং জিকির জিহ্বার দ্বারা উচ্চারণ হোক আর অন্তরের স্মরণের সঙ্গে হোক কিংবা অর্থ উপলব্দির মাধ্যমেই হোক, সব ধরনের জিকিরেই সাওয়াব পাবে মুমিন। সাওয়াব পাওয়ার জন্য অন্তরের সম্পর্ক ও অর্থের সম্পর্ক জরুরি নয়। তবে পরিপূর্ণ ও উত্তম জিকিরের জন্য এসবই প্রযোজ্য।
এ কারণেই জগৎ বিখ্যাত ইসলামিক স্কলার ইমাম ফখরুদ্দিন রাজি রহমাতুল্লাহি আলাইহি জিকিরকে ৩ ভাগে ভাগ করেছেন।
ক. মুখের জিকির, কোনো চিন্তা-গবেষণা ছাড়াই জিহ্বার উচ্চারণে জিকির করা। ‘সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আল্লাহু আকবার, লা হাওলা ওয়ালা কুয়্যাতা ইল্লা বিল্লাহ, বিসমিল্লাহ, হাসবুনাল্লাহ, আসতাগফিরুল্লাহ, কুরআন তেলাওয়াত ইত্যাদি মুখে উচ্চারণ করা।
খ. কলবের জিকির, আল্লাহর জাত, সিফাত (গুণাবলী), বিধানাবলী, আদেশ-নিষেধ ইত্যাদি বিষয়গুলো নিয়ে চিন্তা ও গবেষণা করার মাধ্যমে অন্তর দিয়ে আল্লাহকে স্মরণ করা।
গ. অঙ্গপ্রত্যঙ্গের জিকির, সবসময় মানুষের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আল্লাহর আনুগত্যে রত থাকা বা পরিচালিত হওয়া। আর এ জন্যই নামাজকে কুরআনে জিকির বলা হয়েছে। নামাজে মানুষের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আল্লাহর নির্দেশ পালনে জিকিরে রত থাকে।
অনেকে আবার জিকিরকে ৭ ভাগে ভাগ করেছেন। আর তাহলো-
১.চোখের জিকিরঃ- আল্লাহর ভয়ে চোখ দিয়ে পানি প্রবাহিত হওয়া। 
২.কানের জিকিরঃ- মনোযোগ দিয়ে আল্লাহর কথা শোনা।
৩.মুখের জিকিরঃ- আল্লাহর প্রশংসা করা।
৪.হাতের জিকিরঃ- দান-সাদকা ও কল্যাণকর কাজ করা।
৫.দেহের জিকিরঃ- আল্লাহর বিধান পালন করা।
৬.ক্বলবের জিকিরঃ- আল্লাহর ভয়ে ভিত হওয়া বা তাকওয়া অর্জন করা। আল্লাহর রহমতের আশা করা।
৭.আত্মার জিকিরঃ- আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত তাকদির ও ফয়সালার উপর পরিপূর্ণ রাজি ও সন্তুষ্ট থাকা।
সুতরাং মানুষের উচিত জিকিরের উল্লেখিত বিষয়গুলোর প্রতি যথাযথ খেয়াল রাখা। সে আলোকে জিকির করা।

ইমাম নববী রহ. বলেন- জিকির কেবল তাসবীহ, তাহলীল, তাহমীদ ও তাকবীর ইত্যাদিতে সীমাবদ্ধ নয়, বরং আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে আনুগত্যের সাথে প্রত্যেক আমলকারীই জিকিরকারী হিসেবে বিবেচিত। আল্লাহ তাআলার জিকির এমন এক মজবুত রজ্জু যা সৃষ্টিকে স্রষ্টার সাথে সম্পৃক্ত করে। তাঁর সান্নিধ্য লাভের পথ সুগম করে। মানুষকে উত্তম আদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত করে। সরল ও সঠিক পথের উপর অবিচল রাখে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, 
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا اذْكُرُوا اللَّهَ ذِكْرًا كَثِيرًا,, وَسَبِّحُوهُ بُكْرَةً وَأَصِيلًا,,
হে ঈমানদাররা, তোমরা বেশি বেশি আল্লাহর জিকির করো এবং সকাল-সন্ধ্যায় আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করো। (সুরা: আহজাব, আয়াত: ৪১)
আল্লাহ তাআলা আরো বলেন-
ﻭَﺍﺫْﻛُﺮْ ﺭَﺑَّﻚَ ﻓِﻲ ﻧَﻔْﺴِﻚَ ﺗَﻀَﺮُّﻋًﺎ ﻭَﺧِﻴﻔَﺔً ﻭَﺩُﻭﻥَ ﺍﻟْﺠَﻬْﺮِ ﻣِﻦَ ﺍﻟْﻘَﻮْﻝِ ﺑِﺎﻟْﻐُﺪُﻭِّ ﻭَﺍﻟْﺂَﺻَﺎﻝِ ﻭَﻟَﺎ ﺗَﻜُﻦْ ﻣِﻦَ ﺍﻟْﻐَﺎﻓِﻠِﻴﻦَ,,
তোমরা প্রতিপালককে মনে মনে সবিনয় ও সশংকচিত্তে অনুচ্চস্বরে প্রত্যুষে ও সন্ধ্যায় স্মরণ করবে এবং তুমি উদাসীন হবে না। [সূরা আরাফ ২০৫]।
জিকির মানে আল্লাহ তায়ালার স্মরণ। জিকির সবচেয়ে বড় ও সর্বোত্তম ইবাদত। কেননা, আল্লাহ তায়ালার স্মরণ যাবতীয় ইবাদতের প্রধান ও অন্যতম লক্ষ্য। তাই মুসলমান হিসেবে আমাদের উচিৎ বেশি বেশি আল্লাহ তায়ালার জিকির করা। 
এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা কুরআনে ইরশাদ করেন,
وَلَذِكْرُ اللَّهِ أَكْبَرُ ۗ وَاللَّهُ يَعْلَمُ مَا تَصْنَعُونَ,,
আর আল্লাহর স্মরণই তো সর্বশ্রেষ্ঠ। তোমরা যা কর আল্লাহ তা জানেন। সূরা আনকাবুত ৪৫।
আল্লাহ তায়ালা আরও ইরশাদ করেন,
وَالذَّاكِرِينَ اللَّهَ كَثِيراً وَالذَّاكِرَاتِ أَعَدَّ اللَّهُ لَهُم مَّغْفِرَةً وَأَجْرًا عَظِيمًا,,
এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণকারী পুরুষ ও অধিক স্মরণকারী নারী- এদের জন্য আল্লাহ রেখেছেন ক্ষমা ও মহা প্রতিদান।
সূরা আহজাব, আয়াত ৩৫।
জিকির মানুষের ইহকাল ও পরকালের মর্যাদা বৃদ্ধি করে। নবিজী এরশাদ করেছেন, 
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَسِيرُ فِي طَرِيقِ مَكَّةَ فَمَرَّ عَلَى جَبَلٍ يُقَالُ لَهُ جُمْدَانُ فَقَالَ ‏"‏ سِيرُوا هَذَا جُمْدَانُ سَبَقَ الْمُفَرِّدُونَ ‏"‏ ‏.‏ قَالُوا وَمَا الْمُفَرِّدُونَ يَا رَسُولَ اللَّهِ قَالَ ‏"‏ الذَّاكِرُونَ اللَّهَ كَثِيرًا وَالذَّاكِرَاتُ ‏"‏,,
আবু হুরাইরা রা: থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, মক্কার একটি রাস্তায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাঁটছিলেন। জুমদান নামক পাহাড় অতিক্রম করার সময় বললেন: তোমরা চল,-এটা জুমদান-মুফাররাদুন অর্থাৎ একক গুণে গুণান্বিতরা এগিয়ে গেছে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ মুফাররদূন অর্থাৎ একক গুণে গুণান্বিত কারা? জওয়াবে তিনি বললেন, আল্লাহকে বেশি করে স্মরণকারী নারী-পুরুষ। (মুসলিম:৪৮৩৪)।
এভাবে পবিত্র কোরআনে জিকির শব্দটি বহু জায়গায় এসেছে। কিন্তু বেশির ভাগ স্থানে পৃথক পৃথক অর্থে এ শব্দের ব্যবহার হয়েছে। এক বর্ণনা মতে, পবিত্র কোরআনে জিকির শব্দ সর্বমোট ২৬৮ বার এসেছে। এর মধ্যে ১৫৪ বার এসেছে ক্রিয়া (ফেয়েল) হিসেবে আর ১১৪ বার এসেছে বিশেষ্য (ইসম) হিসেবে।
(সূত্র ইসলাম ওয়েব, ‘লফযুজ জিকরি ফিল কোরআন’)

বিভিন্ন অর্থে জিকির শব্দের ব্যবহারঃ-
জিকির শব্দের প্রথম ও প্রধান অর্থ, মৌখিকভাবে আল্লাহর স্মরণ বা জিহ্বার জিকির। যেমন— আল্লাহ তায়ালা বলেন, 
فَإِذَا قَضَيْتُمُ الصَّلَاةَ فَاذْكُرُوا اللَّهَ قِيَامًا وَقُعُودًا وَعَلَىٰ جُنُوبِكُمْ,,,
যখন তোমরা নামাজ সমাপ্ত করবে তখন দাঁড়িয়ে, বসে ও শুয়ে আল্লাহর জিকির (তাসবিহ-তাহলিল) পাঠ করবে।
(সুরা নিসা, আয়াত ১০৩)।

জিকির শব্দের দ্বিতীয় অর্থ, উপদেশ ও শিক্ষা গ্রহণ। আল্লাহ তায়ালা বলেন,
وَذَكِّرْ فَإِنَّ الذِّكْرَىٰ تَنْفَعُ الْمُؤْمِنِينَ,,
আপনি উপদেশ দিতে থাকুন। কেননা জিকির বা উপদেশ ঈমানদারদের উপকারে আসে।’ (সুরা জারিয়াত আয়াত ৫৫)

জিকির শব্দের তৃতীয় অর্থ হলো স্মরণ করা। কুরআনে এসেছে,
وَالَّذِينَ إِذَا فَعَلُوا فَاحِشَةً أَوْ ظَلَمُوا أَنْفُسَهُمْ ذَكَرُوا اللَّهَ فَاسْتَغْفَرُوا لِذُنُوبِهِمْ وَمَنْ يَغْفِرُ الذُّنُوبَ إِلَّا اللَّهُ وَلَمْ يُصِرُّوا عَلَى مَا فَعَلُوا وَهُمْ يَعْلَمُونَ,,
তারা কোনো অশ্লীল কাজ করে ফেললে কিংবা নিজেদের ওপর অবিচার করলে আল্লাহর জিকির করে (আল্লাহকে স্মরণ করে) এবং নিজেদের পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। আল্লাহ ছাড়া কে পাপ ক্ষমা করবে? (সুরা আলে ইমরান, আয়াত ১৩৫)

জিকির শব্দের চতুর্থ অর্থ আনুগত্য। আল্লাহ তায়ালা বলেন,
فَاذْكُرُونِي أَذْكُرْكُمْ وَاشْكُرُوا لِي وَلَا تَكْفُرُونِ,,
তোমরা আমার জিকির (আনুগত্য প্রদর্শন) করো, আমিও তোমাদের ‘জিকির’ (প্রতিদান দান) করব।

জিকির শব্দের পঞ্চম অর্থ কুরআন। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন,
وَهَٰذَا ذِكْرٌ مُبَارَكٌ أَنْزَلْنَاهُ ۚ أَفَأَنْتُمْ لَهُ مُنْكِرُونَ,,
এটা বরকতময় জিকির (কুরআন)। আমি তা অবতীর্ণ করেছি। তবু কি তোমরা তা অস্বীকার করবে? সুরা আম্বিয়া, আয়াত ৫০।

জিকিরের ষষ্ঠ অর্থ মর্যাদা ও গৌরব। আল্লাহ তায়ালা তায়ালা বলেন,
وَإِنَّهُ لَذِكْرٌ لَكَ وَلِقَوْمِكَ ۖ وَسَوْفَ تُسْأَلُونَ,,
কুরআন তো আপনার ও আপনার জাতির জন্য জিকির বা সম্মানের বস্তু। (সুরা জুখরুফ, আয়াত ৪৪)

জিকির শব্দের সপ্তম অর্থ খবর ও সংবাদ। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন,
وَيَسْأَلُونَكَ عَن ذِي الْقَرْنَيْنِ قُلْ سَأَتْلُو عَلَيْكُم مِّنْهُ ذِكْرًا,,
তারা আপনার কাছে জুলকারনাইন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবে। বলে দিন, আমি তোমাদের কাছে তার জিকির (খবর বর্ণনা) করব। (সুরা কাহাফ, আয়াত ৮৩)

জিকির শব্দের অষ্টম অর্থ শরিয়ত। কুরআনে এসেছে,
لِنَفْتِنَهُمْ فِيهِ وَمَن يُعْرِضْ عَن ذِكْرِ رَبِّهِ يَسْلُكْهُ عَذَابًا صَعَدًا,,
যে ব্যক্তি তার প্রতিপালকের জিকির (শরিয়ত) থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তিনি তাকে দুঃসহ আজাবে প্রবেশ করাবেন।
সুরা জিন, আয়াত ১৭

জিকির শব্দের নবম অর্থ লাওহে মাহফুজ (সংরক্ষিত ফলক)। আল্লাহ তায়ালা বলেন,
وَلَقَدْ كَتَبْنَا فِي الزَّبُورِ مِنْ بَعْدِ الذِّكْرِ أَنَّ الْأَرْضَ يَرِثُهَا عِبَادِيَ الصَّالِحُونَ,,
আমি জিকির বা লাওহে মাহফুজের পর কিতাবে লিখে দিয়েছি, আমার যোগ্যতাসম্পন্ন (অথবা নেককার) বান্দারা পৃথিবীর অধিকারী হবে। (সুরা আম্বিয়া, আয়াত ১০৫)

জিকির শব্দের দশম অর্থ নামাজ। হজরত দাউদ আ. এর ঘটনা প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে এসেছে,
فَقَالَ إِنِّي أَحْبَبْتُ حُبَّ الْخَيْرِ عَن ذِكْرِ رَبِّي حَتَّى تَوَارَتْ بِالْحِجَابِ,,
সে বলল, আমি তো আমার প্রতিপালকের জিকির (নামাজ) থেকে বিমুখ হয়ে ঐশ্বর্যপ্রীতিতে মগ্ন হয়ে গেছি। এদিকে সূর্য অস্তমিত হয়ে গেছে। (সুরা সাদ, আয়াত ৩২)
জিকিরের গুরুত্বঃ-
প্রিয়নবির ভাষায় তাসবিহ হাতে মসজিদে বসে শুধুমাত্র ‘আল্লাহ আল্লাহ’ করার নামই জিকির নয় বরং দুনিয়ার প্রতিটি কাজে আল্লাহর বিধান পালনই প্রকৃত জিকির। প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুসলিম উম্মাহকে মুখে ও হাতে তথা কথা এবং কাজের মাধ্যমে আল্লাহকে স্মরণ করার ও জিকির করার প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন।
আল্লাহ তাআলার জিকির বা স্মরণ মহান প্রভুরই নির্দেশ। কুরআনে পাকের অনেক জায়গায় তিনি এ ঘোষণা দিয়েছেন।
আল্লাহ তায়ালা বলেন,
فَاذْكُرُونِي أَذْكُرْكُمْ وَاشْكُرُواْ لِي وَلاَ تَكْفُرُونِ,,
‘অতঃপর তোমরা আমাকে স্মরণ কর, আমি তোমাদেরকে স্মরণ করব।’ (সূরা আলে ইমরান ১৫২)।
এ কারণেই আল্লাহ তাআলা মানুষকে বসে-দাঁড়িয়ে-শুয়ে তথা জীবনে প্রতিটি কাজে বেশি বেশি তাঁর জিকির তথা স্মরণের নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহর এ জিকির বা স্মরণের ফলে মানুষ প্রথমত শয়তানের গোমরাহী থেকে মুক্তি পায়। জিকিরের মাধ্যমেই বান্দা জাহান্নামের কঠিন আগুন থেকে মুক্তি পাবে। আল্লাহ তাআলা বলেন-
الَّذِينَ يَذْكُرُونَ اللَّهَ قِيَامًا وَقُعُودًا وَعَلَىٰ جُنُوبِهِمْ وَيَتَفَكَّرُونَ فِي خَلْقِ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ رَبَّنَا مَا خَلَقْتَ هَٰذَا بَاطِلًا سُبْحَانَكَ فَقِنَا عَذَابَ النَّارِ
যারা দাঁড়িয়ে বসে এবং শুয়ে আল্লাহর (জিকির) স্মরণ করে এবং আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টি সম্পর্কে চিন্তা করে এবং (বলে) হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি এ সব নিরর্থক সৃষ্টি করনি। তুমি পবিত্র। তুমি আমাদেরকে আগুনের শাস্তি থেকে রক্ষা কর।’ সুরা আল-ইমরান আয়াত ১৯১।
فَإِذَا قَضَيْتُمُ الصَّلَاةَ فَاذْكُرُوا اللَّهَ قِيَامًا وَقُعُودًا وَعَلَىٰ جُنُوبِكُمْ ۚ فَإِذَا اطْمَأْنَنتُمْ فَأَقِيمُوا الصَّلَاةَ ۚ إِنَّ الصَّلَاةَ كَانَتْ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ كِتَابًا مَّوْقُوتًا
অতঃপর যখন তোমরা সালাত সমাপ্ত করবে তখন দাঁড়িয়ে, বসে এবং শুয়ে আল্লাহকে স্মরণ করবে। অতঃপর যখন তোমরা নিরাপদ হবে তখন যথাযথ সালাত কায়েম করবে নির্ধারিত সময়ে সালাত কায়েম করা মুমিনদের জন্য অবশ্য কর্তব্য।।
ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, আল্লাহ্ তা’আলা যখনই কোন ফরয তার বান্দাদের উপর অবধারিত করে দিয়েছেন তখনই সেটার একটা সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। তারপর যারা সেটা করতে সক্ষম হবে না তাদেরকে ভিন্ন পথ বাতলে দিয়েছেন। এর ব্যতিক্রম হচ্ছে, ‘আল্লাহর যিকর’। এই যিকর এর ব্যাপারে যতক্ষণ কেউ সুস্থ বিবেকসম্পন্ন থাকে, ততক্ষণ আল্লাহ তা’আলা কাউকে ওযর আপত্তি পেশ করার সুযোগ দেন নি । সর্বাবস্থায় তাকে যিকর করতে হবে। রাত-দিন, জল-স্থল, সফর-মুকীম, ধনী-দরিদ্র, সুস্থ-অসুস্থ, গোপন-প্রকাশ্য সর্বাবস্থায় আল্লাহর যিকর চালিয়ে যেতে হবে। এ আয়াতের এটাই ভাষ্য। [তাবারী, আত-তাফসীরুস সহীহ]
فَاِذَا قُضِیَتِ الصَّلٰوۃُ فَانۡتَشِرُوۡا فِی الۡاَرۡضِ وَ ابۡتَغُوۡا مِنۡ فَضۡلِ اللّٰہِ وَ اذۡکُرُوا اللّٰہَ کَثِیۡرًا لَّعَلَّکُمۡ تُفۡلِحُوۡنَ,,
অতঃপর নামায সমাপ্ত হলে তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড় এবং আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান কর ও আল্লাহকে অধিকরূপে স্মরণ কর; যাতে তোমরা সফলকাম হও। সূরা জুমআ আয়াত ১০।
এর অর্থ বৈষয়িক কাজ-কর্ম ও ব্যবসা-বাণিজ্য। অর্থাৎ, জুমআর নামায শেষ করার পর তোমরা পুনরায় নিজ নিজ কাজে-কামে এবং দুনিয়ার ব্যস্ততায় লেগে যাও। এ থেকে উদ্দেশ্য হল এই ব্যাপারটা পরিষ্কার করে দেওয়া যে, জুমআর দিন কাজ-কর্ম বন্ধ রাখা জরুরী নয়। কেবল নামাযের জন্য তা বন্ধ রাখা জরুরী।
নামাজ, রোজা, হজ, যাকাত সহ ফরজ ইবাদতের পর আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার সর্বোত্তম উপায় হলো অধিক হারে জিকির করা। এজন্য হজ সমাপনের পর পরই আল্লাহ তায়ালা তার বান্দাদেরকে জিকিরে মাশগুল হতে বলেছেন।
فَإِذَا قَضَيْتُمْ مَنَاسِكَكُمْ فَاذْكُرُوا اللَّهَ كَذِكْرِكُمْ آَبَاءَكُمْ أَوْ أَشَدَّ ذِكْرًا,,
‘যখন হজের যাবতীয় অনুষ্ঠানক্রিয়াদি সমাপ্ত করে সারবে, তখন স্মরণ করবে আল্লাহকে, যেমন করে তোমরা স্মরণ করতে নিজেদের বাপ-দাদাদেরকে; বরং তার চেয়েও বেশী স্মরণ করবে। (সূরা বাকারা ২০০)।
(চলবে...)

Comments